রৌদ্রস্নান

কৌশিক সেন


ঝিকিমিকি বালুকণা খুঁটে খায়
কবিদের দল –
কিছু পরে জলে নামা হবে,
সাদা সাদা ফ্যানাগুলি
ডেকে ডেকে ফিরে ফিরে যায়
কিছু পরে রোদ নিভে যাবে।

সোনা রোদ ভালোবাসাবাসি
সোনাঝুড়ি গাছের ছায়ায়
ছায়া-রোদ কুমীরডাঙ্গা,
ঝলমলে সাগরের তট –
যতদূর দৃষ্টি বোলায়
এ স্বপন যায় না ভাঙা।

কবিরা ভেজেনি কতদিন
ওরা তো ভিজবে বলে আসে,
বৃদ্ধ কাছিম জানে সব –
ঢেউ তো ফিরে ফিরে যায়
তবুও ফিরে ফিরে আসে
বালুতটে ধর্ষিতা শব।

রোদ্দুর যদ্দুর যায়
তদ্দূর কবিদের চলা
লাল কাঁকড়ার দল পায়ে পায়ে,
রোদে ভিজে কাকভেজা ওরা
ডানা মেলে আকাশেতে ওড়া
শুধু, শুধুই তো বাঁচবার দায়ে।।



রঘুনাথতলা


ঠাম্মি, আমায় একবার
রঘুনাথতলার মেলায় নিয়ে যাবে,
মাটির সরায় গুড়ের বাতাসা চরাবো
রঘুকুলপতির শ্রীচরণকমলে।
আট আনা পয়সায়
আকন্দ ফুলের মালা কিনে
পড়িয়ে দেব
শ্রীরামচন্দ্রের গলায়।


রঘুনাথতলার মাথায়
এখন প্রহর গোনে
সিরিয়ার আকাশ,
রাস্তায় ধুলো ওড়ে না আর –
কড়কড়ে বালুকণা চোখে ঢুকে
ঝাপসা করে দেয় দৃশ্যপট।
ভাঙাচোরা জনপদের নীচে
চাপাপড়া
বুকের ভিতরকার ধু ধু মরুভূমি।


ঠাম্মি, আমায় নিয়ে যাবে
রঘুনাথ তলার মেলায়,
পোড়া তেলে, ধুলোমাখা
পাঁপরভাজা কিনে খাবো
টাকায় দুটো করে।
ঠাম্মি, ভেটু ফুলের গন্ধে
ভরে দেবে
আমার রামনবমীর সকালবেলা!


আমার রামনবমীর সকালে
আজ গ্রেনেডের গন্ধ,
বারুদের ওমে ম ম করছে
রান্নাঘরের বাসন থেকে
টুথব্রাশের র‍্যাক,
সকালের শেভিং কিটে
আজ আতঙ্ক নির্যাস!


শুধু একটিবারের জন্য
আমায় রঘুনাথতলার মন্দিরে
নিয়ে যাবে ঠাম্মি!
নোনা ধরা দেওয়ালে
সাদা চুন ফিরিয়ে নেওয়া হয়
রামনবমীর আগে।
মন্দিরের চাতাল থেকে
ভেসে আসবে
বাসি চাঁপাফুলের
মন কেমন করা সুগন্ধস্মৃতি।


সমস্ত দেওয়াল ভেঙে গেছে,
রঘুনাথ মন্দিরের সামনের বিলে
কচুরিপানার ফাঁকে ফাঁকে
অগুন্তি শিশুর লাশ ভেসে বেড়ায়।
পোড়া ধ্বংসস্তূপের ওপর
পোয়াতি কিশোরীটি
পাগলের মতো খুঁজে বেড়ায়
কে তাকে পাপবিদ্ধ করেছে
এতকাল –
দামাস্কাস থেকে ধেয়ে আসা
কালো মেঘ,
নাকি অযোধ্যা নরেশ, দশরথ পুত্র
শ্রীরামচন্দ্র!!



