অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়
অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়
লেখক / সংকলক : iPatrika Crawler

মটকা পীর
অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়
সারাদিন
ঘোড়ার পিঠে চড়ে, গভীর বনজঙ্গল পার হয়ে পথচলা। অবসন্ন শরীর দিনের শেষে যখন
জবাব দিল, ঠিক তক্ষুনি আবু বকরের চোখে পড়ল বড় বড় বট আর অশ্বত্থ গাছের ফাঁকে
বয়ে যাওয়া স্রোতস্বিনীর উপর। আঃ, আরামে চোখ বুজে এল। কতদিন পর একটা নদীর
দেখা! একটা বট গাছের নিচে ছেঁড়া গালিচাটা পেতে জব্বর একটা ঘুম দেওয়া যাবে
আজ রাতের মতো। স্থানটি বেশ মনোরম। খুশি হয়ে ওঠে আবুর মন।
সঙ্গী
ঘোড়াটাও পথশ্রমে ক্লান্ত। তার পিঠ থেকে নেমে আবু তাকে বস্তার মুখ খুলে
বাজরা খেতে দেয়। এবার নিজের পেটের জোগাড় করতে হবে। আর একটা পুঁটুলি থেকে
পেষাই করা চানা বার করে আবু। জলে চানার গুঁড়ো ভিজিয়ে খেয়ে নিলেই
ক্ষুন্নিবৃত্তি করা যাবে আজকের মতো। বট গাছের সাথে কালো ঘোড়াটাকে বেঁধে,
গাছের নিচে জমে থাকা আগাছা পরিষ্কার করে, বহু ব্যবহৃত ছেঁড়া গালিচাটা পেতে
দেয় আবু বকর। শতচ্ছিন্ন গালিচার দিকে তাকিয়ে ফেলে আসা জন্মভূমিতে নিজের
উজাড় হওয়া ঘরের কথা মনে পড়ে যায় তার।
এই নদীটা বেশ খরস্রোতা।
দুই পাড়ে ঘন জঙ্গল। হিন্দুস্তানে এখন গ্রীষ্মকাল। এঁটেল মাটি শক্ত হয়ে
রয়েছে। ঢালু জমি নদীর পাড় থেকে সোজা গিয়ে মিশে গেছে জলে। সন্ধ্যে নেমে
আসছে। এদিকের পাড়ে যদিও জমি নজরে পড়ছে, নদীর অন্যকুল প্রায় অন্ধকার। মাথার
পাগড়িটা খুলে রেখে নদীর দিকে এগিয়ে যায় আবু। দু-একটা ডুব দিয়ে নিলেও মন্দ
হবে না। পথের ঘাম এখনো শরীরে শুকোয় নি।
হটাত পাড়ের কাছে একটু দূরে
কারো নড়াচড়া করা শরীর চোখে পড়ে আবুর। সন্ধ্যের অন্ধকারে জঙ্গল থেকে হিংস্র
জানোয়ার নেমে আসাও বিচিত্র কিছু নয়। কৌতূহলে সাবধানে এগিয়ে যায় সে। আরে,
এতো মানুষ মনে হচ্ছে! সারাদিন পথে একটা মানুষও চোখে পড়েনি। ঘন জঙ্গল দেখে
চারপাশে মানুষ যে বাস করে তাও মনে আসেনি। সে জানে, হিংস্র জন্তুর থেকেও
বেশি ভয়ংকর হল মানুষ। তাই সাবধানে পা ফেলে আবু এগোতে থাকে। আশ্চর্য,
মানুষটা যে জলের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে! চিৎকার করে ডাকতেও সাহস হয় না। ঘর
ছাড়ার পর থেকে বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা মাঝবয়সী আবুকে অনেক বেশি সাবধানী করে
তুলেছে। কিন্তু যেই হোক, সে জলে ডুব দিয়ে আর উঠছে না। আবু এবার দৌড়ে নদীর
জলের দিকে নেমে যায়। না, মনে হচ্ছে লোকটা অসহায়। সাঁতার জানে না বলেই মনে
