পত্রিকা ছোট পত্রিকাদের মঞ্চ !
  • লেখা জমা দিন
  • লগ ইন
  • নিয়ন্ত্রন
    • পত্রিকা তালিকা
    • লেখক তালিকা
    • English
    • বাংলা
    • ভুল ভ্রান্তি
  • হোম
  • লেখা
  • প্রবন্ধ
  • Sailen Saha
প্রবন্ধ Tuesday, October 27, 2015 Sailen Saha Views: 761
বাংলা নাট্য আন্দোলন ও দিল্লি

নাটককে অর্থাৎ নাট্যশিল্পকে আমি ছোটবেলা থেকেই ভালবেসেছি ।  আর সেই ভালবাসার জন্মলগ্নের সাথে যে মানুষটার নাম জড়িয়ে আছে আমি আজও সগর্বে তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে চাই — তিনি জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত শিশু সাহিত্যিক শ্রী শৈলেন ঘোষ । আমার এই ভালবাসার গভীরতার সাথে আমার আত্মপরিচয় কিছুটা উল্লেখনীয় ।  কেননা, নিজেকে জানতে না পারলে বাকি কথার গোড়াপত্তন হবে কি করে ! যে সময়ে এবং পরিবেশে শুধুমাত্র নিজের আত্মপ্রতিষ্ঠার কথা ছাড়া আর কিছু ভাবাটা ছিল ভীষণ অন্যায়, ঠিক তেমনি সময়ে আমাকে প্রেমজ্বরে ধরার মত নাট্যজ্বরে ধরেছিল – জানি, সেটা বিশ্বাস করা অনেকের পক্ষেই অসম্ভব । সেই সূত্রেই বলি, আমার জন্ম পূর্ববাংলার টাঙ্গাইল-এ । গ্রামের নাম পোড়াবাড়ি, যা আজও চমচমের জন্য  বিখ্যাত । আমার বাবা টাঙ্গাইলের সুপ্রতিষ্ঠিত হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক এবং ‘কিং হোমিও ট্রেনিং কলেজ’-এর প্রতিষ্ঠা-অধ্যক্ষ ছিলেন ।  রাজনৈতিক ডামাডোলে দেশ ভাগ হওয়া আমাদের জীবনের এক চরম বিপর্যয়ী ঘটনা ।  আমরা বাধ্য হয়ে রাতের অন্ধকারে বংশানুক্রমে পাওয়া জন্মভূমিকে প্রণাম করে চিরতরে পাড়ি দিলাম এক অজানা ভবিষ্যতের দিকে, চলে এলাম কলকাতায় । রাতের অন্ধকারে বলছি এই কারণে যে বাবার পক্ষে সেই  সময় অত মানুষের শ্রদ্ধা, ভালবাসা ও প্রত্যয় উপেক্ষা করে চলে আসা সম্ভব ছিল না । সজ্ঞানে কেউ তাঁকে ছাড়তে রাজি হতেন না ।  কিন্তু বাবা  বুঝতে পেরেছিলেন রাজনীতি এমন কুটিল সংগ্রাম যে সেখানে কোন যুক্তি বা আবেগ  টিকবে না । তখনকার পরিবেশ ঐতিহাসিকরাই হয়তো কিছুটা আপনাদের বোঝাতে পারবেন আর যাঁদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আছে তাঁরাও কিছুটা উপলব্ধি করতে পারবেন । এখন সেই পরিস্থিতি সঠিক বোঝানো একেবারেই অসম্ভব । তবে  বাবার দূরদৃষ্টির মূল্য আজ আমরা বুঝতে পেরেছি এবং সেই অভিভাবকত্বের হাত ধরেই আজ আমরা প্রতিষ্ঠিত ।

 

আমাদের শৈশবে আনন্দবাজার পত্রিকার সোমবারের পাতায় ‘আনন্দমেলা’ এবং তারই পথ ধরে সারা বাংলায়   ‘মণিমেলা’ আন্দোলন এক অসাধারণ প্রভাব ফেলেছিল । পাশাপাশি উল্লেখ করতে হয় যুগান্তর পত্রিকার  মঙ্গলাবারের পাতায় ‘ছোটদের পাততাড়ি’-র কথা যার হাত ধরে সারা বাংলায় ‘সবপেয়েছির আসর’ অসম্ভব  জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল । শিশু  মনোজগতের বিশেষ সুস্থ স্বপ্নরাজ্য তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন এঁরা । আমিও  ছিলাম সেই স্বপ্নরাজ্যের এক  বাসিন্দা । শৈশবে সালকিয়ার ‘শহীদ মণিমেলা’-র সদস্য  আর  যৌবনে যাদবপুরের সন্তোষপুরে ‘রক্তকরবী সবপেয়েছির আসর’-এর কর্মী হিসেবে নিজেকে গৌরবান্বিত মনে করি । সেই সময়ে স্কুলের প্রথম জীবনে ‘শহীদ মণিমেলা’-র অনুষ্ঠানে নাটক করাতে এলেন মণিমেলা মহাকেন্দ্র থেকে শৈলেন ঘোষ । ভাবলে মনে হয় , এই তো সেদিনের কথা । আমি তাঁর লেখা ‘দত্যি দানার ছানা’ নাটকের মলাটের চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ পেয়েছিলাম, যেখানে অনেক পশু-পাখি ও মানুষকে নিয়ে বিভিন্ন পুতুল চরিত্রে এই নাটক গড়ে ওঠে । শৈলেনদার এই মুখোশ নাটক, তাঁর প্রশিক্ষণ পদ্ধতি এবং মণিমেলার সাংস্কৃতিক প্রেরণা আমার  জীবনে এক নতুন জোয়ার এনেছিল একথা আজ স্বীকার করতে আমার বুক গর্বে উন্নত হয়ে ওঠে । তারপর জীবন নদীতে অনেক জোয়ার ভাটা ও জল গড়িয়ে যাবার ঘটনা আর সবার মত আমার ক্ষেত্রেও তা স্বাভাবিকভাবেই ঘটেছে । ভাসতে ভাসতে শেষ পর্যন্ত একদিন তরী এসে ভিড়লো দিল্লির ঘাটে এবং হিন্দি প্রবাদ মেনে এখানেই থেকে গেলাম – ‘দানে দানে পে  লিখা হোতা হায় খানেওয়ালে কা নাম’ ।  সেইসঙ্গে ভাগ্য তো আছেই !

 

কলকাতায় শিক্ষাদীক্ষা সমাপ্ত করে কর্মসূত্রে দিল্লিতে ইঞ্জিনীয়ার হয়ে চলে এলাম । সঙ্গে নিয়ে এলাম দু’টি বিশ্ববিদ্যালয়ের দু’টি স্নাতকোত্তর ডিগ্রী আর ফেলে এলাম কলকাতার দীর্ঘ সাংস্কৃতিক জীবনের সকল শ্রমার্জিত  অভিজ্ঞতা ও স্বপ্ন । নতুন জায়গা, নতুন মানু্‌ষ, নতুন জীবন এবং পাথুরে রুক্ষ সংগ্রামী পরিবেশ । দেখতে দেখতে কেটে গেল অনেকগুলো বছর , অনেকটা সময় । বয়সের সাথে সাথে জীবনের রং পাল্টালো, রঙ্গমঞ্চের দৃশ্যও পাল্টালো । অভিজ্ঞতার পলি জমা হল নতুন করে – পরিচয়ে খোকা, ভাই, দাদা, কাকু, স্বামী, বাবা, মেসোমশাই, দাদু সবই প্রায় পেরিয়ে এলাম এক এক করে  । এখন শুধু পিছন ফিরে দেখার পালা ।

 

চাকরি করতে এসে নিয়মের জালে বাঁধা পড়লাম এমন ভাবে যে কবিতা, সাহিত্য, নাটক সব শিকেয় ঊঠলো ।  কেবলমাত্র পুজোর ক’টা দিন নিশ্চিত ছুটির প্রতিশ্রুতি ছিল, কারণ মালিক নিজে ছিলেন বাঙালি ব্রাহ্মণ । সুতরাং  সেই সময়েই কেবলমাত্র এক ঘটি সংস্কৃতি সুধা পানের সুযোগ পেতাম । চুটিয়ে তার সদ্ববহারও করতাম তখন । বন্ধুদের কয়েকজন জানতেন আমার কলকাতার জীবনের কথা, তাঁদেরই উৎসাহে ভাড়া বাড়ির ছোট্ট পরিবেশেও মহলা চলতো নৃত্যনাট্য কিংবা সঙ্গীত আলেখ্যের । আমার জীবনসঙ্গিনী ছিলেন স্বনামধন্যা দীপালি নাগের ছাত্রী  যাঁর দৌলতে আমি নিজেও দীপালিদি এবং ডঃ বি ডি নাগচৌধুরীর কাছে জামাই-আদর পাবার সুযোগ পেয়েছি ।  সেই সুবাদে আমাদের পুজোর অনুষ্ঠানের সঙ্গীত বিভাগটা স্ত্রীর হাতে সঁপে দিয়ে বাকি কাজগুলো নিজেই সাজাতাম । অনুষ্ঠান করতাম পুজোর ক’দিন খুব আনন্দ করে । সেই সময় আজকের মত মুম্বাই বা কলকাতার শিল্পীদের এই কেনা বেচার এত দাপট ছিল না, বরং নিজেদের ছোট, বড়, মাঝারি এমনকি গৃহিণীরাও মঞ্চে ওঠার সুযোগ পেতেন এবং আন্তরিক আনন্দ ভাগ করে নিতেন এই বাৎসরিক উৎসবে । এই প্রসঙ্গেই দিল্লির নাট্যচর্চার ইতিহাস শুরু ।

