নীপবিথি




চৈতালি দাস








প্রতিদিনের মত আজও ঠিক সন্ধে সাতটায় শুভ্রর ফোনটা এলো । গত দু - মাস হল এই ফোনটার অপেক্ষায় থাকে গার্গী ‌।সাতটা বাজার আগে থেকেই মোবাইলটা নাড়া চাড়া করে । কখন ও কখন ও আবার  মনে হয় মোবাইল এর রিংটোন টা মিউট করা আছে হয়তো  ,শুভ্রর ফোন বেজে গেছে শুনতে পায়নি । তারপর হাতের মুঠোয় ধরা মোবাইলটা ভালো করে দেখে বোঝে যে এসবই তার মনের ভুল । মোবাইল এর সাউণ্ড একেবারে ম‍্যক্সিমামে  দেওয়া  আছে।





--হ‍্যাঁ , হ‍্যালো শুভ্র বলো বলো ।





-- কাল তো  তোমাদের ওদিকে ভয়ানক ঝড় - বৃষ্টি  হয়েছে দেখলাম । তোমরা ঠিক আছো তো? সকালে নিউজে খবরটা দেখতে দেখতে ভাবলাম অফিসে পৌঁছেই  তোমাকে একটা ফোন করবো কিন্তু অফিসে ঢোকার পর থেকে একটার পর একটা এমন কাজে ফেঁসে গেছি যে ফোন করতে পারিনি, এই জাস্ট পাঁচ মিনিট আগে মিটিং শেষ করে নীচে নেমে সিগারেটটা ধরিয়ে তোমাকে ফোন টা লাগালাম।





-হ‍্যাঁ শুভ্র কাল ঝড়ের এই তাণ্ডবে সারা কলকাতা তছনছ হয়ে গেছে , টিভি তে বলছিল ঝড়টা নাকি প্রায় একশো কিলোমিটার বেগে চলেছিল। আমার তো ভয় করছিলো যে সত্তর বছরের পুরোনো এই বাড়ি না ভেঙে পড়ে ‌। পুরো বাড়িটা কাঁপছিল ঝড়ের দাপটে । আমাদের বাগানে  একটা  আমগাছ ও পড়েছে ,তবে গাছটা বেশী বড়ো নয় বলে তেমন কিছু ক্ষতি হয়নি ।





- যাক, নিশ্চিন্ত হলাম ,তোমাদের তেমন কোনো ড‍্যামেজ হয়নি জেনে। শুনলাম মোট পনেরো জন মারা গেছে এই ঝড়ে , সাংঘাতিক ডিভাস্টেটিং !





-- শুভ্র, ঝড়ের টপিক বাদ দাও এবার। সকাল থেকে এক কথা চলছে ,অন্য কিছু বলো ।কালকের যে গল্পটা মাঝপথে ছেড়ে চলে গেছিলে ওটা কন্টিনিউ করো। 





--ওহ্ ,কোনটা বলছিলাম যেন ? মনে করতে পারছিনা ,একটু ধরিয়ে দাও প্লিজ।





-- তোমাদের পাড়ার প্রভাত ফেরীর গল্পটা বলতে  শুরু করেছিলে কাল।





- হ‍্যাঁ হ‍্যাঁ , বলি শোনো । তখন আমি এইট কিংবা নাইনে পড়ি ।বাবা একদিন সন্ধেবেলায় বললেন কাল সকাল থেকে পাড়ায় প্রভাত ফেরি হবে ,অরুণ কাকার বাড়ির সামনে ঠিক ভোর সাড়ে চারটেয় আমাদের সকলকে পৌঁছে যেতে হবে। 


 বাবার এই কথায় মনে মনে রাগ হলো বেশ ,সবে দুদিন হলো গরমের ছুটি পড়েছে  ,কোথায় নাক ডেকে ঘুমোবো ? তা না ভোর সাড়ে চারটেয় প্রভাতফেরি। তবে বাবার কথা অমান্য করার সাহস কিংবা শিক্ষা কোনোটাই আমাদের ছিলনা। 


পরদিন ভোর চারটেয় বাবা ঘুম থেকে ডেকে দিলেন।ঘুম -চোখ কচলাতে কচলাতে অরুণ কাকার বাড়ির সামনে এসে দেখি পাড়ার অনেক মানুষ জড়ো হয়েছে।


শুরু হলো প্রভাতফেরি । অত সকালে হালকা হালকা ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছিল । ভোরের সূর্যের সেই কোমল স্পর্শ আজ ও ভুলিনি জানো।





-- প্রভাতফেরিতে কি কি গান গাইতে তোমরা?