হচ্ছে। আর দ্বিতীয়বার না ভেবে আবু বকর জলে ঝাঁপ দেয়।
আবুর শরীরে
এখনো যথেষ্ট জোর অবশিষ্ট। মানুষটার কাছে গিয়ে তার এক হাত ধরে সবলে টেনে
তোলে। আধো অন্ধকারে বোঝা যায়, ডুবন্ত মানুষটি এক পুরুষ। সে দুর্বল, কিন্তু
একেবারে সাঁতার জানেনা, এমনও নয়। বাঁচার শেষ ইচ্ছেয় দুর্বল মানুষটি আবুকে
জড়িয়ে ধরতে চাইলে আবু ছিটকে সরে যায়। এক হাতে সাঁতরে, আর এক হাত ধরে তাকে
হিঁচড়ে পাড়ে নিয়ে এসে ফেলে। অন্ধকারেও বোঝা যায় মানুষটা কাঁদছে। স্থানীয়
ভাষা আবুর জানা নেই। সে নিজের মাতৃভাষায় কথা চালাতে চেষ্টা করে। লোকটা আশু
জলে ডোবার থেকে বেঁচে ফিরে এসে বড় বড় নিঃশ্বাস নিয়ে হাঁফায়। দুর্বোধ্য
ভাষায় কাঁদতে কাঁদতে আবুকে সে কিছু বলতে চায়। লোকটা আত্মহত্যা করতে
গিয়েছিল, এ বিষয়ে নিঃসন্দেহ আবু বকর।
নদীর জলে ভিজে আবুর
জামাকাপড় ভিজে একসা। স্নান যে এইভাবে হবে, কিছুক্ষণ আগেও সে ভাবেনি। ভিজে
পোশাক পরিবর্তন করে দেখে, লোকটা উদাস হয়ে নদীর দিকে তাকিয়ে আছে। আবু তার
পিঠে হাত রাখতেই সে ইশারায় তার পায়ের দিকে দেখিয়ে দেয়। আবু দেখে লোকটার দুই
পায়ে দগদগে ঘা। চমকে উঠে, চোখ সরিয়ে নিয়ে আবু লোকটাকে তার বস্তা থেকে দুটো
আপেল বার করে খেতে দেয়। সে গোগ্রাসে ফল খেতে থাকে। লোকটাকে একটু জল দেওয়া
প্রয়োজন। কিন্তু জলের পাত্র যে নদীর পাড়েই পরে আছে। একছুটে আবু নদীর কাছে
গিয়ে তার জলের পাত্র খুঁজে জল ভরে নিয়ে এসে দেখে লোকটা ঘাসের জমিতে শুয়ে
পড়েছে অবসন্ন হয়ে।
পশ্চিম আকাশে সূর্য অস্তাচলে। আবু তার জলের
পাত্র সামনে রেখে হাঁটু গেড়ে বসে আকাশের দিকে দুই হাত ঊর্ধ্বাকাশে তুলে
ঈশ্বরের কাছে দোয়া জানায় — তিনি যেন এই অসহায় মানুষটিকে নীরোগ করে তোলেন।
উবু হয়ে ভূমিতে চুম্বন করে উঠে দেখে, মানুষটি বসে বসে একদৃষ্টিতে তার জলের
পাত্রটিকে দেখছে। আবু চমকে ওঠে। জলের পাত্রটি বাগদাদ থেকেই সে তার সঙ্গে
করে বয়ে নিয়ে এসেছে। আরও যা যা কিছু সঙ্গে ছিল, সবই কোনও না কোনও সরাইখানায়
একে একে চুরি হয়ে গেছে। স্মৃতি হয়ে আছে শুধু সুদৃশ্য জলের পাত্র, যার গায়ে
আটটি বহুমূল্য রত্ন খচিত। থাকার মধ্যে আছে সঙ্গী আরবি ঘোড়া আর ছেঁড়া
গালিচা। পোশাক আশাকও গত কয়েক বছরে তাপ্পি পড়ে আসল চেহারা হারিয়েছে।
লোকটা চোর-ডাকাত নয় তো? জলের পাত্রের লম্বা নল লোকটার মুখের কাছে ধরে জল
ঢালতে থাকে আবু বকর। তৃষ্ণার্ত মানুষটা আকণ্ঠ জল পান করে পরিতৃপ্ত হয়ে
ঘাসের উপর লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে। আবু ভাবে, সকাল বেলায় লোকটার হাল হকিকত জেনে