দিল্লিতে বাংলা নাটকের ইতিহাস নিয়ে কথা বলতে গেলে আজকের তারিখে অনেকের অনেক কথাই মনে পড়ে যাওয়া স্বাভাবিক আর এই সীমিত পরিসরে এই দীর্ঘ আলোচনার পূর্নাঙ্গ রূপ দেওয়া সম্ভব নয় ।  তবুও কিছু কিছু ঘটনা উল্লেখ করতেই হয় । বাঙালি সংস্কৃতির এক বিশেষ অঙ্গ হল দুর্গাপূজায় নাটক, আর সে কথা বলতে গিয়ে  দিল্লিতে দুর্গাপূজার পুরোনো কথাও একটু বলে নেওয়া দরকার ।

১৮৪২ সালে রাজশাহীর  জমিদার ভবানীপ্রসাদ মজুমদার বিশেষ কাজে মুঘল দরবারে এসেছিলেন শাহজাহানাবাদে সম্রাটের সাথে দেখা করতে । কাজ শেষ হতে হতে শরৎকাল ও পূজার সময় এসে যায় এবং একজন প্রতিপত্তিশালী জমিদার হিসেবে তখন সেখানেই তিনি দুর্গাপূজা করার অভিলাষ ব্যক্ত করেন । বাংলাদেশ থেকে প্রতিমা ও পুরোহিত নিয়ে এসে দুর্গাপূজা হল শাহজাহানাবাদে ।  এরপর ১৮৭৫ এবং ১৯০৪ সালে আর দু’বার দুর্গাপূজা হয় সীতারাম বাজারে ভট্টাচার্য হাভেলিতে । দিল্লির  প্রথম বারোয়ারী দুর্গাপূজা হয় ১৯১০ সালে বল্লীমারানের রোশনপুরা কালীমন্দিরে, অবশ্য এই পূজায় কোন মূর্তি নয়, ঘট বসিয়েই  পূজা সারা হয় । পরের বছর স্থানাভাবে চাঁদনিচকের কাছে একটি ধর্মশালায় পূজা হয় এবং পরে সেটি চলে আসে ফতেপুরী  লক্ষ্মীনারায়ণ ধর্মশালায় । কাশ্মিরীগেটের এই পূজার চলন সেখান থেকেই শুরু । তখন বেনারস থেকে আনা হত মূর্তি যা ১৯২৬ সাল পর্যন্ত চালু ছিল । ১৯১৩ সাল থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত পূজা হয় লক্ষ্মীনারায়ণ ধর্মশালাতেই যেখানে ১৯২৪ সাল পর্যন্ত বেঙ্গল  ড্র্যামেটিক ক্লাব এবং রেলয়ে ইনস্টিট্যুট একযোগে উৎসাহ নিয়ে নাটক, নাচ, গান, ব্যায়াম প্রদর্শনী ইত্যাদির আয়োজন করতেন । ১৯২০ সালে ‘লক্ষ্মীছাড়ার দল’ নামে নাট্যদল গড়েছিলেন ডঃ বীরেন্দ্র গুপ্ত ও সুরেন্দ্রনাথ সেন । ১৯২৩ সালে ‘নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন’ গড়ে ওঠে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির  সেবামূলক উদ্দেশ্য নিয়ে । এঁরাও তখন নাটক করতেন বিভিন্ন মঞ্চে ।   ১৯২৪ সালে ‘বঙ্গীয় নাট্য সমিতি’ নিজেরা দলগত নাটক মঞ্চস্থ করেন । এখানকার এই রকম উৎসাহের ফলেই কাশ্মিরীগেট বেঙ্গলী ক্লাবের জন্ম হয় ১৯২৫ সালের ২৯শে জুলাই ।  নিউদিল্লি  পাবলিক লাইব্রেরীর সাংস্কৃতিক বিভাগ ‘বেঙ্গল ড্র্যামেটিক ক্লাব’ নামে অভিনয় করতেন । দিল্লিতে বাঙালিদের এক সাংস্কৃতিক পীঠস্থান গড়ে উঠেছিল নিউদিল্লি কালীবাড়িকে কেন্দ্র করে ‘নিউদিল্লি বেঙ্গলি  ক্লাব’ ১৯৩৩ সালে ।  এই সময়কার কিছু নাট্যানুরাগী বা অভিনেতার নাম এখানে উল্লেখ করা যেতেই পারে, যেমন ডাঃ বীরেন্দ্র গুপ্ত, সুরেন্দ্রনাথ সেন, ডঃ পুতুল নাগ, রাধামোহন ভট্টাচার্য, রসরাজ চক্রবর্তী, গোপাল চন্দ্র দাস, শান্তি দত্ত রায়, রাজেন রায়, অনিল কৃষ্ণ ঘোষ, অনিল সরকার, শান্তি লাহিড়ী, পঞ্চানন চট্টোপাধ্যায়, শান্তনু রায়চৌধুরী, প্রণব বল, পরিতোষ মুখার্জী, মণি চট্টোপাধ্যায়, গঙ্গা গুহ, সুবিমল ব্যানার্জী, সুরেশ সেন, অমর দত্ত, সুধীর চক্রবর্তী এবং আরও অনেকে । সব নাম হয়তো উল্লেখ করা গেল না , তবুও সেইসব কৃতি মানুষদের আমি আন্তরিক শ্রদ্ধা জানাই যাঁরা দিল্লির পরবর্তী প্রজন্মকে এক নাট্য- ইতিহাস এবং নাট্য-পরম্পরা উপহার দিয়েছেন ।

 

তখনকার পুজো প্যান্ডেল বলতে আজকের মত থিম পুজোর কথা ভাবাই যেত না । অর্থ সংগ্রহের পরিমাণও ছিল নিতান্ত সামান্য । তাই খোলা মাঠে কাপড়ের কানাৎ দিয়েই ঘেরাটোপের পরিমন্ডলীতে দুর্গাপূজার আয়োজন হত । মাথার ওপরেও থাকতো কাপড়ের আচ্ছাদন । সেই প্যন্ডেলেই অস্থায়ী মঞ্চে সন্ধ্যাবেলার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ছিল বাঙালিদের এক সবচেয়ে বড় আনন্দানুষ্ঠান । সেখানে কচিকাঁচা থেকে শুরু করে মহিলা পুরুষ সকলেই গান বাজনা নাচ এবং অভিনয় নিয়ে মেতে উঠতেন সেই পুজোর চারটে দিন । এই আয়োজনের মহলা শুরু হয়ে যেত প্রায় মাস দু’তিনেক আগে থেকেই । উৎসাহী আয়োজকের বাড়ির  ছাতের ওপরেই চলতো  নিয়মিত মহলা বা চর্চা । ফলে সেই আড্ডা থেকেই সামাজিক সম্পর্কও গড়ে উঠতো যথেষ্ট শক্ত ভিতের ওপর । নাচ গান বাজনা ছাড়াও তখন নাটক করার উৎসাহ ছিল খুব বেশি । ছোটদের নাটক, বড়দের নাটক এমনকি মহিলাদের নাটকও ছিল বিশেষ আকর্ষনীয় । অবশ্য এখানে বলে রাখা ভাল, সেই সব নাটকের ধ্যানধারণা বা বইপত্র সবকিছুই সংগৃহীত হত কলকাতা থেকেই ।  তখন বছরের এই সময়টায় নাটকের উৎসাহ দেখা যেত প্রচুর, যদিও সে সবই ছিল কলকাতার মঞ্চে অভিনীত নাটকের অনুকরণ মাত্র । কলকাতা থেকে চলতি নাটকের বই কিনে এনে পাড়ার নাট্যরসিকেরা নিজেদের গুণপনা দেখাতে নিজেদের যোগ্যতা অনুযায়ী সেই নাটকের রিহার্সাল দিতেন কলকাতার প্রসিদ্ধ অভিনেতাদের  অনুকরণে । তখন কলকাতার নাটক, বিশেষত হাতিবাগান এলাকায় যার  প্রভাব সবচেয়ে বেশি , তেমনি নাটক  দেখে এসে তাঁদের অনুকরণের ইচ্ছা হত দিল্লির অভিনেতাদের ।  যে যত বেশি কলকাতার নামী অভিনেতাদের অনুকরণে সফল হতেন তাঁকেই দিল্লিতে বড় অভিনেতার খেতাব দিতেন দর্শকেরা । মৌলিকত্ব নিয়ে তখন কোন চিন্তা ভাবনার অবসর ছিল না ।