-- হুমম মূলত ব্রতচারির গান গাওয়া হত ।এখনো মনে পড়ে "হও ধর্মেতে ধীর  ,হও কর্মেতে বীর ,হও উন্নত শির নাহি ভয়" গাইতে গাইতে টানটান হয়ে যেত শিরদাঁড়া  ।সারাশরীরে যে গরম রক্ত খেলছে তা বেশ টের পেতাম ওই ভোরবেলাকার গা শিরশির করা হাওয়ায় । চার -পাঁচদিনের মধ্যেই ভোর বেলাকার প্রভাতফেরি বেশ ভালো লাগতে শুরু করলো। এরকমই একদিন প্রভাতফেরীর শেষে অরুণ কাকা আমাদের সকলকে বললেন , "কাল প্রভাতফেরীর শেষে স্টেশনের দিকের বড়ো মাঠে বক্তৃতা দিতে আসবেন বিশিষ্ট অভিনেতা সমরেন্দ্র বাগচি ,কেউ যেন প্রভাতফেরী শেষে বাড়ি না যায় , সমরেন্দ্র বাবুর বক্তৃতার পর জলখাবারের প‍্যাকেট দেওয়া হবে সক্কলকে।"





এতক্ষণ গার্গী শুধু শুনেই চলেছিল শুভ্রর গল্প, যেমন রোজ শোনে । ভালোলাগে শুনতে ,মনে হয় চোখের সামনে গল্পের প্রতিটা চরিত্রকে দেখতে পাচ্ছে। শুভ্র আবার গল্প বলতে বলতে গুনগুন করে গান গেয়ে ওঠে,এই যেমন আজ ও প্রভাতফেরীর গল্প বলতে বলতে গেয়ে উঠলো ,হও ধর্মেতে ধীর।গার্গী বলে শুভ্রর গলায় গানের মধ্যে একটা গভীর বেদনা আছে ,অনেকটা জগজিতের মত ।এই কথাটা শুনলে শুভ্র লজ্জা পেয়ে বলে, "আরে ,আমি কি আর গাইয়ে? আমি হলাম গিয়ে বাজিয়ে"।


সমরেন্দ্র বাগচির প্রসঙ্গ উঠতেই গার্গী খুব উৎসুক হয়ে বললো- আরে সেই সময় সমরেন্দ্র তো মারাত্মক হ‍্যাণ্ডসাম হিরো,প্রায়  সব মেয়েদেরই আরাধ্য পুরুষ ছিল।ওর  গলার আওয়াজ,তাকানো ,হাসি, সব  ছিল পাগল করা । আমি ওঁর ভয়ঙ্কর ফ‍্যান ছিলাম ,টিউশন ফাঁকি দিয়ে পাড়ার রত্না বউদির সঙ্গে সব কটা সিনেমা দেখতাম। 


বলো ,বলো  সমরেন্দ্রকে কেমন দেখলে ? 





গার্গীর এত উৎসাহ ,উচ্ছ্বাস  দেখে শুভ্র কেমন মিইয়ে গিয়ে বললো শোনো তাহলে।





- সমরেন্দ্র আসার খবরটা আমাদের গড়িয়া অঞ্চল জুড়ে ভালোই ছড়িয়েছিল । খেলার মাঠ উপচে পড়েছিল ভীড়ে। সেখানে প্রচুর গরীব গুর্বোও এসেছিল কোলে কাঁখে বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে। সমরেন্দ্রর গুরু গম্ভীর ভাষণ ওই মানুষগুলো যে কিছুই বুঝতে পারছেনা অরুণ কাকা তা বুঝতে পেরে সমরেন্দ্রকে অনুরোধ করলেন ওদের জন্য দু-চার লাইন কিছু বলতে ,অন্তত একটা ছোট্ট কবিতা যেন ওদের জন্য তিনি শোনান। অরুণ কাকার কয়েকবার অনুরোধ সত্ত্বেও সেদিন সমরেন্দ্র বাগচী  ওদের জন্যে একলাইনও  কিছু বলেননি।সেদিন খুব অবাক হয়েছিলাম জানো! এত বড়ো অভিনতা ওদের উদ্দেশ্যে কিছুই বলতে পারলেননা? এই না বলার কারণ টা তখন বুঝতে পারিনি ছোট ছিলাম বলে।বড়ো হয়ে বুঝতে পেরেছি যে অনেক বড়ো মানুষের মধ্যে অনেক ছোট মন থাকে ,যা চাকচিক্যের আড়ালে ঢাকা থাকে ,কখনো সখনো বেরিয়ে পড়ে সার্টের নীচে গেঞ্জির মতো। হা-হা-হা -হা গার্গী,বুঝতে পারছো?