নেওয়া যাবে। পরিশ্রান্ত শরীরে সেও ছেঁড়া গালিচার উপর শুয়ে পড়তে না পড়তে
নিদ্রার কোলে ঢলে পড়ে।
ঘোড়ার ক্ষুরের সম্মিলিত আওয়াজে
চোখ খুলে যায় আবু বকরের। সকাল হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। বাতাস এখন বেশ ঠাণ্ডা। গত
সন্ধ্যেয় দেখা হওয়া লোকটা ধারে কাছে নেই। নদীর পাড়ের দিক থেকে চারজন ঘোর
সওয়ার আবুর দিকেই ঘোড়ায় চড়ে আসছে। সামনে এসে তারা কোমর থেকে তরোয়াল বার করে
উঁচিয়ে ধরে। পরনের পোশাক দেখে বোঝা যায়, তারা কোনও সম্রাটের সৈনিক। গায়ে
তাদের দামী পোশাক। মাথায় রঙিন পাগড়ি। ইয়া আল্লা! আবু কোথাও বেআইনি
অনুপ্রবেশ করে ফেলেনি তো! আবার ভাবে, হয়ত গতকালের লোকটা সৈন্যদের খবর
দিয়েছে।
যেদিন থেকে আবু জন্মভূমি ছেড়েছে, সেদিন থেকেই সে
মৃত্যুর সামনে পড়েছে প্রতিনিয়ত। তাই মৃত্যুভয়ে এতটুকু ভীত নয় সে। সৈন্য
চারজন সন্দেহের চোখে আবু আর তার ঘোড়াকে দেখে বলে, “ওহে বিদেশি, তোমার পরিচয়
দাও। নইলে মৃত্যু অনিবার্য।”
“আমি এক ফকির। বহুদূর থেকে
ভাগ্যতাড়িত হয়ে এখানে পৌঁছেছি। কারো ক্ষতি করিনি আজীবন।” সৈন্যটির মুখে
ফার্সি ভাষা শুনে আশ্বস্ত হয় আবু। তাহলে এরা তার খুব অপরিচিত নয়। কারণ আবুর
নিজের মাতৃভাষাও ফার্সি। তবে বহুদিন ঘর ছাড়া হয়ে, ভবঘুরে জীবন কাটিয়ে, বহু
ভাষা আবুর আয়ত্তাধীন। মাতৃভাষার মধু বিদেশ বিভূঁইয়ে আবুর কানে যেন সুধা
ঢেলে দেয়।
আবু ভরসা পেয়ে জিজ্ঞেস করে, “এটা কোন জায়গা? আমি কালই এখানে এসে উপস্থিত হয়েছি। আমাকে কী এই স্থান ছেড়ে দিতে হবে?”
আবু স্থানীয় লোক নয় জেনে সেনারা সন্দিগ্ধ হয়। ঘোড়ার রেকাবে ঝুলিয়ে রাখা
বস্তাগুলোতে তল্লাসি চালাতে চালতে সেনাদের একজন জানায়, “এটা দিল্লি। সুলতান
ঘিয়াসুদ্দিন বলবনের রাজত্ব। সুলতানের অনুমতি ভিন্ন বিদেশীদের প্রবেশ
নিষেধ। তবে এখুনি এই স্থান ছেড়ে যেতে হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না উপরমহলের
আদেশ আসছে।”
আবু বকরের তুচ্ছ সম্পত্তির মধ্যে সন্দেহজনক কিছু
দেখতে না পেয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে সৈন্যরা চলে যায়। নদীর পাড়ে গালিচা পেতে নামাজ
পড়তে বসে আবু। নামাজ পড়া সাঙ্গ করে গাছতলায় ফিরে এসে দেখে, গতকাল যাকে সে
জলে ডোবা থেকে বাঁচিয়েছে, সে ফিরে এসে আবুকে খুঁজছে। তাকে দেখতেই নিজের
ভাষায় কিছু বোঝানোর চেষ্টা করে। আবুর দৃষ্টি পড়ে তার পায়ের দগদগে ঘায়ের
উপর। সকালের আলোয় ক্ষতস্থান আরও বীভৎস লাগে। ইশারায় লোকটা আবুকে জানায়,
সুলতানের সেনাদের আসতে দেখে ভয় পেয়ে সে জঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছিল। লোকটা হটাত