দিল্লির পূজাপ্যান্ডেল থেকে উঠে আসা নাটক যেভাবে জনজীবনে আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে তার তুলনা নেই । আগেই বলেছি দিল্লির জীবনযাত্রায় পেশা ও নেশার মধ্যে তালমিল খুঁজে পাওয়া যে কতটা  দুঃসাধ্য ব্যাপার তা কেবল এখানকার সংস্কৃতিপ্রেমি মানুষেরাই জানেন । তবুও সকল প্রতিকূলতা ও প্রতিবন্ধকতাকে ঠেলে দূরে সরিয়ে রেখে এখানে দিল্লিবাসীকে নিজের জীবিকার পাশে ভালবাসার বিষয়কে অনেক কষ্টে প্রতিষ্ঠিত করতে হয়, আর সেটা যাঁরা পেরেছেন তাঁদের প্রণাম না জানিয়ে  উপায় নেই ।  ক্রমে ক্রমে নাটককে ভালবেসে অনেকেই  আবার নাটকের দল বানিয়ে ফেললেন সারা বছর আরও বেশি নাটক করতে পারার আশায় ।

নাটককে ভালবেসে অন্য সবাইকার মত দিল্লির মানুষেরাও নাটক করেছেন এবং নাট্যদল গড়ে তুলেছেন বংশানুক্রমিকভাবে । উত্তরসূরীরা সেই প্রবাহকে কীভাবে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন তার একটা ছবি পাওয়া যাবে  নীচের এই অসম্পূর্ণ তালিকাটি থেকে —

যেমন – বঙ্গীয় নাট্য সমিতি ( ১৯২৪), বেঙ্গলী ক্লাব – কাশ্মিরী গেট ( ১৯২৮), বেঙ্গলীক্লাব – নিউদিল্লি কালীবাড়ি (১৯৩৩), মিলন সমিতি (১৯৩৭), যুবসঙ্ঘ (১৯৪০), ভারতীয় গণনাট্যসঙ্ঘ – IPTA, দিল্লি শাখা (১৯৪৩), লোদিরোড  বেঙ্গলী ক্লাব (১৯৪৫), মিতালী সঙ্ঘ (১৯৪৭), অগ্রণী সঙ্ঘ (১৯৪৮), সংস্কৃতি পরিষদ (১৯৪৯), বিনয়নগর বেঙ্গলী ক্লাব (১৯৫০), উদয়ন (১৯৫২), বঙ্গীয় পরিষদ (১৯৫৪), চেনা মহল (১৯৫৫), কৃষ্টি সংসদ (১৯৫৫), শনিচক্র (১৯৫৬), চতুরঙ্গ (১৯৫৭), সুহৃদ সংঘ (১৯৫৭), নবনাট্যম (১৯৫৮), করোলবাগ বঙ্গীয় সংসদ (১৯৫৮), নবনাট্যম (১৯৫৮), যুবসম্প্রদায় (১৯৬০), সুহৃদ সম্প্রদায় (১৯৬০), কালচক্র (১৯৬১), যাযাবর গোষ্ঠী (১৯৬১), অপরাজিত সঙ্ঘ (১৯৬১), নবোদয় গোষ্ঠী (১৯৬৭), অগ্রদূত (১৯৬৭), অগ্রগামী (১৯৬৭), ধূমকেতু (১৯৬৭), চলন্তিকা গোষ্ঠী (১৯৬৭), মিলনী (১৯৬৮), নাট্যকাল (১৯৬৯), কালকাজী বঙ্গীয় সমাজ, বর্তমান চিত্তরঞ্জন পার্ক বঙ্গীয় সমাজ (১৯৭২), প্রেরণা – ফরিদাবাদ (১৯৭৪), থিয়েটার কর্ণার (১৯৭৪), শিল্পায়ন (১৯৭৫), কশেরুকা (১৯৭৬), চেনামুখ (১৯৭৭), আমরা ক’জন (১৯৭৯), প্রস্তুতি (১৯৮২), অনামিকা (১৯৮৩), সুত্রধর (১৯৯০), সংশপ্তক (১৯৯২), বিকল্প (১৯৯৩), আকৃতি (২০০২), সার্কল থিয়েটার (২০০৩), সাঁঝবাতি (২০০৬), থিয়েটার প্ল্যাটফর্ম (২০০৭), স্বপ্ন এখন (২০০৮), গ্রীণরুম থিয়েটার (২০০৯), নীলপ্রত্যূষ (২০০৯), নবপল্লী নাট্যসংস্থা (২০১১), বিডিএনসিআর ( ২০১২) ।  আরও কিছু দল দিল্লিতে রয়েছে যাঁদের শুরুর ইতিহাস আপাতত উল্লেখ করা না গেলেও তাঁদের নামগুলি হল   —  ছন্নছাড়া, থিয়েটার প্ল্যাটফর্ম , দ্বারকা আর্ট এন্ড কালচার সোসাইটি, সম্বিত, নাট্যরঙ্গ, নির্বাক অভিনয় একাডেমি, ব্যাক ড্রপ, পিউপিল্‌ থিয়েটার গ্রুপ,সৃজনী, বৈকালিক সংঘ ইত্যাদি ।

হয়তো বাকি রয়ে গেল আরও অনেক অজানিত নাম ও ইতিহাস, যার উদ্ঘাটন কেবল দীর্ঘ ও আন্তরিক গবেষণা দ্বারাই সম্ভব । তবে বহুনাট্যদল  সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে টিকে থাকতে না পারলেও এ কথা গর্ব করে বলার মত যে এখনও দিল্লিতে বাংলা নাট্যদলের সংখ্যা অন্ততপক্ষে গোটা তিরিশেক কিংবা তারও বেশি ।

পঞ্চাশ এবং ষাটের দশকে দিল্লিতে বাংলা নাটকের জোয়ার এসেছিল বলা যায় । সেই উৎসাহে  নিউদিল্লি কালীমন্দিরের বেঙ্গলি ক্লাব  থেকে ১৯৬০ সালে উদ্যোগ নেওয়া হয় ‘একাঙ্ক বাংলা নাট্য প্রতিযোগিতা’ চালু করার । সারা দিল্লির নাট্যকর্মী ও দর্শকের মধ্যে ভীষণ রকম উদ্দীপনা দেখা দেয়  এবং এই প্রতিযোগিতা একটি বাৎসরিক আকর্ষণ হয়ে ওঠে । পরে ১৯৬৮ সালে ‘অল ইন্ডিয়া ড্রামা কম্পিটিশন’ নামে আরও প্রচার লাভ  করে । এই সময় রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, ডি এল রায়, দীনবন্ধু মিত্র, মাইকেল ছাড়াও উৎপল দত্ত, শম্ভু মিত্র, বিমল মিত্র, বাদল  সরকার, বীরু চট্টোপাধ্যায়ের মত আধুনিক নাট্যকারদের নাটকও অভিনীত হত ।