 বলতে বলতে মোবাইলে টাইমটা দেখে শুভ্র আঁতকে উঠে বললো - আরেব্বাবা অনেক বকবক করে ফেলেছি ।বাজার করে বাড়ি ফিরতে হবে  । ইস্ অনেক দেরী হয়ে গেল।





--এতরাতে আর কিছু সবজী পাবে?





---হ‍্যাঁ ,হ‍্যাঁ এখানে অনেক রাত পর্যন্ত সবকিছু পাওয়া যায় বাজারে, এ হলো দিল্লী বুঝলে।





 --এখন রাখি ।কাল সন্ধে সাতটায় কথা হবে।টা টা।





দিনে দিনে শুভ্রর গল্পশোনার লোভটা গার্গীর বেড়েই চলেছে। একথা সেকথা বলতে বলতে শুভ্রকে খুঁচিয়ে দিয়ে একটা না একটা গল্প আদায় করেই ছাড়ে । শুভ্রর সঙ্গে ফেসবুকেই এই বন্ধুত্ব ।গার্গীর প্রথম থেকেই মনে হয়েছে শুভ্র আলতু ফালতু লোক নয় ।যেকোনো বিষয়েই শুভ্রর আগ্ৰহ আছে ,যে বিষয় ওর জানা সেই বিষয়ে কথা উঠলে বেশ জোর গলায় আলোচনা করে  আর যেটা জানেনা সেটা অকপটে স্বীকার করে যে এটা ওর অজানা। শুভ্রর এই গুনটা গার্গীর খুব পছন্দ ।ওদের দুজনের এই বন্ধুত্বটাকে  একটা ট্রান্সপারেন্ট ছিমছাম ভার্চুয়াল  ফ্রেণ্ড আখ্যা দেয় ওরা।  গার্গী থাকে কলকাতায় আর শুভ্র দিল্লীতে । দুজনে কেউ কাউকে দেখেনি এবং একে অপরকে দেখার আগ্ৰহও প্রকাশ করেনি এই দুমাসে। যেটুকু ফেসবুক কিংবা হোয়াটসঅ্যাপের ছবিতে দেখা ,  ব‍্যস ওই পর্যন্তই। এখন এই চুয়ান্ন ,পঞ্চান্ন বছর বয়সে চোখে দেখার চেয়ে মনের আদান প্রদান এবং একটা সুন্দর বন্ধুত্বই ওদের দুজনের কাছেই অনেক বেশী কাম্য ।





সন্ধে সাতটা বাজার আগে থেকেই গার্গীর ভিতরে একটা উত্তেজনা শুরু  হয়ে যায়, সেই সঙ্গে  মোবাইল নাড়াচাড়াটাও বেড়ে যায় ।গার্গী নিজেকে বোঝায় যে শুভ্রর ফোন ঠিক সময় মত আসবেই তাও কিছূতেই স্থির থাকতে পারেনা ।গার্গী খেয়াল করে দিন দিন  ওর এই ধীর -স্থির  নির্লিপ্ত মনটা কেমন যেন চঞ্চল আর অবুঝ হয়ে যাচ্ছে। গার্গী মনে মনে হাসে আর ভাবে এই হলো বয়সের ভিমরতি।





--হ‍্যাঁ ,হ‍্যালো ,বলো ,শুনতে পাচ্ছো? হ‍্যালো ,হ‍্যালো --





-হুঁ ,তুমি যেখানে আছ সেখানে সিগনাল পুওর , কথা কেটে কেটে যাচ্ছে।





-- দাঁড়াও দাঁড়াও এক মিনিট অপেক্ষা করো, হ‍্যাঁ এবার শুনতে পাচ্ছো?