জঙ্গলের পথে হাঁটতে থাকে আর আবুকে ইশারায় তাকে অনুসরণ করতে অনুনয় করে।
কৌতূহলের বশে আবুও চলে তার পিছন পিছন।
নদীর উল্টো দিকে জংলি পথ
ধরে হাঁটতে হাঁটতে তারা পৌঁছে যায় একটা গ্রামে। কয়েক ঘর মানুষ নিয়ে সেই
গ্রামে লোকে কামারের কাজ করে। তারা খুব গরিব। গতকাল লোকটাকে যেমন মুমূর্ষু
দেখাচ্ছিল, আজ তাকে তেমন লাগছে না, বরং সোৎসাহে সে আবুকে নিয়ে চলেছে নিজের
গ্রাম দেখাবে বলে। পাতায় ছাওয়া মাটির ঘরগুলো থেকে মানুষ বেরিয়ে এসে আবু
বকরকে উৎসুক চোখে দেখতে থাকে। ওরা আবুকে বজরার রুটি আর আচার খেতে দেয়।
বয়স্করা গোল হয়ে বসে আবুকে ঘিরে। গ্রামের মহিলারা দূর থেকে আবুকে দেখতে
থাকে, যেন সে এক সঙ। বাচ্চারা আবুর গা ঘেঁসে খুঁটিয়ে দেখে তার সাদা লম্বা
দাড়ি। গ্রামের মুরুব্বি বয়স্ক লোকটা খানিকটা ভাঙা ভাঙা ফার্সি জানে।
কিছুক্ষণের মধ্যে আবুর সাথে গল্প জমে যায়।
কামার পাড়ার
মানুষদের সাথে আবু বকরের এখন খুব বন্ধুত্ব। ভিনদেশী অতিথিকে তারা নিজেদের
গাঁয়ে এসে বাস করতে বলেছে। কিন্তু আবু শান্তিপ্রিয় মানুষ। যমুনা নদীর পাড়ে
নির্জন নিরিবিলি জায়গাটা তার খুব পছন্দের। এত দেশ-বিদেশ ঘুরে এই জায়গাটাকে
সে ভালবেসে ফেলেছে। কামার পাড়ার মানুষেরাও তাকে খুব ভালবাসে। সবাই তাকে
ফকিরবাবা বলে ডাকে। সুলতানের সেনারা আর দ্বিতীয়বার ফিরে আসেনি। আবু শুনেছে
মেহেরৌলিতে সুলতানের প্রাসাদ যমুনা নদী থেকে সাত কোশ দূরে। নদীর ওপারে বাস
করে তোমাররা, তারা বহু প্রাচীন অধিবাসী। একসময়ে দিল্লির শাসন তোমারদের হাতে
ছিল। তারপর সুলতানেরা ওদের ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে নিজেদের রাজত্ব স্থাপন করে।
ঘিয়াসুদ্দিন বলবন সুলতান ইলতুত্মিসের ক্রীতদাস ছিল। পার্সিয়া থেকে তাকে
ধরে এনে ইলতুত্মিসের কাছে মোটা দামের বিনিময়ে বেচে দেয় এক ইরানী ডাকাত।
বুদ্ধির জোরে বালক অবস্থাতেই সে সুলতানের নজরে পড়ে যায়। তাকে ভর্তি করা হয়
ক্ষমতাশালী “চল্লিশের দলে”। এই চল্লিশের দল ইলতুত্মিস তৈরি করেন চল্লিশ জন
সবল বুদ্ধিমান আমত্য নিয়ে, যাদের কাজ ছিল সুলতানকে পরামর্শ দেওয়া আর নানা
কাজে সহায়তা করা। রাজিয়া সুলতানা দিল্লির মসনদে বসার পর তার প্রধান
উপদেষ্টা নিযুক্ত হয় ঘিয়াসুদ্দিন। মঙ্গোল দস্যুদের এদেশ থেকে তাড়িয়ে নিজেকে
এক দক্ষ সেনাপতি হিসাবে প্রমাণ দেন বলবন। দুর্বল সুলতান নাসিরুদ্দিন
মহম্মদ দিল্লির মসনদে বসেই ঘিয়াসুদ্দিন বলবনের হাতে সমস্ত ক্ষমতা অর্পণ
করেন। নাসিরুদ্দিনের মৃত্যুর পর বলবন সুলতানের গদিতে বসেন।