পশ্চিমবঙ্গ সরকার যখন বাংলা যাত্রা পালার পুনরুত্থানের কথা ভেবে তার পথকে সুগম করতে বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করেন  এবং নানা মানের পুরস্কার ঘোষণা করেন তখন এই শিল্প নতুন প্রেরণা পায় এবং শিল্পীরাও নিজেদের প্রতিভার স্বীকৃতি পেতে থাকেন । এই পরিস্থিতে ক্রমে যাত্রা পালায় অর্থ সমাগমের সুযোগে বাংলা সিনেমার অভিনেতা অভিনেত্রীরাও এসে যোগ দেন  এই শিল্প মাধ্যমে । দিল্লির নাট্যপ্রেমি মানুষেরাও যাত্রা নিয়ে আগে থেকেই ভাবনা চিন্তা করলেও কলকাতার যাত্রা জগতের এই পালাবদলের পরিপ্রেক্ষিতে নিজেরা আরও একটু বেশি উজ্জীবিত হয়ে ওঠেন এবং পুজো প্যান্ডেলে নিজেরাই নানান দল তৈরি করে সারা রাতব্যাপী যাত্রাভিনয় করতে থাকেন ।  তাতে তাঁদের অভিনয়খ্যাতি আরও একটুও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ।  এই উপস্থাপনায় আগেই বলেছি সাজ ( সাজ-পোশাক) এবং ঝাঁঝ ( যন্ত্রানুসঙ্গ ) কলকাতা থেকে নিয়ে আসা হত । প্রথমদিকে যে কয়টি দল দিল্লিতে যাত্রা করে আসছিলেন এই সময় দলের সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পায়, কেননা নাট্যদলগুলিও অধিক অর্থাগমের  আশায় যাত্রা করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন । বলা বাহুল্য যাত্রাভিনয়ের মূল বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণার কথা বা শিল্পনির্দেশনার তাত্ত্বিক আলোচনায় না গিয়েও বলতে পারি অভিনয়ের কয়েকটি মোটা দাগের সুত্র অবলম্বন করেই তাঁরা দর্শক সাধারণের মনোরঞ্জন করতেন এবং স্থানীয় পরিমন্ডলীতে খ্যাতনামা হয়ে উঠতেন । তবে এই প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ দিতেই হয়, কারণ কলকাতায় বা পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে দিল্লিবাসীর অনেকের পক্ষেই এই শিল্পস্বাদ গ্রহণ করা সম্ভব ছিল না  যা এই সুবাদে এখানেই তাঁরা পেয়ে যেতেন । তখনকার দিল্লির কয়েকটি প্রসিদ্ধ যাত্রাদলের নাম ও সেই দলের প্রধানদের নাম কালানুযায়ী উল্লেখ করার চেষ্টা করছি । যেমন, চেনা মহল ( ১৯৫৫ – অক্ষয় পাল ও পরেশ দাস ), শনিচক্র ( ১৯৫৮ – অমর হোড় ), শ্রীমতী অপেরা ( ১৯৫৯ – ফণি রায় ও সুবিমল ব্যানার্জী ), দক্ষিনী ( ১৯৬০ – রমণী মোহন সমাজদার ), অগ্রদূত ( ১৯৬৭ -পীযূষ রায় ও ডাঃ অভিজিৎ ভট্টাচার্য ), আদি শ্রীমতী অপেরা ( ১৯৬৯ – সুবিমল ব্যানার্জী ), কালকাজী বঙ্গীয় সমাজ ( ১৯৭৫), অঙ্গীকার ( ডাঃ অভিজিৎ ভট্টাচার্য, জহর কানুনগো, নিতাই সাহা ও অন্যান্যরা ), কালচক্র ( ১৯৮০ – অজয় চ্যাটার্জী ), ধূমকেতু ( ১৯৮০ – সিদ্ধার্থ দাশগুপ্ত ), আমরা ক’জন ( ১৯৮৯ – দেবব্রত সেন ) এবং ইত্যাদি ।

আজ এই নতুন জমানায় বহিরাগত শিল্পীদের কেনাবেচার দালালি প্রক্রিয়ায় পুজোর নাটক বা যাত্রা প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছে । তবে আশার কথা, তাতে দিল্লির বাংলা নাটকের নতুন চিন্তা ও প্রকাশের সুযোগ হয়েছে । বরংচ এখনকার দৃষ্টিভঙ্গীতে মৌলিকত্বের বিকাশ ও সৃষ্টিশীলতায় এক অভিনবত্বের প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ গড়ে উঠেছে । জানলে খুশি হবেন এবং দিল্লির সংস্কৃতি কর্মী হিসেবে আমি নিজেও গর্ববোধ করি যে আজ দিল্লিতে বাংলা নাটকের নতুন উৎসাহের জোয়ার এসেছে এবং নাট্যদলের সংখ্যা এখানে এখন অন্ততপক্ষে গোটা তিরিশেক । সবাই যে নিয়মিত অভিনয় করেন তা বলছি না,  তবে এখানে নানাধরণের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়, প্রতিযোগিতা হয়, বিশ্বনাট্যদিবস পালিত হয়,  যেখানে এঁদের অভিনয় আমরা দেখতে পাই ।  দিল্লিতে বাংলা নাটক ও সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রাখার যে বাস্তব সমস্যা সেটা কোন অভিজ্ঞতা সম্পন্ন মানুষ ছাড়া  বাইরে থেকে তা’ কেউ অনুধাবন করতে পারবেন না । এখানে হিন্দি আর ইংরাজীর সাথে নিয়মিত লড়াই করে টিঁকে থাকতে হয় । কলকাতার বাংলা সংস্কৃতি আর দিল্লির বাংলা সংস্কৃতি নিয়ে কোন আলোচনা উস্কে দেবার মানসিকতা নিয়ে একথা বলছি না , যদিও বাংলার বাইরে এমনকি বাংলাদেশের মানুষেরও অনেকের ধারণা যে ভারতের বাংলা সাহিত্য কেবল কলকাতাকেন্দ্রিক । এখানেই আমার মত অনেকেই প্রতিবাদে মুখর হবেন যে ভারতের প্রতিটি রাজ্যে যত বাংলা সাহিত্যের ও সংস্কৃতির চর্চা হয় সেটা ওয়েষ্টবেঙ্গলের তুলনায় ফেলনা নয় । যেভাবে স্রোতের উল্টোমুখে চলে তাঁরা মাতৃভাষা ও সংস্কৃতির সাধনা করেন সেটা মায়ের আঁচলের তলায় আদরে যাঁরা আছেন তাঁরা কল্পনাও করতে পারবেন না । তবুও আমরা গর্বিত, যথেষ্ট সুনামের সঙ্গে সর্ব্বভারতীয় ক্ষেত্রে দিল্লি এ ব্যাপারে অনেকটাই এগিয়ে ।

এত আলোচনা করেও একটি বিষয়ে আমি বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করছি – সেটি হল দিল্লির অভিনেতা এবং অভিনেত্রীদের নামের তালিকা প্রকাশের ব্যাপারে ।  একদিকে এই তালিকা যেমন দীর্ঘ ও প্রতিনিয়ত ক্রমবর্ধমান,  সুতরাং সে তালিকায় ভুল ভ্রান্তি অথবা অনুল্লেখের অপরাধ হয়তো আমাকে গিলে খাবে – এটা যেমন সত্যি,  অন্যদিকে আমার পূর্ব অভিজ্ঞতা আমাকে এ বিষয়ে অত্যুৎসাহী হতে বাধা দিচ্ছে  । একটু খুলেই বলি —  দিল্লির পাঠক ও সাংস্কৃতিক কর্মীরা আমার আগের একটি নিবন্ধে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নামের তালিকায় তাঁদের শ্রেষ্ঠত্বের হিসাব খোঁজার ভয়ে সজ্ঞানে সেটিকে বর্ণানুক্রমিক সাজিয়েছিলাম, তা’তেও যা বিপদ ঘটলো সেটা অচিন্তনীয় !  অনেক প্রসিদ্ধ ব্যক্তির নাম তাঁদের পিতৃদত্ত নামের বানানের অনুসারে পিছনে চলে যাওয়াতে – সেটাও নাকি আমার অপরাধ ! ফতোয়া জারী হল, এমন মর্যাদাহানিকর নিবন্ধ নাকি আমার লেখা উচিত হয় নি  ।   যথারীতি শূলে চড়ার ভয়ে, এবারে অন্য তালিকাতেও কিছুটা এমন শংকা থাকলেও, বৃহৎ তালিকাতে আর সেই  সংশয় বাড়াতে চাই না । তাই আর সেই তালিকা প্রকাশ করা গেল না  ।

এবারে যে বিষয়টি উল্লেখ করতে চাই তার বিশিষ্টতা একটু ভিন্ন ধরণের । আজকের দিনে ব্যাপারটা অবাস্তব মনে হলেও হতেও  পারে, তবুও বাস্তব বা ইতিহাসকে তো অস্বীকার করা যাবে না ।  আগের দিনে ঘরের মেয়েদের বাইরে এসে ছেলেদের  পাশাপাশি অভিনয় করার রেওয়াজ ছিল না বা সেটাকে ভাল চোখে দেখাও হত না । তাই বাধ্য হয়ে অনেক সময় ছেলেদেরই মেয়ে সেজে অভিনয় করতে হতো । পরে অবশ্য এই ব্যাপারটাকে একটা শিল্প সৌষ্ঠব বলে মেনে নেওয়া হয়েছে । তাই অনেক  পুরুষ অভিনেতা মেয়ে সাজার ব্যাপারে এবং মহিলা চরিত্রে অভিনয়ের ব্যপারে যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেছেন । এখানে আমি তাঁদের একটি  তালিকা উল্লেখ করছি যাঁরা দিল্লির মঞ্চে যথেষ্ট সুনামের সঙ্গে মহিলা চরিত্রে অভিনয় করেছেন । তিরিশ ও   চল্লিশের দশকে আমরা পেয়েছি – অমর দত্ত, দীনেশ গুহ ও শৈলেন চ্যাটার্জীকে এবং পরবর্তীকালেও আমরা পেয়েছি – গঙ্গা গুহ, গোপাল দাস, প্রতাপ সেন, মণি মুখার্জী, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, মিহির দে, শিবপ্রসাদ রায়চৌধুরী ও সুবিমল ব্যানার্জীর মত শিল্পীদের ।

