দিল্লীর  চিঠি














' আজকাল  যে  যার  মতন  যায়, কেউ  কাউকে  এগিয়ে  দেয় না।


মল্লিকবাড়ির  ঢ্যামনা, বালিগঞ্জী  জজ,  অজয়পাড়ের   বাউল,  নকশাল  ছেলেটা


অকস্মাৎ  স্বাবলম্বী- যে  যার  আঁধারে  যায়  ,একা ।


আমি  অত  নই;


কি রকম  শূন্য  লাগে-  ভয়...? '


( মনীন্দ্র গুপ্ত, 'চিরমিছিল')








দিল্লীবাসী  মাত্রেই  জানেন, দিল্লী  তে  একই সঙ্গে  বিভিন্ন  ধরনের  মানুষের  বাস। রুজি রুটির  কারণেও বা  অন্যান্য  নানান  কারণে কত  না  রকম ফেরের  সম্মুখীন দিল্লী... , রোজ  বিকেলের  পড়ন্ত  সূর্যের  কমলা  আলোতে  সিপির  ব্লগ  বাস্টার  জাতীয়  পতাকাও  বোধহয়  এই  কথাটিই  মনে  মনে  ভাবে। রোজ  সকালে  ঘুম  ভাঙ্গার  পর আর  ঘুমোতে  যাওয়ার  সময়ে  দিল্লীর  কাছে  কি প্রত্যাশা ছিলো, কি  পেয়েছি,  আর  কি  পাবো ভাবনা... এ যেন  প্রাত্যহিক  অভ্যাসের  মতই  আরও  এক  অভ্যাস। ঘুম চোখে  দিল্লীও দাঁড়িয়ে,  সারা গায়ে  হিম আর  কুয়াশা  মেখে। এই  বৃহৎ  ভাবনা  যখন  মগজে  গজগজিয়ে  উঠছে, মৃত্যুর  ধারনার  সাথে  অবিলম্বে  এক  বোঝাপড়া  করা  দরকার আর  এখনই  , এই  মুহূর্তেই  সিদ্ধান্ত  নিয়ে  নেওয়া  উচিত এ  শহরে  আর  থাকব কি, না? যদি  নাই  থাকি, তবে  একে  ছেড়ে  চলে যাওয়ার  সেরা  উপায়টা কি?  আর  ঠিক  তক্ষুনি  ভয়  নামে  আকাশ  অন্ধকার  করে। এন আর সি, ভিটে উচ্ছেদ, দাঙ্গা- ফাসাদ, মাটির নিচে  অন্ধকার  সুড়ঙ্গে  হঠাৎ  করে  মেট্রো বন্ধ  হয়ে যাওয়া, শরতের  অকাল বর্ষণে  বসন্ত স্কোয়ার  মলের  সামনে  বিতিকিচ্ছিরি  জলকাদায়  পা  পিছলে যাওয়া, দিল্লী –জয়পুর  ন্যাশানল হাইওয়ের রাতভর ট্রাফিক , পরাঠেবালা গলির  কোণা ভাঙ্গা বাসী পরোটা আর তেলালো আলুভুজিয়া- মাত্র  এইগুলোই  কি এ শহরের বিধি সম্মত সতর্কীকরণ ! সরকারী ভেহিকেল্গুলি অনির্দিষ্ট –অনিয়মিত, গ্রামীণ সেবায় এত ভিড় থাকে চড়া যায় না, সি আর পার্কের উন্নাসিক বাসিন্দা, ( অত বড় কালীবাড়ি, অথচ ঠাকুর , মা ,স্বামীজির ছবি কোথাও নেই) ! – তালিকায় এগুলোও  তো আছে। এমস এর হসপিটালগুলো এক্কেবারে  ফালতু, ভেতরে চেনা পরিচিত কেউ না থাকলে ভাল পরিষেবা পাওয়া মুশকিল থেকে মুশকিলতর…। এবং এরপর  যদি কিছু বাকি রইল, তা হল ডেলহি ভায়োলেন্স। এ নিয়ে কথা উঠলে আপনি চেয়ার ছেড়ে উঠে চলে যাবেন। এই তো?


