মাণিক সাহা
মাণিক সাহা
লেখক / সংকলক : iPatrika Crawler
রাবণ ও রিমি দে
দালির বিখ্যাত ছবি মেল্টিং টাইমের কথা বার বার মনে পড়ে যাচ্ছে। সংযোগটা ঠিকঠাক বোঝার চেষ্টা করছি। পারছি না। গলন্ত সময়ের সঙ্গে রিমি দে'র 'রাবণ' এর কোথায় যেন একটা সূক্ষ্ম যোগাযোগ গড়ে উঠেছে! সম্ভব-অসম্ভবের, যুক্তিতর্কের কূটকচাল একনিমেষে মুছে গেছে 'রাবণ'এর কবিতায়। ঠিক যেমন 'মেল্টিং টাইম'! বাস্তব অবাস্তবের প্রচলিত ধারণার বাইরে বেড়িয়ে ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী হওয়া! রং, রেখা, ভাবনা, অভিনিবেশ, তুড়িয় মগ্নতা - সবকিছু নিজস্ব ডাইমেনশনে স্বতন্ত্র। রিমি'র কবিতায় বিভ্রান্তি তাই এক ধরণের জাদু চেতনা যার প্রতিস্পর্ধী হতে গেলে নিজের অস্তিবাদী দৃষ্টিকে আরো বেশি সূক্ষ্ম করে নিতে হয়।
রিমি তাঁর কবিতার বই উৎসর্গ করেছেন চিরস্মরণীয় মাইকেল মধুসূদন দত্তকে। বাংলা সাহিত্যে মধুসূদন প্রথম কবি যিনি প্রচলিত ধারণার বাইরে গিয়ে কবিতা লেখেন। তাঁর মহাকাব্যে নায়ক হিসেবে উজ্জ্বল হয়ে উঠল মেঘনাদ এবং রাবণ। এবং কালক্রমে শক্তিশালী ট্রাজিক চরিত্র হিসেবে বাংলা সাহিত্যে জীবন্ত হয়ে ওঠে রাবণ।
সেই রাবণকে নিয়েই রিমির কবিতায় একের পর এক রোমাঞ্চকর জার্নি-
"চোখ মুখের বিদ্যুৎ সরিয়ে
দশরকমভাবে চুল সাজাচ্ছেন
ঘন কুয়াশার ভিতর গাঢ়তম
রাবণ হয়ে উঠছেন" (আমি ও রাবণ / ১)
রামায়ণ কিংবা মেঘমাদ বধ মহাকাব্যে যে রাবণকে আমরা দেখি, রিমির রাবণ তাদের মত নয়। একেবারেই ভিন্নতর "রাবণ এলিয়ে পড়ছে রাবণের গায়ে / হিসেব ও ইতিহাস দুটোই হচ্ছিল"। মুগ্ধ হতে হয় রিমির স্মার্ট উচ্চারণে। মেদহীন চকচকে প্রাণবন্ত এক একটি কবিতা। তাঁর শব্দের মায়াজালে "রঙিন থেকে রজনীগন্ধায় জল/ হেসে ওঠে।"
রিমির রাবণ কোন নায়ক, খলনায়ক, প্রথা, প্রকরণ বা কোন আইকন নয় বরং সে এক অতিন্দ্রীয় অনুভবের প্রকাশ মাধ্যম। পার্থিব পৃথিবীর রঙে, বস্তুতে, ভাবে সে লীন হয়ে আছে। প্রচলিত সাধন মার্গের সঙ্গে আপাত সম্পর্ক রহিত এই অভিনিবেশ একান্তভাবেই কবির সতঃসৃষ্টি। এই রাবণ সীতাকে হরণ করে না, উগ্র বাসনায় ব্যভিচারী হয় না, এমন কী কোন লড়াই পর্যন্ত করে না। রিমি ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে প্রাপ্ত অনুভূতিকে ইন্দ্রিয়াতীত দ্যোতনায় বিভূষিত করেছেন। কবিতা শব্দের বন্দী দশা কাটিয়ে বহুগামী হয়েছে। কবিতার আকার ক্ষুদ্র হলেও তার প্রকাশ অনিন্দ্য।
মহাকাব্যের চরিত্রগুলি একের পর এক কবিতায় উঠে এসেছে। কখনো যুধিষ্ঠির, কখনো নল -দয়মন্তী, কখনো অর্জুন, কুন্তীর নির্দেশে পাটরানি দ্রৌপদী, পঞ্চ পান্ডব, ব্যাসদেব আরো অনেকেই। খন্ডচিত্রে ফুটে ওঠে মহাকাব্যের দৃশ্য। "যুধিষ্ঠির প্রথমে কৌশিকী ও/ পরে বৈতরণী নদীতে শীতল হলেন/... / সাদা কুকুরটি পথ দেখানো/ শুরু করলে/ যুধিষ্ঠির এগোতে থাকেন।" (মহাভারতের আলো/২)
রিমি এই বইটির প্রায় প্রতিটি কবিতাতেই 'রাবণ' শব্দটি উল্লেখ করেছেন। বেশিরভাগ কবিতাই রাবণের প্রাচুর্যে প্রাণবন্তঃ "তলপেটে যে শূন্যটি রসগোল্লা ছড়াচ্ছে/ তার নাম রাবণ " (হত্যা) আবার অন্য একটি কবিতায় রাবণকে দেখি এইভাবেঃ "কালো ওড়না উড়িয়ে বিরিয়ানি ছড়াচ্ছে/ রাবণ/ রাবণ জুড়ে রাবণের আলো"।
অতীত ও বর্তমানের মিশ্রণ ঘটিয়েছেন রিমি। মহাকাব্য ও পুরাণের পাতা থেকে উড়িয়ে এনেছেন সুবাস, আর সেই সুবাস তাঁর কবিতায় আরো বেশি স্নিগ্ধ হয়ে উঠেছে। পাঠক প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত এই বইটি সাহিত্যের প্রচলিত ধারাগুলিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নতুনতর হয়ে উঠেছে।
রাবণের সিকুয়েল হিসেবে ২০১৫ সালে প্রকাশিত হয় 'অন্য রাবণ', সুতরাং প্রকাশনী থেকে। রিমি লিখছেনঃ "দুইদিকে দুটি শূন্য/ মাঝখানে ভার্চুয়াল রাবণ/...../ মহাভারত আছড়ে পড়ছে রাবণের গায়ে"। যাঁরা একটু অন্যরকম, নতুনতর কবিতা পড়তে চান তাঁরা এই বইদুটি বই পাঠে নিরাশ হবেন না।
রাবণ, রিমি দে, পাঠক প্রকাশনী, মূল্য : ৪০ টাকা
অন্য রাবণ, রিমি দে, সুতরাং প্রকাশনী, মূল্য : ২০ টাকা
Review Comments
সোসাল মিডিয়া কামেন্টস