নাট্য পরিচালনার ব্যাপারে যাঁদের অবদান অনস্বীকার্য তাঁদের নাম হয়তো আগেই উল্লেখ করা উচিত ছিল , কেননা একটি নাটকের প্রাথমিক ভাবনা চিন্তা থেকে শুরু করে তার পূর্নাঙ্গ রূপায়ণ পরিকল্পনা, এমনকি কলাকুশলীদের শিখিয়ে পড়িয়ে মঞ্চ পর্যন্ত এগিয়ে দিতে যে মানুষটি পিছনে থেকেই কাজ করেন তাঁর নাম পিছনে এলেও তিনি একজন অগ্রগণ্য মানুষ । সেই রকম কয়েকজনের নাম উল্লেখ করা নিতান্ত কর্তব্য যাঁরা পরিচালক হিসেবে যথেষ্ট সাফল্য লাভ করেছেন — যেমন, অঞ্জন কাঞ্জিলাল, অনিল ঘোষ, অলক চট্টোপাধ্যায়, ডঃ অভিজিৎ ভট্টাচার্য, অমর হোড়, বিশ্বজিৎ সিন্‌হা , কালীপদ ঠাকুর, কাশীনাথ রাহা, গৌতম সেনগুপ্ত, জ্যোতিরিন্দ্র চক্রবর্তী, জয়ন্ত দাস, তড়িৎ মিত্র, দেবব্রত সেন, পরেশ দাস, ডঃ পুতুল নাগ, প্রতাপ সেন, প্রফুল্ল বন্দ্যোপাধ্যায়, ফুল কুমার সেন, বাপী বোস, বিনয় রায়, বীরেন বিশ্বাস, রবিশংকর কর, রবীন ভট্টাচার্য, রমণী মোহন সমাজদার, রাধানাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, শক্তি মুখার্জী, শমিক রায়, শ্যামু গাঙ্গুলী, শিশির বসু, শিশির ভট্টাচার্য, শুদ্ধসত্ত্ব ব্যানার্জী, শৌভিক সেনগুপ্ত, সিদ্ধার্থ দাশগুপ্ত, সুবিমল ব্যানার্জী, স্বপন ঘোষ এবং আরও অনেকে  ।

যে পরিচালকদের কথা এতক্ষণ বলছিলাম তাঁরাও কিন্তু সেই কাজের সফল পরিবেশনায় নানা রকম কারিগরি সহযোগিতার ওপর নির্ভরশীল। আর এই কারিগরি কাজগুলি হল – মঞ্চ, আলো, পোশাক, রূপসজ্জা, আবহ-সঙ্গীত ইত্যাদি । সেই কাজে নিযুক্ত দিল্লির কয়েকজন গুণী  শিল্পীরা হলেন –

১) মঞ্চ পরিকল্পনা ও রূপায়ন – অজিত দত্ত, কাশীনাথ রাহা, খালেদ চৌধুরী, গৌর গুপ্ত, সুদীপ বিশ্বাস, হরিহর ভট্টাচার্য ।

২) আলোক সম্পাত  –  অজয় ভট্টাচার্য, তাপস সেন, ডঃ প্রবাল সেন, বিমল শেঠ, মুক্তি  চ্যাটার্জী, সিতাংশু মুখার্জী, সুশীল  চৌধুরী, সৌমিত্র দাশগুপ্ত ।

৩) রূপসজ্জা  – শঙ্কর সান্যাল, শচীপতি ভট্টাচার্য, শিশির ভট্টাচার্য, শুভাশিস ব্যানার্জী,  সুশীল মিত্র,  দিলীপ চক্রবর্তী ।

৪) সঙ্গীত পরিচালনা ও আবহ সঙ্গীত  –  কাজল ঘোষ, কৃষ্ণ কুমার ভট্টাচার্য, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র (বটুক দা’), ব্যোমকেশ ব্যানার্জী, মণি গুহ, মন্টি অধিকারী, সুশীল দাশগুপ্ত, শুভাশিস, মিহির বসু  ।

 

এর আগেই আমি বলেছি যে দিল্লির নাট্য উপস্থাপনা শুরু হয়েছিল কলকাতার পরিচিত তথা বিখ্যাত নাটকগুলি দিয়ে । পরে অবশ্য তাঁরা বুঝেছিলেন যে নিজেরা নাটক লিখে পরিবেশনার আনন্দ কতখানি । সেই ভাবনা চিন্তা থেকে আজকের দিল্লি কিন্তু  অনেক নাট্যকারের জন্ম দিয়েছে । নিজেদের সাহিত্যচিন্তা ও নাটক লেখার মধ্য দিয়ে যাঁরা দিল্লিতে সফল নাট্যকার হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছেন তাঁরা হলেন – অমর হোড়, অলক চট্টোপাধ্যায়, জগদীশ চক্রবর্তী, জগন্নাথ ব্যানার্জী, তড়িৎ মিত্র, তাপস চন্দ, দিলীপ কুমার বসু, দীপক ঘোষ, ডঃ পুতুল নাগ, প্রশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়, ডাঃ ফনি বসু (পরাশর), বিশ্বজিৎ সিনহা, ব্রজেন ভৌমিক, ভবানী সেনগুপ্ত (চাণক্য সেন), মধু বন্দ্যোপাধ্যায়, লোকনাথ রায়, ডঃ শিশির কুমার দাশ, শৌভিক সেনগুপ্ত, সেবাব্রত চৌধুরী, সুমনা কাঞ্জিলাল, স্মরজিৎ দত্ত, হরিহর ভট্টাচার্য এবং আরও অনেকে । এখানে উল্লেখনীয় যে এই নাট্য রচনার সবই যে মৌলিক তা’ অবশ্যই নয়, কারণ  এতে রয়েছে অনুবাদ, ভাবানুবাদ, অনুসরণ বা অবলম্বন ইত্যাদিও ।

1.AMRA KOJON- Kaal Sandhyay

‘আমরা ক’জন’  নাট্যদলের  “কালসন্ধ্যায়”- নাটকের দৃশ্য

এরপরের কাজটি যাঁরা করেন অর্থাৎ নাট্য-পরিবেশনার ভাল মন্দ, ভুল ত্রুটি ইত্যাদি নিয়ে যাঁরা কথা বলেন সেই মানুষগুলিকে   আমরা নাট্যসমালোচক বলে চিনি ।  এঁরা অভিনয়ের সঙ্গে নিজেদেরকে ওতপ্রোতভাবে জড়িত না রেখেও নিজের অভিজ্ঞতা ও  দর্শকের চোখ দিয়ে একটি নাটককে পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়ে তার বিচার করেন তথা অবলোকন করেন তার গুণাবলী এবং সেই নজরেই প্রকাশ করেন তাঁর লেখনী বা বক্তব্যের মাধ্যমে এই শিল্পের প্রকৃত ভাল মন্দের বাস্তবতা ।  এই সব মানুষেরাই কিন্তু এই শিল্পের শেকড়কে উপযুক্ত গভীরে পৌঁছে দিতে সাহায্য করেন ।  দিল্লিতে এমন নাট্যবিশ্লেষক মানুষদের মাত্র কয়েকজনের কথাই আমি  বলতে পারি, যাঁরা হলেন – উৎপল ব্যনার্জী, দেবু মজুমদার, পৃথ্বীরাজ রায়-এর মত পন্ডিতজন ।  বাংলা নাটকের এই বিশ্লেষকদের কাছে দিল্লির বাঙালি বিশেষভাবে ঋণী । এঁদের এই নাট্য বিষয়ক পাণ্ডিত্য শুধু যে নাট্য পরিচালকদের পথ নির্দেশ দিয়ে থাকে তাই নয় সাধারণ দর্শকও যথেষ্ট প্রভাবিত হন ।  শুধু এঁরাই নন, অভিজ্ঞতা সম্পন্ন আরও অনেকেই এই বিশ্লেষণের কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পছন্দ করেন এবং তাঁরা নামের বা পরিচিতির অপেক্ষা না করে নিজেদের ভালো লাগার তাগিদেই ভারতের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় আলোচনা বা সমালোচনা প্রকাশ করে থাকেন ।  অনেক পরিচালক আবার  এই সমালোচনাকে সুস্থ  নজরে  গ্রহণ করতে পারেন না বা অগ্রাহ্য করেন নিজের আত্মবিশ্বাসের মুগ্ধ অহংকারে ।  ফলে দর্শক সাধারণ অনেক সময়েই বিভ্রান্ত হন পরিচালকের বিভিন্ন রকম প্রচারমুখী ঢক্কা-নিনাদে ।  যাইহোক এ কথা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই যে সত্য ও সুন্দর কেবল শিবের রূপকেই প্রকাশ করবে – তা সে আজ বা কাল যখনই হোক না কেন, কিছুটা সময়ের ব্যবধান হয়তো আমাদের চেতনাকে আচ্ছাদিত করে রাখবে কিন্তু আলোর প্রকাশ অবশ্যম্ভাবী ।