সুলতানি ইতিহাসের এই ইতিবৃত্ত আবুকে জানায় কামার পাড়ার মোড়ল বিক্রম সিং।
কয়েক মাসে দিল্লির স্থানীয় ভাষা এখন অনেকটাই আবু বকরের আয়ত্তাধীন। যে
লোকটিকে জলে ডোবার হাত থেকে সে বাঁচিয়েছিল, তার নাম নাহার সিং। পায়ের ঘা
তার অনেকটাই সেরে উঠেছে। কিন্তু এই সেরে ওঠার কৃতিত্ব সে ফকিরবাবাকেই দেয়।
আবুর ঋণ শোধ করতে সে আবুকে উপহার দিয়েছে সুদৃশ্য এক ভোজালি। আবু ফকির
মানুষ। ছুরি-চাকুতে তার মন নেই। নাহার সিং বলে, “কাছে রাখ ফকিরবাবা।
দিল্লিতে চোর ডাকাতের অভাব নেই। নদীর পাড়ে একা একা থাক। রাতের দিকে জংলী
জানোয়ার আসতে পারে। হাতের কাছে একটা অস্ত্র থাকলে বুকে বল ভরসা পাওয়া যায়।”
নাহার সিং-এর ধারণা ফকিরবাবার মাণিক্য খচিত সুন্দর পাত্রে জাদু আছে। ওই
পাত্রের জল খেয়ে নাকি তার পায়ের ঘা সেরে গেছে। আবু বকর নিজেও জানে, তা
অসম্ভব। কিন্তু নাহার সিং-এর বিশ্বাসে আঘাত দিতে মন সরে নি আবুর। কীভাবে
যেন ধীরে ধীরে আবুর পাত্রের জল খেয়ে নাহার সিং-এর রোগ সেরে যাওয়ার
ব্যাপারটা ছড়িয়ে পড়ে এক গ্রাম থেকে আর এক গ্রাম। নদীর ওপাড় থেকে নৌকো চেপে
যেদিন তোমার পাড়ার একদল মানুষ এসে আবুর কুটিরের সামনে জমায়েত হল, সে মনে
মনে চিন্তিত হয়ে উঠল। আবু বকর আগাগোড়া ধার্মিক, এক শান্তিপ্রিয় মানুষ। দেশ
থেকে সঙ্গে করে বয়ে নিয়ে আসা খান কয়েক পুঁথি সে ঘুড়িয়ে ফিরিয়ে অল্প বিস্তর
পড়ে থাকে, একথা কামার পাড়ার লোকেরা জেনে ফেলে আবুকে সাক্ষাত ভগবানের
প্রতিভূ ভেবে বসেছে।
বিশালদেহী তোমাররা আবুর কাছে নিয়ে এল এক যোয়ান
ছেলে। তার নাকি বারেবারে অজ্ঞান হয়ে যাওয়া রোগ। দলপতি আবুর জন্য নিয়ে এসেছে
দুই ঝুড়ি ফল, চারটে মুরগী আর তিন ঝুড়ি আনাজ। কামার পাড়ার দান খয়রাতে আবুর
দিব্বি চলে যায়। রোগীর শুশ্রূষা করতে আর তাদের দান নিতে আবু কুণ্ঠিত হয়ে
পড়ছে দেখে মোড়ল বিক্রম সিং ফিসফিসয়ে বলে, “ওদের ফিরিও না। কথায় কথায় রেগে
যাওয়া ওদের স্বভাব। তোমার ওই পাত্রটা থেকে দাও না হয় খানিকটা জল খাইয়ে।
দেখাই যাক, রোগ সারে কিনা।”
মুখে জল ঢালতেই অসুস্থ যুবকটি উঠে
বসে। দলের সবাই ভূমিতে গড় হয়ে আবু বকরের জয়ধ্বনি দিতে থাকে। আবু বিব্রত হয়ে
বলে, “আল্লা সবাইকে রক্ষা করো।” নিজের অজান্তে সে কখন যে পীরের আসনে
অধিষ্ঠিত হয় জানতে পারে না।
আবু বকর যখন
বাগদাদ ছাড়ে তখন সেখানে শাসন করত মঙ্গল জাতির কুখ্যাত নেতা হালাগু খানের
ছেলে আবাকা খান। অত্যাচারে সে নিজের বাপকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিল। বাগদাদে তখন
চরম অরাজকতা চলছে। আবুর পরিবার পড়াশুনো আর ধর্মচর্চা নিয়ে ব্যস্ত থাকত।