এই তো জীবন


সারা দিন ভালোবাসা আগুনের মাখামাখি
আমরা তো জীবনের গান গাই,
ঘটি-বাটি, চাল-কলা, অবিরাম পথ চলা
কিভ, লাসা, মম্বাসা, বনগাঁয় ।

পথভোলা, ভেজা ছোলা, গুঁড় ছিল পুঁটলিতে
শেষ হয়ে গেছে যতো পারানি,
চোখ কেন ঢুলু ঢুলু, মুখ কেন ফুলুফুলু
এতো নয় গান ঘুম পাড়ানী।

আগুনের সাথে যোগ, স্বপ্নিল সম্ভোগ
মালসায় জ্বলে সুখ- খাদ্য
আমাদের কথা বলা, সাপ-লুডো জুয়া খেলা
পিথাগোরাসের উপপাদ্য।

ঘুরে মরা রাত-ভোর, তুই আমি – আমি তোর
সেই কবেকার চেনা বৃত্ত
তাথৈ তাথৈ নাচা, বেঁচে মরা – মরে বাঁচা
খাঁচা ভরা তাণ্ডব নৃত্য।

আমি খাই তুই খাস, টক-ঝাল সন্ত্রাস
ব্রাশ দিয়ে ঝেড়ে তুলি ধুলো ভয়,
আমি গাই, তুই গাস, কালবেলা মধুমাস
বোকা বোকা আবেগের সঞ্চয়।

রুইতন-হরতন, মন করে চনমন
সফ্ট কপি, নীল-ছবি, শীৎকার,
কাঁধে ঝোলা, কবি ভোলা
অকারনে বুকফাটা চিৎকার।

আমাদের ছোট নদি, স্কেচ করা বুকে যদি
স্বপ্নেও পাবি নারে নিস্তার,
নিউরো বা গাইনি, জ্যোতিষ বা আইনি
দিতে দিতে দেউলিয়া ফিস্ তার।

জীবন টা আজগুবি, মাঝ গাঙে ভরাডুবি
তোরা বস্ নোস মাঝি-মাল্লা,
ওঠা নামা খেলাতে, হেরে যাবি হেলাতে
ছিঁড়ে যাবে চেনা দাঁড়িপাল্লা।

বিদ্যুৎ চমকায়, চান্দেরী বমকাই
সারি সারি শাড়ীদের মেলা ভিড়,
মেলার নাগরদোলা, বুকের দুয়ার খোলা
বরাভয় আছে বুঝি শান্তির!

ঝালমুড়ি চানাচুর, দাল- বাটি চুরমুর
ঝোলাগুড়, রুটি-ভাত-চিনি-নুন,
ভুলে গেছি সব্ কুছ্, অব্ মুঝে মত্ পুছ্
কপালেতে কাঠফাটা ফরচুন।

কত আর বড় হব, আকাশ কে ছুয়ে যাবো
বল ওগো ঈশ্বর কবে আর,
যাপনের দিনগুলো, উড়ে যেন পেঁজা তুলো
কভু সেতো থাকে নাতো আপনার।

তেলাপিয়া, তেল কই, শেষ পাতে মিঠে দই
আগুনের সুখস্বাদ কবেকার,
আজকে পড়লো মনে, কেন কোন কুক্ষনে
সারাদিন খুঁজে হই জেরবার।





অড – ইভন ফরমুলা


আমি অড,
তুমি ইভন।
যেদিন আমি রাস্তায় ছুটে বেড়াবো,
সেদিন দখিন খোলা ব্যালকনিতে
তোমার হাতে
আলসে দিনের পেয়ালা পিরীচ।
যেদিন আমি একলা ঘরের অন্ধকার কোণে
মন খারাপে চুপটি বসে থাকি,
সেদিন তুমি রাজপথে উড়ে বেড়াবে
মুক্তির উদ্বেল আনন্দে।

সে সব দিনে
ছাতি ভরে নিশ্বাস নেবে
কারখানার হুইস্ ল, মন্দিরের ঘণ্টা-
রথের মেলার ভেপু থেকে
ট্রাফিক জ্যামে আটকে পড়া
ব্যাস্ত বাইকের হর্ন।
সে সব দিনে
পাখনা মেলে উড়ে আসবে
রঙিন হোম ডেলিভারি বালকেরা,
আপনার ডোরবেল বাজাবে
নির্ধারিত সময়ের অনেক আগেই।

হাজার হাজার বছরের ধূলি ধূসরিত
ধোঁয়াময় ধূসর কলিজারা
উজ্জ্বল গোলাপি আভায় হেঁসে উঠবে
আমাদের জোড়-বিজোড় শাশ্বত সুত্রমালায়।।