বাংলা নাটকের কথা বলতে গিয়ে আরেকটি বিষয় উল্লেখ করতেই হয় যে দিল্লিতে কলকাতার মত নিয়মিত  অভিনয় করার  সুযোগ খুবই কম । কারণ মূলত দু’টি – প্রথমত দিল্লির মিশ্র সামাজিক পরিবেশে বাংলা নাটকের ব্যবসায়িক স্থান নিতান্ত নগণ্য এবং দ্বিতীয়ত সেই প্রথম কারণের ভিত্তিতেই বিপ্রতীপ সাংস্কৃতিক আন্দোলনের জন্য কর্মমুখর ও কর্মকুশল দিল্লির পরিবেশে শুধু নাটককে ভালোবেসে নিজের ব্যক্তিমূল্যকে কয়জন কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে পারেন, সেটাই সমস্যা । তবুও অনিয়মিত প্রযোজনার ভালোবাসা থেকেই দিল্লির এতগুলি নাট্যদল কাজ করে যাচ্ছেন নিজেদের গাঁট খরচ করেও । সেটাও আজ প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে উপযুক্ত প্রেক্ষাগৃহের অভাবে । যে কয়টি প্রেক্ষাগৃহ আছে সেগুলির মহার্ঘ মূল্য বাঙালি যোগাতে পারেন না , যা হয়তোবা হিন্দি অথবা অন্য ভাষাভাষীরা কিছুটা পারেন তাঁদের ব্যবসায়িক প্রস্তাবনায় । আমার পরিচিত পরিবেশে চিত্তরঞ্জন পার্কে ‘বিপিন চন্দ্র পাল প্রেক্ষাগৃহ’ রয়েছে যা কারিগরি দিক থেকে গ্রহণযোগ্য হলেও প্রশাসনিক সমস্যার কারণে সেখানে নাটক মঞ্চস্থ করা বেআইনি ঘোষিত হয়েছে, ফলে সেটি অনিশ্চিতকর অবস্থায় রয়েছে । ইদানিং পরিবেশ কিছুটা সহজ হয়েছে হয়তো, তাই মাঝে মাঝে নাটক মঞ্চস্থ হতে দেখছি । অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উদ্যোগ-ধন্য গোলমার্কেট অঞ্চলের ‘মুক্তধারা’ প্রেক্ষাগৃহ, যেটি বর্তমানে কোন বাঙালি আবাসনের কাছাকাছি না হওয়াতে সেখানে অন্যান্য অঞ্চল থেকে   নিয়মিত পৌঁছানো বেশ অসুবিধাজনক ও খরচসাপেক্ষ ।  ভালোবাসার দাবি নিয়ে সেখানে পৌঁছুলেও সেই মঞ্চে অভিনয় করা যে কতটা অসুবিধাজনক তা কেবল ভুক্তভোগীরাই বোঝেন । মঞ্চের সীমিত আয়তন অর্থাৎ দৈর্ঘ-প্রস্থের স্বল্পতা, মঞ্চের পিছনে চলাচলের উপযুক্ত পথ এবং উইংসের পাশে প্রয়োজনীয় স্থান-সংকুলানের নিতান্ত অভাব, মঞ্চের কাছাকাছি গ্রিনরুম না থাকার অসুবিধা,  দূরগত গ্রিনরুম থেকে মঞ্চে পৌঁছুবার দুর্গতি, মঞ্চের কাছাকাছি পুরুষ বা মহিলা প্রসাধনাগারের অভাব ইত্যাদি বহুবিধ কারণে  সেটিকে কেবল একটি সামাজিক মিলন ক্ষেত্র বলা গেলেও নাটকের উপযুক্ত মঞ্চ  কিছুতেই বলা চলে না । বোঝা যায় এটির পরিকল্পনায় প্রেক্ষাগৃহ সম্পর্কিত অভিজ্ঞতা সম্পন্ন বাস্তুবিদ এবং দায়িত্বে থাকা কর্ণধার – তাঁদের কেউই এ ব্যাপারে যত্নবান ছিলেন না ।  তবুও ইংরাজি প্রবাদ অনুযায়ী ভিখারীর কোন পছন্দের তারতম্য থাকতে নেই বলেই আজ আমাদের মত দিল্লির বাঙালিকে সেখানে  দুধের  স্বাদ ঘোলেই মেটাতে হয় ।Full House Show at MUKTADHARA.

 মুক্তধারা প্রেক্ষাগৃহের একটি দৃশ্য

নানা কারণে বাংলা নাট্যপ্রেমিদের চিরকালই সারা দিল্লিতে নানা জায়গায় দৌড়ে বেড়াতে হয়েছে । আগে তো কোন নির্দিষ্ট হলই ছিল না – হোটেল বা ক্লাবের হলগুলিতেই নাটকের আয়োজন হত, যেমন –  ওয়েভেল থিয়েটার ( হোটেল ইম্পিরিয়াল), পৃথবী থিয়েটার (রিগ্যাল সিনেমা ),  YMCA – ম্যাসই হল, তালকোটরা হল, সাউথ ইন্ডিয়া ক্লাব ( বর্তমান – সত্যমূর্তি ) ইত্যাদি । এরপর কিছুটা স্বপ্নপূরণ হয়, যখন – সপ্রু হাউস অডিটোরিয়াম, ফাইন আর্টস থিয়েটার (AIFACS ) অডিটোরিয়াম, গান্ধী মেমোরিয়াল হল, ত্রিবেণী কলা সঙ্গম প্রেক্ষাগৃহ, কামানী অডিটোরিয়াম, শ্রীরাম সেন্টার অডিটোরিয়াম, লিটল থিয়েটার গ্রুপ (LTG ) হল, মবলঙ্কার হল, জাতীয় নাট্য বিদ্যালয় ( NSD ) প্রেক্ষাগৃহ । এ ছাড়াও বেসরকারী উদ্যোগে দিল্লিতে তৈরি হয়েছে আরও কয়েকটি প্রেক্ষাগৃহ কিন্তু সে সবের জন্য যে অর্থমূল্য দিতে হয় তা’ অপেশাদারি সংস্থার নাগালের বাইরে ।  বাঙালিকে তাই পূজাপ্যান্ডেল অথবা নাট্য-প্রতিযোগিতার জন্যই অপেক্ষা করতে হয় । সেখানেও আজ পরিবর্তনের ছোঁয়া – দিল্লির দুর্গাপূজার আয়োজকেরা এখন কলকাতা বা মুম্বাইয়ের গানবাজনা এবং অন্যান্য চটুল জনপ্রিয় প্রোগ্রামের দিকেই বেশি মনোনিবেশ করেছেন, যদিও সেসবই এখন পেশাদার মধ্যপদলোভী দালালদের আয়ত্বাধীন এবং অর্থবহ যোগাযোগের ভিত্তি-নির্ভর ।  সুতরাং এখনকার বাঙালি নিজেরাই উৎসাহ নিয়ে মাঝে মাঝে যা কিছু আয়োজন করে থাকেন, তা সেই ‘মুক্তধারা’ প্রেক্ষাগৃহেই ।