তারা ছিল তাজিক গোষ্ঠীর। আবু পাঠশালায় ছোট ছোট ছেলেদের শিক্ষা দিত। আবাকা
খানের আমলে শুরু হল গৃহযুদ্ধ। বুদ্ধিজীবী তাজিকেরা দলে দলে ঘর ছাড়ল নতুন
ভাগ্যান্বেষণে। বাগদাদ থেকে পালিয়ে কিছুদিন হেরাত-এ বাস করেও ভাগ্য ফেরেনি
আবুর। তারপর কত পাহাড় পর্বত কন্দর ডিঙ্গিয়ে, অবশেষে সে এখন হিন্দুস্তানে
ডেরা বেঁধেছে। কামার পাড়ার লোক ভালবেসে আবুর জন্য মাটির ঘর তৈরি করে
দিয়েছে। পাতার আচ্ছাদনে তৈরি ঘরের চালের ফাঁক দিয়ে আবুর ঘর জ্যোৎস্নায় ভেসে
যায়। তার চোখে ঘুম নেই। এদেশের মানুষ তাকে পরমেশ্বরের প্রতিভূ ভেবেছে, এ
বড় অস্বস্তির। নিজেকে খুব অসহায় মনে হয় তার।
ভোর রাতের
নিস্তব্ধতা চিরে ঘোড়ার ক্ষুরের আওয়াজে ঘুম ভাঙে আবুর। আগল ঠেলে বাইরে এসে
দেখে আধো-আঁধারে সুলতানের রাত প্রহরীরা অপেক্ষায়। এক সেনা ঘোড়া থেকে নেমে
এসে কুর্নিশ করে আবুকে। বিস্ময়ের শেষ নেই! সুলতানের সেনারা তাকে কুর্নিশ
করছে? তবে কী সে স্বপ্ন দেখছে? নাঃ, বরং দিব্যি জেগে আছে। এই তো ভোরের নরম
ঠাণ্ডা বাতাস নদী থেকে উঠে এসে বেশ আরাম দিচ্ছে শরীরে।
“সুলতান তলব করেছেন জনাব। আপনাকে মেহেরৌলি যেতে হবে, তৈরি হয়ে নিন।”
“আরে, দাঁড়াও দাঁড়াও, গোসলটা তো করতে দেবে?” আবু বকরের বুকে ভয়ের ঢেউ পাড়
ভাঙে। মনে হচ্ছে হিন্দুস্তান থেকেও পাত্তাড়ি গোটাতে হবে।
আগে
পিছে সৈন্য সমাবৃত হয়ে, ঘোড়া চেপে আবু চলল সুলতানের প্রাসাদে। কামার পাড়ার
লোকেরা দূর থেকে দেখতে লাগল আবুর চলে যাওয়া। নাহার সিং খবর পেয়ে ছুটে এসে
ঘোড়ার পাশে দৌড়োতে দৌড়তে কাঁদতে লাগল। সৈন্যদের ধমক খেয়ে শেষে ক্ষান্ত দিল।
মোড়ল বিক্রম সিং গোঁফে তা দিতে দিতে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “এটা ভালো হল
না। সুলতানের হাতে ফকিরবাবার নিস্তার নেই। আর কোনোদিন আমরা ওকে ফিরে পাব
কিনা কে জানে?”
যমুনার পাড়ে আস্তানা গাড়া অবধি এদিকে শহরের
এদিকটায় আসবার সাহস করেনি আবু বকর। জঙ্গল কেটে চাষ আবাদই শুধু হয়নি,
বর্ধিষ্ণু গ্রামও চোখে পড়ল পথ চলতে। উৎসুক মানুষ রাস্তা ছেড়ে দিল সুলতানের
সেনাদের। অতীতের কথা আজ খুব মনে পড়তে লাগল আবু বকরের। দোর্দণ্ড প্রতাপ
সুলতান ঘিয়াসুদ্দিন নাকি অত্যন্ত নিষ্ঠুর প্রকৃতির। হয়তো দুনিয়াতে আবুর
বাসের মেয়াদ শেষ হয়ে এসেছে। সে বারবার ঈশ্বরকে স্মরণ করে জপ করতে লাগল।
প্রাসাদের প্রধান দরজার আগে চোখে পড়ল সুউচ্চ মিনার, পাথর আর মাটি দিয়ে
তৈরি পাঁচ মানুষ সমান প্রাচীর। সুরকি আর পাথর দিয়ে তৈরি রাজপথে ঘোড়ার
ক্ষুরের আঘাতে খটখট শব্দ উঠতে লাগল। সুলতানের প্রাসাদ বাগদাদ আর হেরাত-এর
