আট প্রহরের ছায়ারা












১)



শৈশবের সকাল হঠাৎ-ই খুলে দিল জানলা। দেখো আলসেমির উপর, কেমন এসে পড়েছে করমচা রোদ। আমার উঠতে ইচ্ছা করে না একদম ঘুম থেকে। বিছানা ছাড়লেই মনে হয় আমার বয়স , কয়েক প্রস্তরযুগ বেড়ে যাবে। আর ওমনি দুনিয়ার মালিক, ডার্বি জিতাতে, রেসের ঘোড়ার মতো ছুটাবে আমাকে । সারা সকাল দাঁড়িয়ে ঘাস খেতে হবে তখন এবং তারপর যখন আমার হাঁটু ভেঙে পড়বে একদিন, সেদিনই বন্দুকের এক গুলিতে, আমি ভুলে যাবো – কোনো এক স্বপ্নের ঝিলের পাশ দিয়ে ছিল আমাদের কোচিং-এর রাস্তা। যেখানে মেয়েদের ব্যাচ শেষ হওয়ার পনেরো মিনিট আগেই সমস্ত ছেলেরা সাইকেল সাজিয়ে ফেলেছে সিঁড়ির নীচে।



২)



অভিজ্ঞতা আমাকে শিখিয়েছে ‘বাবু’ কখনো ভুল হতে পারে্ন না। তাই ভরা বর্ষার দিনেও যদি উনি আমাকে আকাশে সূর্যের ছবি আঁকতে বলেন, আমি তা অবলীলাক্রমে আঁকতে পারি। দুঃখের ফুটপাথে বানিয়ে দিতে পারি স্বপ্নের বাগান। আসলে বেঁচে থাকা এক মুহূর্তের টাচডাউন… হুকুম তামিল দু-বেলার পরমান্ন, আর সকাল আটটায় বেজে ওঠা সাইরেনের ভোঁ, শেষের শুরু । এই মহার্ঘ্য জীবনে, এ’রকম অসংখ্য সেকেন্ডের ভগ্নাংশ সঞ্চয় করে, দেখো, আমি অপেক্ষা করছি সকাল সাড়ে-নটার অফিস বাসের জন্য।



৩)



ল্যাপটপ অন করতেই, মুখোশটা নিজে থেকে এসে বসে গেছে আমার মুখে। এখন আমি আর আয়নার সামনে যাবো না। আমার নাম বদলে দেওয়া হয়েছে এখানে। আমার আশেপাশে যারা ঘুরে বেড়াচ্ছে তাদের নামও কী বদলে গেছে আমার মতন? এ এক আশ্চর্য মজার খেলা। অনিল বলে যে ছেলেটিকে আমি ডাকলাম এখন, আসলে তার নাম হয়তো আসলাম। একটা মানুষের মধ্যে এই যে দুটো মানুষ টেবিলে টেবিলে। দুরকমের মুখ। সেই নিয়েই তো বিশ্বাস ও অবিশ্বাসের সহাবস্থানে বেশ কেটে যাচ্ছে বেলা। হাসির ভিতর কান্না, বিনয়ের পিছনে হিংসা, মিষ্টি কথার আড়ালে ছুরিকাঘাত – এই জন্যই মাস গেলে মাইনা পাই আমরা! বলো?



৪)



আমি বিকেলকে কবি বলে ডাকলাম। কিন্তু সে কোনো উত্তরই দিল না। এই কী তবে মধ্যজীবন? অবসাদের মেঘ নিয়ে, নির্লিপ্তিতে পরে নেওয়া সাহসী দেমাগ। দিনমানের হেঁসেল ছুঁড়ে, হলুদ-অক্ষর-ফুল এই যে চলেছে মঞ্চের দিকে, সেখানে হয়তো সামগান এক ফুরফুরে আলো। পুড়ে যেতে যেতে এখানেই পশ্চিমমুখি সময়ের ডানা , বাসা বাঁধে কোনো অচিন ডালে। নিভে যাওয়ার আগে একবার, অন্তত একটিবার, দপ করে জ্বলে ওঠে ঠান্ডা আঁচল, অগ্নিবীণা, অস্তাচল।



৫)