দিল্লিতে নাট্যচর্চার উৎসাহের আরেকটা দিক হল নাট্য-প্রতিযোগিতা । যাঁরা নাট্য-প্রতিযোগিতার আয়োজন করেন  তাঁদের মধ্যে নিউদিল্লি কালীবাড়ির নাম অগ্রগণ্য সে কথা আগেই উল্লেখ করেছি । সেটা শুরু হয় ১৯৬০ সাল নাগাদ  আর ১৯৬৮ সালে তা সর্বভারতীয় প্রতিযোগিতা হয়ে ওঠে । পরে অবশ্য এটি নানা কারণে বন্ধ হয়ে যায় । সুখবর এই যে, গত সাত বছর ধরে নিউদিল্লি কালীবাড়ির আয়োজক সংস্থা আবার নতুন করে স্বল্পদৈর্ঘের বাংলা  নাট্য-প্রতিযোগিতা চালু করেছেন । এ ছাড়া মিলনী ক্লাবেও বাংলা নাট্য-প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছিল যা’ দীর্ঘস্থায়ী  হয় নি ।  ইতিহাসের পাতায় লেখা থাকবে বেঙ্গল এসোসিয়েশন, নিউদিল্লি কালীবাড়ি ও অল ইন্ডিয়া ফাইন আর্টস এন্ড ক্র্যাফট সোসাইটির উদ্যোগে ১৯৯০ সালের জুন মাসে দিল্লির আইফ্যাক্স হলে সাতদিন ধরে এক বাংলা নাট্যোৎসবের আয়োজন করা হয়েছিল  । চিত্তরঞ্জন পার্ক কালী মন্দির সোসাইটির উদ্যোগে ২০০৭ এবং ২০০৮ সালে বাংলা যাত্রা অভিনয়ের পুনরুত্থানের  চেষ্টায় এক উৎসবের আয়োজন করা হয়, কিন্তু তা’ দীর্ঘজীবি বা সুদূর প্রসারী হয় নি । এই ভাবে টুকরো টুকরো ইতিহাসের পাতা হাতরেই দিল্লির নাট্যপ্রেম এখনো জাগ্রত ।  দিল্লির বাইরে আমরা দেখি লখনৌ বেঙ্গলী ক্লাবের আয়োজনে পূর্ণ দৈর্ঘের সর্বভারতীয় বাংলা নাট্য প্রতিযোগিতা এবং এলাহাবাদ ও কানপুরেও স্বল্পদৈর্ঘের বাংলা নাট্য প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়  যেখানে দিল্লির নাট্যদলেরা নিয়মিত অংশ নেন এবং বহু পুরস্কারও পেয়েছেন বহুবার ।4. AAKRITI- Dayabaddha

‘আকৃতি’  নাট্যদলের  ‘দায়বদ্ধ’ নাটকের দৃশ্য

অন্যদিকে ‘বেঙ্গল এসোসিয়েশন’-কে ধন্যবাদ জানাতে হয় তাঁদের বর্তমান প্রচেষ্টার জন্য, যেখানে নানা ধরণের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজনের মধ্য দিয়ে তাঁরা ইদানীং দিল্লির বহু সাংস্কৃতিক সংগঠন ও নাট্যদলকে এই মঞ্চে নিয়ে আসছেন এবং সুযোগ করে দিচ্ছেন দিল্লিতে বাংলা সংস্কৃতির উন্নয়ন প্রকল্পে সামিল হতে । বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয় তাঁদের সারাদিনব্যাপী ‘বিশ্বনাট্যদিবস’ উদযাপনের মাধ্যমে প্রতি বছর দিল্লির অন্তত ২৫-৩০টি নাট্যদলের স্বল্পদৈর্ঘের নাট্য উপস্থাপনার সুযোগ করে দেওয়াকে । এই উৎসাহ  সারা দিল্লিতে এক নাট্য-জোয়ার এনেছে এ কথা বলাই যায় ।

‘বেঙ্গল অ্যাসোসিয়েশন ইদানিং আরেকটি শুভ প্রচেষ্টা চালু করেছেন । প্রতিমাসের কোন এক নির্দিষ্ট দিনে এক-একটি নাট্যদলকে আহ্বান জানাচ্ছেন মুক্তধারায় নাটক পরিবেশন করতে এবং সেখানে সংগৃহীত অনুদানের টাকা দুঃস্থ শিল্পীদের সাহায্যার্থে ব্যবহারের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে ।

এখানে এই দিল্লিতে নাট্যশিল্পকে যে ভাবে শ্রদ্ধা জানানো হয়, বলতে পারি তার উদাহরণ সারা ভারতে সত্যিই আদর্শ-স্থানীয় । উল্লেখ্য, ভারতের বিভিন্ন স্থানে মঞ্চ বা ফিল্মের জন্য নাট্যশিক্ষার বেশ কয়েকটি  কেন্দ্র রয়েছে যার কিছু সরকারী ও কিছু বেসরকারী এবং কিছু পুরোনো ও কিছু নতুনও, যেমন– রাষ্ট্রীয় নাট্য বিদ্যালয় ( দিল্লি), ফিল্ম এন্ড টেলিভিশন ইনস্টিট্যুট ইন্ডিয়া (পুণে), রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় (কলকাতা) , ভারতেন্দু একাডেমি অব ড্রামেটিক্স আর্ট ( লখনৌ) , দ্য বেরী জন অ্যাক্টিং স্টুডিও (দিল্লি ও মুম্বাই), অনুপম খেরস্‌ অ্যাক্টর প্রিপেয়ারস্‌ (মুম্বাই), হুইস্লিং উড ইন্টারন্যাশনাল (মুম্বাই), এশিয়ান একাদেমী অব ফিল্ম এন্ড টেলিভিশন (নয়ডা), রোশন তানেজা স্কুল অব অ্যাক্টিং (মুম্বাই), সেন্টার ফর রিসার্স ইন আর্ট অব ফিল্ম এন্ড টেলিভিশন (দিল্লি), কিশোর নমিত কুমার অ্যাক্টিং ইনস্টিট্যুট (মুম্বাই), আর কে ফিল্ম এন্ড মিডিয়া একাডেমি (দিল্লি)।  এই সমস্ত জায়গায় বিভিন্ন ভাষায় ( বাংলা, হিন্দি ও ইংরাজী) অভিনয় শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে আজকের প্রজন্ম যা’ অনেক আগের দিনে ছিল না বললেই চলে ।’