কথা মনে করিয়ে দেয় আবুকে। প্রসাদের ভিতরে কিছুটা এগোতেই একজায়গায় তার
নাম-ধাম পরিচয় লেখা হল। তারপর তাকে জানিয়ে দেওয়া হল সুলতানের সামনে তার
প্রতি সম্মান দেখাবার বাধ্যতামূলক আদব কায়দা।
ঘোড়াকে সেনাদের
জিম্মায় ছেড়ে দিয়ে হেঁটে এসে প্রকাণ্ড এক খোলা জায়গায় এল আবু। দূরে সুলতান
ঘিয়াসুদ্দিন বলবন একটা পাথরের বেদীতে বসে আছেন। পাঁচজন দেহরক্ষী খোলা
তরোয়াল হাতে তার চারিদিকে দাঁড়িয়ে। ছত্রধর সুলতানের মাথায় প্রকাণ্ড ছাতা
ধরে দাঁড়িয়ে। সুলতানের বয়স প্রায় আবুর কাছাকাছিই হবে। নাম ঘোষণা হতেই সামনে
পেতে রাখা লাল গালিচার উপর ধীর পদক্ষেপে নতমস্তকে এগিয়ে যায় আবু বকর।
সুলতানের সামনে এসে বেদির উপর রাখা মখমলের জুতো পরা সুলতানের দুই পা নজর
করে। এগিয়ে গিয়ে তিনবার কুর্নিশ করে সুলতানের পদচুম্বন করে আবু। সুলতান তার
তরবারি আবুর মস্তকে স্পর্শ করে গম্ভীর গলায় চোস্ত ফার্সি ভাষায় বলেন,
“বিদেশি, কোন উদ্দেশ্যে এই দেশে পা রেখেছ? জবাব সঠিক হলে সসম্মানে জায়গা
পাবে, নইলে ফিরে যেতে হবে নিজের দেশ”
এবার ধীরে ধীরে সুলতানের
মুখপানে চায় আবু বকর। কঠিন এক ভাবলেশহীন মুখ থেকে দুটি নিঃস্পৃহ চোখ তাকে
জরীপ করছে। আবুর শিরদাঁড়া দিয়ে ভয়ের ঠাণ্ডা স্রোত নেমে আসে। দেহরক্ষীদের
ধারালো তলোয়ারগুলো সকালের আলোয় ঝলমল করে উঠছে। আবুর গলা শুকিয়ে আসে। নিজেকে
সংযত করে সে সুলতানকে নিজের পরিচয় জানায়।
“তুমি নাকি মানুষকে রোগমুক্ত করতে পার? সেকথা কী ঠিক?”
আবু প্রচণ্ড ভয় পেয়ে যায়। রোগ মুক্তির কথা সে নিজেও বিশ্বাস করে না।
কিন্তু রোগ প্রতিকারে অপারগতা জানলে সুলতান কী করতে পারেন, সেই আজানা
আশংকায় আবুর মুখ দিয়ে কে যেন বলিয়ে নেয়, “পারি কী না, জানি না মহামহিম। সবই
আল্লার দয়ায় হয়। আমি নিমিত্ত মাত্র।”
সুলতান ঘিয়াসুদ্দিনের মুখে
সামান্য পরিবর্তন হয় না। আবুকে আপাদ মস্তক পর্যবেক্ষণ করে সুলতান বলবন
আদেশ দেন, “এই বিদেশি এখন থেকে দিল্লি বাসের অনুমতি পেল। একে সসম্মানে
যমুনার তীরে পোঁছে দিয়ে আসা হোক।”
সুলতানের দুই পায়ে মাথা হেঁট
করে চুম্বন করতে যেতেই তিনি বাধা দিয়ে বললেন, “আপনি ফকির। সুলতানের পায়ে
চুম্বন করা আপনার শোভা পায় না।“ আবুর মনে হল সুলতানের কঠোর দৃষ্টি
মুহূর্তের জন্য কোমল হয়ে উঠল। তিনবার কুর্নিশ করে পিছিয়ে গেলেন আবু বকর।
আবুর
কুটিরে ফিরে আসবার খবর পেতেই বিক্রম সিং দৌড়ে এল। গলায় তার উদ্বেগ। পিছন
পিছন ছুটে এল নাহার সিং। সে কাঁদতে কাঁদতে ফকিরবাবাকে জড়িয়ে ধরল। আবুর দুই
গণ্ডদেশ অশ্রুসিক্ত। এত ভালবাসা তার প্রাপ্য ছিল! এমন সুখও প্রতীক্ষায় ছিল!