কোনো ধরনের বলের প্রভাব ছাড়া একটা বস্তু যে পথে চলাচল করে তাকে পদার্থবিজ্ঞানে বলে জিওডেসিক। কোনও ভারী বস্তু উপস্থিতিতে তার আশে পাশের জিওডেসিকগুলো বস্তুটার দিকে বেঁকে যায়। দিল্লীর সংগে দিল্লীবাসীর সম্পর্ক অনেকটা এইরকম। বড় বড় ঘটনা মানুষের মনকে নিজের দিকে টেনে নেয়। তৈরি করে বিরাট আকর্ষণ বল। কিন্তু এই সমস্ত ঘটনার জিওডেসিক শুধুমাত্র সমস্যার কার্নিভাল হয়ে না থেকে ঐক্য- সঙ্কটে নিজস্ব একটা পথ খুঁজে নিতে চায় , যা শহরের অলিগলিতে চললেও জানা যায়। বোঝা যায়। যে গলিতে মানুষ নিজের মত করে উত্তরণের কথা ভাবেন, নিজের মনে মনেই এই শহরের বাসিন্দা হয়ে ওঠেন।


সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং, ভিজুয়াল মিডিয়ার যুগেও কাগজ কলম নিয়ে লিখতে বসলে কোথাও যেন একটা প্রশান্তি অনুভূত হয়। দিল্লি নিয়ে লিখতে বসলে আবেগ আর অনুভূতিরা হুড়োহুড়ি ছুটোছুটি লাগিয়ে দেয়। দিল্লীতে থাকলে শুধু , মানুষ, ভাষা, খাদ্যাভ্যাস নয়, এর আবহাওয়ার সংগে নিজেকে মানিয়ে নেওয়াও এক চ্যালেঞ্জ। এই বছরেই দিল্লীর শীত বিগত একশ বছরের রেকর্ড ভেঙ্গে দিয়েছিল। সি আর পার্ককে একসময় ই পি ডি পি কলোনি বলা হত। এই জায়গা ভারতে আসা বাঙ্গালি উদ্বাস্তুদের একটা রি-সেটেলমেন্ট কলোনি হিসেবে পরিচিত হলেও আজ তা রাজধানীর এক সম্ভ্রান্ত জায়গা বলে খ্যাত। শীতে কাঁপতে কাঁপতেই দিল্লী এখানে ‘পৌষ মেলার’ আয়োজন করেছিল এবং খবর বিগত ছেচল্লিশ বছর ধরে এই মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। মেলা বসেছিল, সি আর পার্কের স্বামী বিবেকানন্দ মেলা প্রাঙ্গণে। আগে চাঁদা তুলে মেলার আয়োজন করা হত। এখন স্পন্সরশীপ ও মিডিয়া কভারেজ পাওয়া যায়। শুরুর দিকে নাকি তাম্বোলা খেলার প্রথা ছিল, এখন অবশ্য তা আর নেই। পৌষ মেলার সেরা আকর্ষণ পিঠে উৎসব। এছাড়াও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, শিশুদের মনোরঞ্জন… আর ছিল মৃৎশিল্পীদের অসাধারণ হাতের কাজ। নিপুণ দক্ষতার সংগে তাঁরা একের পর এক মাটির পাত্র তৈরি করে চলছিলেন। অসাধারণ সেই দক্ষতা।





অন্য প্রসঙ্গ কিন্তু অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ:- জাতীয় জনসংখ্যা পঞ্জী ( এন পি আর), জাতীয় নাগরিক পঞ্জী ( এন আর সি) ইত্যাদি নিয়ে দিল্লী তথা গোটা দেশ যখন অস্থির, দু চার গাছি রেল লাইন উপড়িয়ে, কাঁসর  ঘণ্টা বাজিয়ে নিজের  উপস্থিতি  জাহির  করলেও কি রাজত্ব  জয়  করা  গেছে? দিল্লী ভাবছে এ তো অতি পুরনো কথা। পুরনো কথাটির পুনরুক্তি কিছু দোষণীয় নয়। ভিয়েতনামের  প্রতিটি  বাড়ির  সামনে তিনটি করে বড় গাছ লাগানো  নাকি  বাধ্যতামূলক। আমার আগের  লেখাতেও লিখেছি  সে কথা । দিল্লী হাট পত্রিকায় দিলিপ দা ( দিলীপ ফৌজদার) দিল্লী  নিয়ে  লিখতে  বলেছিলেন। লিখেছিলাম  সেখানে সেই  তিনটি গাছের  ব্যাপারে দিল্লী কি একটু  সময় দেবে?