--হ‍্যাঁ এবার একদম ক্লিয়ার ,পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছি। আজ এখানে মনে হচ্ছে বৃষ্টি আসবে , খুব মেঘ করেছে আর হাওয়াও দিচ্ছে।





- ও তোমার ওখানেও মেঘ করেছে ? এখানেও মেঘ করেছে ঝড় উঠবে মনে হচ্ছে । বাব্বা পরশু যা হয়ে গেল সেরকম তুমুল  ঝড় হলে তো সর্বনাশ। ভয় করে বাড়িটা না ভেঙে পড়ে মাথায়।





-- আচ্ছা, রোজ রোজ বাড়ি ভেঙে পড়ার কথা বলছো ,বাড়িটার যখন এতই দুরবস্থা তখন রিপিয়ার করাচ্ছোনা কেন ? সত্যি তো ,এত আনসেফ কন্ডিশনে ওই বাড়িতে থাকার কোনো মানে আছে? 





-- হ‍্যাঁ শুভ্র তুমি ঠিক বলেছো ,এই বাড়িতে থাকলে যেকোনো বড়োসড়ো দুর্ঘটনার কবলে পড়বো ,কিন্তু আপাতত এই ভাবে থাকা ছাড়া কোনো উপায় নেই ।সে অনেক কথা , এখন ওইসব শুরু করলে আমাদের গল্পের সান্ধসেশন টা খারাপ হয়ে যাবে।





--- গার্গী, এখানে ধুলোর ঝড় উঠলো তার সঙ্গে টিপ টিপ করে বৃষ্টিও শুরু হয়েছে ।দাঁড়াও গাড়িতে  গিয়ে বসি। দিল্লীতে এই এক মুশকিল বৃষ্টি আসার আগের এই ধুলোর ঝড়টা উঠলে কালো মেঘের ইম্প‍্যাক্টটাই নষ্ট হয়ে যায়।





--ওটাকে তো আঁধি বলে ,তাই না?





-হ‍্যাঁ ,খানিকটা । আচ্ছা গার্গী তুমি ওই গানটা জানো?





-কোনটা?





-ছায়া ঘনাইছে বনে বনে?





-হ‍্যাঁ শিখেছিলাম ।





-একটু গাও তো।





---শুভ্র ,প্রায় তিরিশ বছর আগে গান ছেড়ে দিয়েছি ,এখন গানের কথাগুলো মনে নেই ,সুরটা মনে আছে। 


হঠাৎ এই গান?





-আরে ,তুমি দুলাইন গাও না ।





বলতে বলতে শুভ্র নিজেই গেয়ে উঠলো ,"কবে নব ঘন বরিষণে গোপনে গোপনে এলি কেয়া----" । গার্গী গাইতে গিয়েও থেমে গেল, শুভ্রর গলায় গানটা অপূর্ব শোনাচ্ছিল ,জানলার পর্দা সরিয়ে দেখলো কালো মেঘে আকাশ ছেয়ে আছে , বৃষ্টি আসবে খুব জোরে , জানলাগুলো বন্ধ করতে ইচ্ছে করলোনা ,মনে হল আজ সবকিছু ভিজে যাক। ওদিকে শুভ্র গান থামিয়ে কিছু বলে চলেছে-





-রবি ঠাকুর কি সব সৃষ্টি করে গেছেন বলোতো ! এই সব গান সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ আধুনিক গান বলে আমার মনে হয়।





- হ‍্যাঁ শুভ্র, আমি তো এই গানকে আঁকড়ে ধরেই বেঁচে আছি।তবে আজ হঠাৎতোমার  এই গানটা কেন মনে পড়লো বলো তো?





- হুম, বহুদিন পর আজ এই গানটা মনে পড়ে গেল।


শোনো তাহলে একটা মজার গল্প বলি।





গার্গী বুঝতে পেরেছিল ওই গানের পিছনে নিশ্চই কোনো গল্প আছে শুভ্রর । এই দুমাসে শুভ্রর  এই ছোটখাটো ব‍্যাপার গুলো গার্গী আঁচ করতে পারে। সখ‍্যতার সঙ্গে সঙ্গে বোঝাপড়াটাও গভীর হচ্ছিল দুজনের মধ্যে। এই সময় শুভ্রকে একটু উসকে দিলেই যে আজ সন্ধের গল্প -সেশনটা জমে যাবে তা গার্গী খুব ভালোই জানে আর হলও তাই, শুভ্র গল্প করলো।





- --আমি যে বরাবরের গান পাগল তা আমার সব বন্ধুরা জানতো তাই কেউ কোথাও গানের আসরের খবর পেলেই আমাকে জানাত।এরকম একদিন চন্দন বললো শুভ্র আজ আমাদের পাড়ায় যাবি ?আমাদের বাড়ির কাছেই একজন গানের মাস্টারমশাই থাকেন। তিনি নিজের বাড়িতেই রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখান । আমি আসা যাওয়ার পথে গানের ক্লাস চলাকালীন যখনই গানগুলো শুনি তোর কথা মনে হয় ,ভাবি তুই শুনলে খুব খুশী হবি। চল ,এখন যাবি ? আজ শনিবার অনেক রাত পর্যন্ত মাস্টারমশাইএর গানের ক্লাস চলে।





---তুমি নিশ্চই তোমার বন্ধুর সঙ্গে চললে গান শুনতে?