সুলতানের প্রাসাদে আবু বকরের অভিজ্ঞতার কথা লতায় পাতায় ছড়িয়ে
পড়ল একগ্রাম থেকে আর এক গ্রামে। এখন দর্শনার্থীরা আবুর কুটিরে সকাল থেকেই
ভিড় জমায়। সেখানে পক্ষাঘাতগ্রস্ত বৃদ্ধ, সাপে কাটা কিশোরী, কুষ্ঠ রুগী,
সান্নিপাতিক রোগে ভোগা রমণী, সবাই দলে দলে আবুর চিকিৎসার আশ্রয় খোঁজে। আবু
পরিস্থিতির কাছে নিজেকে সপে দিয়ে অসহায় হয়ে ওঠে অন্তরে অন্তরে। রাত জেগে
পুঁথি অধ্যয়ন করে চিকিৎসার উপায় বার করে। বিছানায় নিজেকে ক্লান্তিতে গুঁজে
দিতে দিতে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে তাকে আরও শক্তি দেওয়ার জন্য।
বিক্রম সিং এখন সর্বক্ষণ আবুর সহায়কের কাজে স্ব-সমর্পিত। সে নিজেও
গভীরভাবে বিশ্বাস করে ফকিরবাবার রোগমুক্তির কোনও বিশেষ ক্ষমতা আছে। নাহার
সিং মানুষের ভালবাসার উপঢৌকন সাজিয়ে রাখে ঘরের এক কোণায়। রাতে পাহারাও দেয়
আবুর কুটিরে। আবু নিজেকে আরও বেশি করে পরমেশ্বরের আরাধনায় নিয়োগ করে। জীবন
ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় কাজ তাকে আর করতে হয় না। দৈনন্দিন কাজ করে দেওয়ার
জন্য তার ভক্তেরা নিজেদের মধ্যে এখন রীতিমত প্রতিযোগিতা চালায়।
সুলতানের সেনা আবার আসে। এবার সুলতান ডাক পাঠাননি। আবুর পরীক্ষা নিতে লোক
পাঠিয়েছেন। তিনি এক কলস লোহার তৈরি চানা আর আর এক পাত্রে এঁটেল মাটি পাঠিয়ে
দিয়ে আদেশ দিয়েছেন, আবু যেন সেই লোহার চানা আর মাটির গুড় দিয়ে উপাদেয়
মিষ্টান্ন তৈরি করে সুলতানের কাছে পাঠিয়ে দেন।
সুলতানের সেনারা
যখন আবুর পরীক্ষা নিতে আগত, তখন বিক্রম সিং ভয়ে কম্পমান আবুর কানে কানে
কিছু মন্ত্রণা দেয়। আবুর সাড়া শরীর যেন আসার। সে সভয়ে সুলতানের পাঠানো
লোহার চানা আর মাটির গুড়ে নিজের মৃত্যুর পরোয়ানা দেখতে পায়। বিক্রম সিং
সেনাদের বাইরে যেতে বলে নিজে কুটিরের পিছন দরজা দিয়ে ছুটে যায় গ্রামে।
আবুকে বলে যায়, প্রাণ বাঁচাতে সে যেন জপ করতে থাকে।
পিছন দরজা
দিয়ে মাটির এক পাত্র হাতে কখন যে সে কুটিরে ঢুকেছে আবু তার বন্ধ চোখ খুলে
দেখতেও পায়নি। বিক্রম সিং সেনাদের হাঁক দিতে তারা এসে দেখে সুগন্ধি ধূমায়িত
এক হাড়ি মিষ্টান্ন তাদের সামনে রাখা। সেনারা আবু বকরের পায়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে
বারংবার তার পদচুম্বন করতে থাকে। দুই হাত তুলে আশীর্বাদ জানায় আবু। বাইরে
ফকির বাবার জয়ধ্বনি ওঠে। সেনাদের ঘোড়ার ক্ষুরের আওয়াজ মিলিয়ে যেতে হাত
সাফাইয়ে সরিয়ে দেওয়া লোহার চানা আর মাটির গুড় ঘরের কোণায় দেখিয়ে মুচকি
মুচকি হাসতে থাকে বিক্রম। মনে মনে তার প্রাণ বাঁচানোর জন্য বিক্রম সিং কে
ধন্যবাদ দেয় আবু বকর। আল্লার কাছে প্রার্থনা করে তার দীর্ঘায়ুর।
আবু
বকর এখন আর সাধারণ মানুষ থাকে না। জন্ম নেয় হজরত আবু বকর। সুলতান
ঘিয়াসুদ্দিন সহস্র স্বর্ণ মুদ্রা ভেট পাঠান আবু বকরের জন্য। সুলতানের আদেশে
পাথর আর মাটি দিয়ে তৈরি হয় হজরত আবু বকর পীরের ঠাই। কুটিরের জায়গায়
রাতারাতি নির্মাণ হয় অট্টালিকা। অতিথিশালা নির্মাণ করা হয় যমুনা তীরে। সরাই
খোলা হয় রোগী ও তাদের সহায়কদের জন্য। মাটির পাত্রে চানা আর গুড় দিয়ে তৈরি
মিষ্টান্ন হয়ে যায় ফকিরবাবার প্রসাদ।
হজরত আবু বকরের নাম দিকে দিকে প্রচারিত হয়। দিল্লির মানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে মটকা পীরের দরগা।
Review Comments
সোসাল মিডিয়া কামেন্টস