কাজললতা

রীতা বিশ্বাস পাণ্ডে




আজকে আমি একটি কাজল লতার কথা বলবো । কাজললতাটার বয়েস একশো    বছরের ও বেশী। একশো বছরের ও বেশী কেন? তবে কি এটা আমার নয় অন্য কারো ? হ্যাঁ, এটি আমার ঠাকুর্মার ছিল।  কি ভাবে এটি ঠাকুর্মা থেকে আমার কাছে এলো? সে কথাতেই আসছি। 

আমার বাবার জন্ম ১৯১৪ সালের ১৪ই জুন। আর সেখানেই প্রশ্ন। বাবার জন্ম যদি ১৯১৪ সালে হয়ে থাকে তবে কাজললতাটা আমার ঠাকুর্মা নিশ্চয় ১৯১৪ সালে   পাননি। কারণ বাবার কাছে শোনা ঠাকুমার বিয়ে  হয়েছিল কুরি বছর বয়সে। সেইসময় এই কাজল লতাটা ওনাকে দেওয়া হয়। এখন চলছে ২০১৯ সাল।    তারমানে ঠাকুর্মার জন্ম হয়েছিল ১৮৯৪ সালে। আর ১৯১২ সালে উনার বিয়ে হয় তৎকালীন চট্টগ্রামের বিখ্যাত জমিদার  রায় বাহাদুর বিশ্বাস বংশের বৃটিশ গর্মেন্টে  চাকরী করা অফিসার উকিল ছেলে  মনোমোহন বিশ্বাসের সাথে।  দেখতে অপরূপ সুন্দরী মনোরমা দেবী। ঢাকার ক্যাথোলিক স্কুল থেকে পড়াশুনা করা।   

বাবারা তিন ভাই এক বোন।  বড় ভাই মানে আমার জ্যাঠামশাই ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ  করেই চলে গিয়েছিলেন কান্দাহারে। তারপর উনি আর দেশে ফেরেননি।সে অন্য গল্প। 

এখন আসা যাক  কাজললতার গল্পে। ১৯১২ সালে ঠাকুর্মার বিয়ের ডালা যখন সাজানো হল তখন নাকি এই কাজললতাটাও বাহারী নকশা করা ডালাতে বিভিন্ন  জিনিষের সাথে রাখা হয়েছিল।বিয়ের ডালা নাকি আবার দুইটি পরিবারের সম্পর্ক শুরুর প্রথম ধাপ। তাই ডালা বা তত্ব গুলোতে নিজেদের রুচি-পছন্দ ফুটিয়ে তুলতে খুব উৎসাহী থাকে দুই পক্ষই। গায়ে হলুদের আগে ডালা পাঠানোর রীতি চিরন্তন। কাজেই এখানে সে কথায় যাচ্ছি না। 

১৯১২ সালে যদি ঠাকুর্মার ডালাতে এই কাজললতাটা দেওয়া হয় তবে হিসেব করলে  দেখা যাচ্ছে এটির বয়েস ১০৭ বছর! 