--- সে তো তুমি জানোই আমার গান শোনার পাগলামি । হ‍্যাঁ , মনে আছে , সেদিন আকাশ মেঘলা ছিল ,মনে হচ্ছিল মুষলধারে বৃষ্টি আসবে কিন্তু চন্দনের কথা শুনে মনে হলো  এই সুযোগ ছাড়লে মিস্ করবো, তার উপর আবার রবিঠাকুরের গান । ঝড় -বৃষ্টি যাই হোক না কেন যেতেই হবে মাস্টারমশাইয়ের গানের ক্লাসে। বিকাশ ও ছিল আমাদের সঙ্গে ওকেও সঙ্গে নিলাম।





-তারপর ?





-চন্দনদের সঙ্গে মাষ্টারমশাইয়ের  ভালো হৃদ‍্যতা ছিল। চন্দনকে দরজার সামনে দাঁড়াতে দেখেই উনি বললেন,"আয় ,আয় ভিতরে এসে বোস্ ।এই গানটা শেষ হলে কথা বলছি । আমরা তিনজন ক্লাস ঘরে ঢুকলাম,ঢুকেই দেখি ঘর ভর্তি মেয়ে আর একজন কি দুজন মাত্র ছেলে ।অতগুলো মেয়েকে দেখে আমি তো জড়োসড়ো হয়ে গেলাম ,তবে আমার উদ্দেশ্যতো গান শোনা অত‌এব জড়তা সহকারেই মাষ্টারমশাইএর বাঁদিকের ফাঁকা জায়গাটায় সতরঞ্চির উপর মাথানীচু করে বসে পড়লাম । পাশে বিকাশ আর চন্দন ও বসলো। সামনে গোল , মানে ঠিক হাফ সার্কেল করে সব মেয়েরা বসে আছে  তিন-চার হাত দুরত্বে ।


  


-মেয়েদের দেখে এত লজ্জা পেতে তুমি? 





-আসলে আমি বরাবর বয়েজ স্কুলে পড়েছি ,তারপর তখন সদ্য সদ্য  ইঞ্জিনিয়ার়িং  কলেজে ঢুকেছি ,সেখানেও  মেকানিক‍্যালে খুব কম মেয়ে ছিল তাই মেয়েদের কাছে জড়তাটা তখনো কাটিয়ে উঠতে পারিনি।





-  ক্লাসে কি গান শেখানো চলছিল সেদিন?





-না, কোনো পার্টিকুলার একটা  গান শেখানো হচ্ছিলনা । রবীন্দ্রজয়ন্তীর অনুষ্ঠানের রিহার্সাল চলছিল । যদ্দুর মনে পড়ছে ঋতুরঙ্গের রিহার্সাল চলছিল।





-- ইস সামনে এতগুলো মেয়ে বসেছিল ,কাউকে পছন্দ হলোনা তোমার?ভীষণ  বেরসিক ছিলে তো তুমি?





--গার্গী ,আগে পুরো গল্পটা আগে শোনো ,তারপর কনক্লুশনে এসো।





--আচ্ছা বাবা সরি, চুপ করলাম ,বলো এবার।





--মাস্টারমশাই এবার একটি মেয়েকে ইশারা করে বললেন এবার তোমার গানটা গাও। মেয়েটি গান ধরলো "ছায়া ঘনাইছে বনে বনে----"  আমি সেই গান শুনে চমকে উঠলাম ,এর আগে রবি ঠাকুরের কত গান শুনেছি কোনো গান আমাকে এইভাবে আকৃষ্ট করেনি। মেয়েটি গেয়ে চলেছে ,"যে মধু হৃদয়ে ছিল মাখা,কাঁটাতে কিভয়ে দিলি ঢাকা,বুঝি এলি যার অভিসারে ,মনে মনে দেখা হল তারে ,আড়ালে আড়ালে দেয়া নেয়া------"


আমার সব জড়তা কাটিয়ে আমি তখন মেয়েটির দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছি।শ‍্যামলা গায়ের রঙ, লম্বা বিনুনি ,হলুদ তাঁতৈর শাড়ি -এ সব কিছুই গানের মতই সুন্দর হয়ে আমার মনে ধরা দিচ্ছিল ধীরে ধীরে।





-- তারমানে তুমি প্রেমে পড়ে গেলে ওর গান শুনে?