এই সন্ধ্যা মায়াময়। সম্মোহনের মাত্রা এখানে একটু বেশী। এখন সামান্য প্রগলভতা দিয়ে ঘিরে ধরলেও কিছু বলবো না আমি। এত জোনাকি কোথা থেকে আসে এই সময়, আমি সে রহস্য নিয়েই মিশে যাচ্ছি ছাদের অন্ধকারে। দূরে শুকতারা ও বহুতল। ন্যাড়াপোড়ার আগুনে ছাই হতে হতে ফাগুন যখন ফিকে, ঠিক তখনই কোথাও বেজে উঠলো বেহাগ। এবার ছুটি হবে হয়তো। কোনো এক জ্যোৎস্না পথে নেমে আসবে চাঁদের সাম্পান। আর ফ্লাইওভার পেরিয়ে কুয়াশারা সব হারিয়ে যাবে প্রান্তিক এক উপকূলের দিকে।



৬)



থিতিয়ে পড়ছে দূষণ। ক্রমশ ফাঁকা হতে থাকা লোকালগুলোতে হাওয়া তীব্র হচ্ছে। এইবার অঙ্ক ঘিরে ধরবে তোমায়। বিয়োগ ও ভাগ নিয়েই প্রধানত চিন্তা তোমার। ট্রেন যত ঢুকে যাবে অন্ধকারের গভীরে, ততই হলুদ ট্যাক্সিরা চক্কর মারবে রিয়ার-ভিউ মিররের দৃশ্যতে। শহরে তখন স্ট্যাচুদের উল্লাস আর রাতের তারাদের পাশে ঝুঁকে থাকা মফস্‌সলের বিপ্রতীপ কোণে, একা বিষণ্ণ হতে থাকে নরেন কাকুর শূন্য ওয়াটের মুদি দোকান।



৭)



অবশেষে আমি ও আমার আত্মা মুখোমুখি। নির্জনতাকে উপেক্ষা করে আমাদের আলোচ্য বিষয় কখনও প্রেম কখনও বা পলিটিক্স। আপাতত ঘড়ির অভিশাপ নেই জীবনে। যতটুকু রাহুগ্রাস ছিল, সে দোষ কাটাতেই নির্জনতাকে বেছে নিয়েছি আমরা। এভাবেই বিচ্ছিন্ন হয়ে যাক ক্লেদ ও কুসুম। ময়লা কাপড় ছেড়ে স্বচ্ছ হয়ে যাক নগ্নদেহ। এখন রাত নিরাকার। তীব্র অন্ধকারের গভীরে বয়ে চলেছে নীল আলোর এক সরু নদী। ঘুমোতে যাওয়ার আগে এই স্নান দুহাজার আঠেরোতে করিনি আমরা। অনিদ্রা নিয়ে মাথা ঠুকে গেছি অ্যাকোরিয়ামের কাচের দেওয়ালে।





৮)



ভোরের স্বপ্নে আরোগ্য আসবে এটুকু আশা নিয়ে ঘুমোতে গিয়েছিলাম আমরা। আমাদের পরণে ছিল কৌপিন, হাতে ছিল মাধুকরী ধারণের পাত্র। আয়ুর্বেদহীন প্রহর অতিবাহিত হয়েছিল নিজ নিয়মে। পুণরায় সূর্য ওঠার পর আলসেমি ঘিরে ধরেছিল রোজকার মতই। মৃত স্মৃতিগুলো বিষণ্ণ করছিল আমাদের, মনে পড়ছিল ফোটোফিনিশে বার বার হেরে যায় আমাদের দেশ। পাঁচিল ও দরজা এই নিয়েই যাবতীয় তরজা ফেঁড়ে দেয় আকাশ ও পতাকার রঙ। তবে কী এভাবেই পৃথিবীর অন্তিম? তাহলে সীমানায় কেন পাখিদের কুজন?  এসো পুবদিকের জানলা, ডেকে তোলো শিরশিরে হাওয়াকে। ওই তো গাছে গাছে নতুন পাতা। শিকড়ে জলের টান।

জেনে নাও, ভোর এক নতুন জন্ম, মার্তৃক্রোড় কিংবা মৃতসঞ্জীবনীসুধা। কোমল গান্ধার - আট প্রহরের জ্যান্ত ছায়া।