দিল্লির নাটক নিয়ে কথা বলার প্রসঙ্গে ‘শেষ হয়ে হইল না শেষ’ কথার মত উপসংহারে উল্লেখ করতে চাই দিল্লির  ‘শ্রুতি নাটক’-এর কথা । এর ইতিহাস খুব পুরোনো না হলেও আমাদের জ্ঞানত সেও প্রায় ৩৭ বছর আগের কথা । গবেষকেরা কি বলবেন জানি না, তবে ১৯৭৭ সালের আগে দিল্লিতে কোন ‘শ্রুতি নাটক’হয়েছে বলে শুনি নি ।  অবশ্য ‘শ্রুতি নাটক’- এই শব্দটারই প্রকৃতপক্ষে জন্ম হয় নি তখন ।  তাই দিল্লির ‘প্রাংশু’ সাহিত্য পত্রিকার প্রযোজনায় সম্পাদক শশাঙ্ক শেখর মুখোপাধ্যায়ের উৎসাহে এই অধমের ওপর দায়িত্ব পড়ে  ‘রামচন্দ্রের দাড়ি’ – এই প্রহসনটি মঞ্চায়নের, যেটি লিখেছিলেন ডাঃ ফণী বসু (পরাশর) ।  ১৯৭৭ সালে ( ১৩৮৪ বঙ্গাব্দে)  চিত্তরঞ্জন পার্কের সি-ব্লকের মাঠে (এখন যেখানে প্রতি বছর সার্বজনীন কালী পূজা অনুষ্ঠিত হয় ) ‘রেডিও ড্রামা’-র কায়দায় মঞ্চে বসে দর্শকদের সামনে পরিবেশিত হয় এই প্রহসনটি । অভিনয়ের সাথে সাথে দর্শকদের উপস্থিতিতেই সমস্ত রকম শব্দ  সংযোজন ও তার যান্ত্রিক কৌশল নাট্য অনুষঙ্গে সর্বসমক্ষে করে দেখানো হয় । যেমন, খড়ম পায়ে চলা মানে দুটি কাঠের টুকরার ঠোকাঠুকি ; কড়া  নাড়ার শব্দ হচ্ছে দুটি লোহার টুকরো দিয়ে, চিঠির খাম ছেঁড়া ছচ্ছে পুরোনো খবরের কাগজ ছিঁড়ে ইত্যাদি ইত্যাদি এবং এগুলি ঘটবে অন্যান্য অভিনেতাদের হাতেই, যাঁরা সবার সামনেই মাইকের কাছে হাত বাড়িয়ে শব্দ সৃষ্টি করবেন ।  কণ্ঠ ও হাতের কৌশলেই নানান  শব্দ প্রক্ষপনের সামগ্রিক পরিবেশনায় উপস্থাপিত হয়েছিল সেদিনের  ‘রেডিও ড্রামা’- ‘রামচন্দ্রের দাড়ি’ প্রহসনটি । অভিনব এই  প্রয়োগ কৌশলকে সকলেই খুব আশ্চর্যজনকভবে উপভোগ করেছিলেন সেদিন ।  আজকের দিনে শব্দ রেকর্ডিং-এর নানান  প্রযুক্তির যুগেও সেই রেডিও-তে অদেখা শব্দ প্রক্ষেপণ মঞ্চে দেখতে মানুষকে বেশ নস্টালজিক করে তুলবে সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই ।  সেদিনকার পরিবেশনায় অভিনয়াংশে নিয়েছিলেন – ডাঃ ফণী বসু, ডাঃ মণি রায়, অরুণ চক্রবর্তী, মিহির রায়চৌধুরী, বিমান দাস ( আর্ট কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ ), শৈলেন সাহা এবং আরও অনেকে । পরবর্তীকালে দিল্লিতে আরও শ্রুতি নাটক পরিবেশিত হয়েছে, এমনকি সাহিত্যিক চাণক্য সেন মহাশয়কেও সেই পরিবেশনার ওপর মন্তব্য করতে দেখা গেছে ।  এ বিষয়ে এই অধমের সুযোগ হয়েছিল তার প্রত্যুত্তরে ‘শ্রুতি নাটক’ প্রসঙ্গে আজকের অক্ষমতার কথা তুলে ধরতে যেখানে স্পষ্টত বলা হয়েছে যে এই শিল্পের ফাঁকিবাজিটাই প্রধান হয়ে উঠেছে যেখানে  মুখস্ত করার প্রয়োজন নেই বলেই ভাবা হয়, ফলে শিল্প মাধুর্যও অনেক ক্ষেত্রে উপেক্ষিত থেকে যায় । এই পরিবেশনায় স্বরক্ষেপণ ও নাটকীয়তার মূল্যবোধ অনেকাংশে অবহেলিত হয় । প্রকৃতপক্ষে শিল্পমূল্যের জন্য যে দায়বদ্ধতা এই ‘শ্রুতি নাটক’ দাবি করে  সে বিষয়ে জ্ঞানের   সংকীর্ণতাই এই পরিণাম ও দর্শক-হতাশার মূল কারণ । দিল্লিতে আরও কয়েকটি ‘শ্রুতি নাটক’ করার খবর আমরা জানি, যেমন  দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন মেমোরিয়াল সোসাইটির প্রযোজনায় সন্তোষ ঘোষ লিখিত মহাপুরুষদের জীবনীভিত্তিক শ্রুতি নাটক অনেকবার পরিবেশিত হয়েছে ।  চিত্তরঞ্জন  পার্ক বঙ্গীয় সমাজের শিল্পীরাও অনিয়মিতভাবে পরিবেশন করেছেন বেশ কয়েকটি শ্রুতি নাটক ।  এ ছাড়াও ১৯৬১ সালের ১৯শে মে, শিলচরের মাতৃভাষা আন্দোলনে এগারজন শহিদের স্মৃতিকে সম্মান জানাতে দিল্লিতে  ২০০৬ সালে প্রথমবার একমাত্র মহিলা ভাষা শহিদ ‘কমলা’-র নামাঙ্কিত ‘কমলা’ শ্রুতি নাটকের যে উপস্থাপনা হয়  তা’ শ্রোতা-দর্শকদের অশ্রুভারাক্রান্ত করে তোলে ।  নাটকটির রচনা ও পরিচালনা  এই অধম শৈলেন সাহা-র । পরে আরও দু’তিন বার দিল্লিতে অভিনয় করা ছাড়াও খোদ শিলচরের মানুষ তাঁরাও এই নাটকটির প্রতি আনুগত্য দেখিয়েছেন । যে শিলচর রেল স্টেশনে এই অঘটনের পরিপ্রেক্ষিতে মাতৃভাষার সম্মানের দাবিতে এগারজন শহিদ হয়েছেন সেই রেল স্টেশনেই ১৯শে মে’র বাৎসরিক অনুষ্ঠানে কয়েক বছর আগে এই নাটক মঞ্চস্থ করা হয় । এ ছাড়াও সেখানকার অন্যান্য ক্লাবেও বেশ কয়েকবার এই নাটকের মঞ্চায়ন হয়েছে । এমনকি ২০১৩ সালের ১৯শে মে তারিখে এই নাটকটি শিলচর বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হয় এবং ২০১৪ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি ত্রিপুরার আগরতলায় ভাষা শহিদদের স্মরণে এই নাটকটির উপস্থাপনা আবেগমথিত দর্শকদের কাছে অসম্ভব প্রশংসা লাভ করে । ২০১৫ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারীতে শিলচরের শহিদ স্মৃতি কমিটি ‘১৯শের কথা নিয়ে ২১শের দেশে’ এমন একটি  শ্লোগান নিয়ে  বাংলাদেশের সিলেটে গিয়েছিলেন সেখানকার ভাষা দিবসের  অনুষ্ঠানে অংশ নিতে । সেই আয়োজনের প্রধান উদ্যোগক্তা  শিলচরের মানুষ ডাঃ রাজীব কর দিল্লিতে এসে আমাকে আমার সেই ‘কমলা’ শ্রুতি নাটকের কথা উল্লেখ করে জানালেন যে সেখানেও এই নাটক তাঁরা করেছেন এবং লোকেদের ভাল লেগেছে ।   এইসব ঘটনা আমার নিজের কাছে যথেষ্ট মূল্যবান তো বটেই, তা’ ছাড়াও একজন বাংলা সাহিত্যসেবী হিসেবে দিল্লিতে বসে লেখা এই নাটকের আকর্ষণ ও সম্মানকে আমি দিল্লির সম্মান বলেই মনে করি ।

এইসব মিলিয়ে দিল্লির বাঙালি হিসেবে যথেষ্ট গর্বের সঙ্গে বলতে চাই যে এই আলোচনা যদি আপনাদের মনে দিল্লির বাঙালি ও তাঁদের বাংলা-প্রীতি সম্পর্কে কিছুটা হলেও একটা ছাপ রেখে যেতে পারে তবে সেটাই হবে আমার চরম সাফল্য । আশাকরি আগামী দিনের গবেষকেরা দিল্লির বাঙালি ও তাঁদের বাংলা সাহিত্য, সংস্কৃতি ও নাট্যপ্রেম সম্পর্কে আরও অনেক বেশি তথ্য সংগ্রহে উৎসাহিত হবেন এবং এই ব্যাপারে অর্থাৎ দিল্লির বাঙালি ও বাংলা নাট্য-পরিবেশ নিয়ে ইতিহাসে যথেষ্ট মূল্যবান সংযোজন ঘটাতে পারবেন । আমরা বৃহৎবঙ্গের বাঙালিরা ইচ্ছা করলে একসাথে এমন নাট্য-আন্দোলন তথা সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তুলতে পারি যাতে দিল্লি শুধু ভারতের রাজনৈতিক রাজধানী হিসেবে নয়, বাংলা সাংস্কৃতিক রাজধানী হিসেবেও পরিচিত হয়ে উঠতে পারে  আগামির  ইতিহাসে, এ আমাদের স্বপ্ন ।  সমগ্র বিশ্বের বাঙালি আজ তাই কবির সঙ্গে কন্ঠ মিলিয়ে নিজের  মাতৃভাষায় বলে উঠুক — ‘ভারত আবার জগত সভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে’  ।

 

লেখক : Sailen Saha

পাঠক সংখ্যা : 761 জন

প্রকাশ তারিখ : Tuesday, October 27, 2015

রচনা বিভাগ : প্রবন্ধ

গড় প্রতিক্রিয়া :



Similar Contents

আমার প্রথম প্রবন্ধ

লেখক : পীযূষকান্তি বিশ্বাস | প্রকাশ তারিখ : Friday, December 22, 2017 | রচনা বিভাগ : প্রবন্ধ

বিশ্বনাগরিক ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস

লেখক : মিঠুন চাকমা | প্রকাশ তারিখ : Monday, November 30, 2015 | রচনা বিভাগ : প্রবন্ধ

বাংলা নাট্য আন্দোলন ও দিল্লি

লেখক : Sailen Saha | প্রকাশ তারিখ : Tuesday, October 27, 2015 | রচনা বিভাগ : প্রবন্ধ

কল্পনা, কাল্পনিক অভিজ্ঞতা, বাস্তব ও কবিতার সাদা পাতা

লেখক : দিলীপ ফৌজদার | প্রকাশ তারিখ : Tuesday, October 20, 2015 | রচনা বিভাগ : প্রবন্ধ
From same author

বাংলা নাট্য আন্দোলন ও দিল্লি

লেখক : বাংলা নাট্য আন্দোলন ও দিল্লি | প্রকাশ তারিখ : Tuesday, October 27, 2015 | রচনা বিভাগ : প্রবন্ধ
আপনি আপনার নিজস্ব পত্রিকা বের করুন, যতখুশী সংখ্যা বের করুন, যতখুশী লেখকদের এক জায়গায় স্থান দিন, সোশাল মিডিয়াতে শেয়ার করুন !
আপনার পছন্দের ভাষা : [ English ] ভাষা পরিবর্তন করুন : [ English | বাংলা . ]

আরো লিংক : Home | About | Contact US | Term & Conditions | Privacy | Clear cache


© ২০১৪ , আই পত্রিকা, জেনটেলিসেন্স ইঙ্ক !