--হ‍্যাঁ গার্গী তাই ,আমার ওই আঠারো-উনিশ বছর বয়সে এর আগে এমন করে কোনো মেয়ে আমাকে মুগ্ধ করেনি।সত্যি সত্যি প্রেমে পড়ে গেলাম ওর গান শুনে।





-- এ তো দারুণ ব‍্যাপার ,তা সেই সৌভাগ্যবতীর নাম কি শুনি।





--নীপবিথি।





-বাহ্,সুন্দর নামতো!





--ধুর, নাম জিজ্ঞেস করেছি নাকি, এই নামটা আমিই রেখেছিলাম মনে মনে ।সেদিন গান চলতে চলতে এমন বৃষ্টি এলো যে সব হুড়োহুড়ি করে যে যার বাড়ি চলে গেল। তাছাড়া কথা বলার সুযোগ পেলেও হয়তো বলতে পারতামনা। আমি তখন ওর গান শুনে টোটালি হিপ্নোটাইজড্ ,বাকরূদ্ধ।





- -উফ্ ,তুমি এত রোমান্টিক ছিলে ভাবা যায়না ।তারপর আর খোঁজ করলেনা ওর?





---চন্দনকে বললাম যে ওর গান আমার খুব ভালো লেগেছে আর একদিন চল গানের ক্লাসে।চন্দন আর বিকাশ আমার এমন পিছনে লাগলো যে আর যাওয়াই হলনা।





--আর একবার চেষ্টা করলে তো পারতে ।


--- ওটা বোধহয় আমার ভাগ্যেই ছিলনা বুঝলে।এইঘটনার ঠিক একবছর পর নীপবিথির খোঁজে গিয়েছিলাম মাস্টারমশাইয়ের গানের স্কুলে কিন্তু নীপবিথিকে খুঁজে পাইনি।কাউকে জিজ্ঞেস করতেও পারিনি ওর কথা।আমার লাজুক স্বভাব এর জন্যে দায়ী।





-- ইস্ ,এত সুন্দর একটা লাভ স্টোরি শুরুতেই শেষ করে দিলে? আচ্ছা গানের স্কুলটা ঠিক কোথায় ছিল ?





--ওটা নাকতলায় । বান্টি সিনেমা আর পেট্রোল পাম্পের মাঝের গলিটায় ঢুকে একশো মিটার মত এগিয়ে ঠিক ডানহাতে বাড়িটা।





-মাস্টারমশাইএর কি নাম ছিল বলোতো?





--মণিশঙ্কর বন্দোপাধ‍্যায় ,চন্দন মণিকাকা বলে ডাকতো।





--তারপরের গান ছিল ,"এসো নীপবনে ছায়াবীথিতলে এসো করো স্নান নবধারাজলে---"





--হ‍্যাঁ গার্গী ,একদম ঠিক ধরেছো ,ঠিক ওই গানটাই গেয়েছিল সেদিন নীপবীথি এবং সেদিন ওই গানটা আমি প্রথম শুনেছিলাম,এর আগে এই গান কখনো শুনিনি মনে আছে । গানটার কি ব‍্যপ্তি!  মন্দ্র সপ্তক থেকে তার সপ্তক পর্যন্ত চমৎকার বিস্তার  আর তেমন অবলীলায় গেয়ে চলেছিল নীপবিথি,"দাও আকুলিয়া ঘনকালো কেশ ,পরো দেহঘেরি মেঘনীলবেশ কাজলনয়নে----"


কিন্তু গার্গী তুমি কিকরে জানলে সেদিনের এই গানের কথা!





সান্ধসেশনের মাহেন্দ্রক্ষণে গার্গী  উদাত্ত গলায় গেয়ে চলেছে ,"এসো নীপবনে ছায়াবিথিতলে এসো করো স্নান নবধারাজলে---আজি ক্ষণে ক্ষণে হাসিখানি সখী অধরের নয়নে উঠুক চমকি----"।





শুভ্র গাড়ির সীটে বসেই ল‍্যাপটপটা অন করলো--কাল সকালের ফার্স্ট ফ্লাইটে কলকাতার একটা টিকিট খুব জরুরী।