অন্ন 

দেবাশিস সাঁতরা



1

মনেপড়ে সে সব স্মৃতি ?
তোমাকে দু-মুঠো পাবার জন্যে, অন্ধকারে দীর্ঘ লাইন
আকাশে যুদ্ধের সাইরেন ডেকে যায়
অবাক চোখে দেখি শুভ্র শরীরে তোমার আজও অশনিসংকেত, দেশ ভাগের গ্লানি
তবু তোমার অপাপবিদ্ধ সৌরভে দুলে ওঠে 
আশৈশব 
মনেপড়ে যায় সোনালী দিনগুলোর কথা

সকাল সাড়ে সাতটা, ব্যাস্ত হাতে বাবাকে ভাত বেড়ে দিচ্ছেন মা
আমি খেলতে খেলতে বর্ণমালা থেকে ঝুকে পড়েছি গরম ভাতের থালায়
একটু ঘি, নুন ও কাঁচালঙ্কা সহযোগে ধোঁয়াওঠা ভাতের গন্ধ
কী অপূর্ব সৌরভ ! বাবা খেতে খেতে ঘি মাখা ভাত তুলে দিচ্ছেন আমার মুখে, যেন অমৃত
মা হাতপাখা নিয়ে বসেছেন পাশে

সহসা আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে সাইরেন বেজে ওঠে
বিশ্বযুদ্ধের নয়, জীবনযুদ্ধের।




2


আজও খেতে বসে মেয়েকে বলি
দেখো, থালার পাশে যেন ভাত না পড়ে
পড়লে কুড়িয়ে নেবে
স্বপ্না কে বলি, দেখবে কুকারের গায়ে যেন একটাও ভাতের দানা লেগে না থাকে।

আমার পূর্বস্মৃতি মনেপড়ে যায়, বাবা আমাদের বলতেন
অনেক সময়, সামনে দাঁড়িয়ে দেখতেন
মাটিতে ভাত পড়লো কি না
পড়লে, তা সসম্মানে কুড়িয়ে খেতে হতো
মা কে বলতেন, তপু হাঁড়ির গায়ে যেন ভাত না লেগে থাকে।

আমরা দূর্ভিক্ষ দেখিনি, বাবা, জ্যাঠাদের মুখে গল্প শুনেছি
রাজপথে মৃতদের সারি
অভুক্ত মানুষ ফ্যান ভিক্ষে করে বেড়াচ্ছে, এবাড়ি-ওবাড়ি...

এখন বুঝি বাবা কেন অমন করে বলতেন আমাদের
আমিও এখন ফুটুন, স্বপ্নাকে তাই বলি
ভাবি সেসব দিনগুলো যদি আবার একদিন
পা-য়ে পা-য়ে ফিরে আসে !




3

প্রতিমাসেই মূল্য বেড়ে যাচ্ছে তোমার
পঁচিশ, তিরিশ, চল্লিশ...
আর আমরা সর্বহারা মানুষ, তোমাকে দুমুঠো পাবো ভেবে এ-বাজার থেকে ও-বাজার, 
ও-বাজার থেকে সে-বাজার...
রক্তে ভিজে যায় রাজপথ
কপাল থেকে ঘাম গড়িয়ে পড়ে চোখে
ওফ্ ! কী ভীষণ জ্বালা !

জঠোরেও অগ্নি জ্বলে, সে আগুন ক্রমশ উঠে পড়ে মাথায়, প্রতি মাসেই মূল্যবৃদ্ধি 
কাঁচা আনাজ, ভোজ্যতেল, জ্বালানি...
ইদানিং চোখ বন্ধ করলেই 
দাউদাউ, দাউদাউ...চারপাশে জ্বলছে সব
আমরাও জ্বলছি শোকে - দুঃখে - বিরহে - প্রেমে
এক এক সময় ভাবি, এভাবে বেঁচে থাকাই বুঝি জীবন ? নাকি এর পরেও কিছু আছে,
আপাত সুন্দর এবং ভালো

হে অন্ন, তুমি ঈশ্বর আমাদের
খুঁজে এনে দাও কোনো স্বার্থক জীবনের আলো।