এখন আসি আমার কথায়। এই বিদেশে আমি কাজললতাটাকেই আঁকরে ধরে রেখেছি  কেন? আমার বাবা যেমন জমিদার বাড়ীর ছেলে ছিলেন ঠিক তেমনই আমার পিসেমশাই হরমোহন দাশ ও একজন দুর্ধর্ষ জমিদার ছিলেন।তাঁর প্রতাপে নাকি বাঘে গরুতে এক ঘাটে জল খেত। এটা কি কথার কথা ছিল নাকি সত্যিই খেত তা আমার জানা নেই। এটার সত্যটা প্রমান করার জন্যে কেউ বেঁচে আছেন কিনা সেটাও আমার জানা নেই। বড় হয়ে এসব আবার শোনার মত মানসিকতা ছিল না এখন যখন জানতে ইচ্ছে করে আবার নতুন করে তখন কেউ ইতিহাস শোনাবার জন্যে বেঁচে নেই।বাবার কাছে এও শুনেছি , হরমোহন দাশ যে দূর্গা পূজা করতেন সেখানে নাকি রসগোল্লা খাওয়ার প্রতিযোগিতা হত। যে সব চাইতে বেশী খেতে পারত তাঁকে নাকি একটা সোনার লোটা বা কলসি দান করা হত।সোনার কলসি! আমি তো ভাবতেই পারছি না। এখন হয়েছে কি বাবা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে ভারতে চলে আসলেন। তখন ও অবশ্য দেশ ভাগ হয়নি। চারিদিকে স্বদেশীদের হাঁকডাক। একা প্রবাসী বাবা তাঁদের ডাকে সাড়া দিয়ে স্বদেশীদের সাথে যোগদান করলেন।ঠাকুর্মা  অনেক বোঝালেন। ঠাকুর্মা চান বাবা পড়াশুনা করে বাপ ঠাকুর্দার মতো ব্রিটিশ রাজের উচ্চ পদস্ত অফিসার পদে নিযুক্ত হন। জমিদারী বুঝে নিক আর বাবা চান  স্বদেশী হতে।ফলাফল  কি হল?ঠাকুর্মা বাবার উপর রাগ করে বসে থাকলেন ।দুজনের মনোমালিন্যের মাঝখানে বাবা আরও ঝাঁপিয়ে পড়লেন আন্দোলনে। সেই সময় বাবার সাথে জ্যোতি বসুর ও দেখা হয়েছিল। স্বাধীনতা পাওয়ার জন্যে উম্মুক বাবা সংগ্রামের শুরুতেই কোলকাতাতে ব্রিটিশদের হাতে ধরা পরে গেলেন। এক মাসের বার্মা জেল। হরমোহন দাশ এটা জানতে পেরে বাবাকে ছাড়িয়ে নিয়ে এলেন ।এবং ব্রিটিশ শাসকদের আসস্থ করলেন যে অপরিপক্ক বয়সে একটা ভুল হয়ে গেছে ,ছেলে এবার পড়াশুনাতেই মন লাগাবে। হল তাই। হবে নাই বা কেন? বড় ছেলের দেশ ত্যাগ, স্বামীর মৃত্যু এসব ঠাকুর্মাকে প্রায় আধমরা করে ফেলেছিল এবার মেঝো ছেলে প্রভাস রঞ্জনের জেল যাত্রার খবর শুনেই উনি সেই যে আরাম কেদারাতে হেলান দিয়ে বসলেন সেটার থেকে আর উঠলেন না। ছোটছেলে তখন স্কুলে। বাড়ীর দিওয়ানজি কোনমতে হরমোহন দাশের সাথে মিলে জমিদারি সামলাচ্ছে। বাবার পড়শীরা  জমিদারি অনেকটাই দখল করে নিয়েছেন। এমতাবস্তাই ঠাকুর্মাকে আর বাঁচানো গেল না।বার্মা থেকে সোজা দেশের বাড়ীতে গেলেন।মাকে শেষ দেখা হল না। কাঁদতে কাঁদতে ঘর ছাড়বেন। হরমোহন দাশ বললেন “থেকে যা”। বাবা বললেন, না ,যে দেশ আমার  থেকে সব ছিনিয়ে নিল সেখানে আর থাকা নয়”। একলা বাবাকে সব ছেড়ে দিয়ে পড়াশুনাতেই মনোনিবেশ করতে হয়। অবিভাবক তখন আর কেউ না হরমোহন দাশ।  এইসময়টাতে আত্মীয় স্বজনদের ভয়াবহ রূপ বাবা আজীবন মনে রেখেছিলেন। জ্ঞাতি  আর পড়শীরা সব কিছু দখল করে নিচ্ছে।  জমিদারীর কোন কাগজ পত্র পাচ্ছেন না।(  ১৯৭১ –এ যুদ্ধের পর অনেক কাগজ পত্র এসেছিল শুনেছি বাবার কাছে বাবার সাইনের জন্যে। বাবা সেগুলি সাইন করে পাঠিয়ে দেন।) পড়াশুনা হল চাকরী হল এম.ই.এস.-এ।তারপর অনেক ঘটনা ঘটেও গেল। এবার হরমোহন দাশ উঠে পরে লাগলেন বাবার বিয়ে দেবার জন্যে। বিয়ে হল সেযুগের বিখ্যাত দত্ত বাড়ীর একেবারে কনিষ্ঠ কন্যা অনামিকা দত্তের সাথে। অনামিকা দত্ত নাকি এমন শ্যামলা সুন্দরী ছিলেন যে মুসলমানেরা বলতো, “ বিয়া করুম তো দত্ত বাড়ীর মাইয়াকে”।বড় মামার কাছে শোনা কথা। 

তবে এখানে কাজললতাটার কি হল। হরমোহন দাশ ডেকে পাঠালেন  বাবাকে,  “তারাতারি আয় মেয়ে দেখে যা। ঢাকার মিশনারি স্কুল থেকে মেট্রিক দিয়ে দেশে  ফিরেছে। সাঁতারে গোল্ড মেডেল পাওয়া। দেরি করলে মেয়ে  হাত ছাড়া হবে। দেশের অবস্থা ভাল নয়। এখন তো আবার পূর্ব পাকিস্তানে মুসলমানদের রমরমা অবস্থা। মেয়েকে অবিবাহিত রাখা যাবে না। ওঁর ভাইয়েরা তারাতারি বিয়ে দিতে চান”। বাবা কি করেন? একা মানুষ! জীবন তো কাটাতে হবে।সংসার চালানোর কেউ চাই। গেলেন মেয়ে দেখতে দেশের বাড়ীতে। তারপর? যেদিন শেষ বারের মত  দেশত্যাগ করবেন খুব কাঁদছিলেন বাবা। শেষবারের মতো মায়ের ঘরে গিয়ে ঢুকলেন। বিশাল ড্রেসিং টেবিলটার উপর ঠাকুর্মার ছোটখাটো সখের জিনিষ সেই আগের মতই রাখা। এখন সেগুলো  ধূলি গায়ে মেখে পরে আছে ।কেউ দেখার নেই। ধুলো ঝেড়ে নিয়ে কতগুলো জিনিষ বাবা নিজের প্যাঁটরাতে রাখলেন। এর মধ্যে ছিল অত্যন্ত সুন্দর বর্মি বাক্স। যেটার মালিকানা পাওয়ার জন্যে পরবর্তিকালে আমরা ভাই বোনেরা মায়ের কাছে অনেক বাইনা করেছিলাম।আর সঙ্গে এনেছিলেন ছোট্ট হাতির দাঁতের একটি নারী মূর্তি,একটি কালো পাথরের শ্রীকৃষ্ণের মূর্তি, আর ছিল ছিল এই কাজললতা! নতুন বউয়ের সাথে মায়ের স্মৃতিগুলো জড়ো করে আসলেন এই দেশে।  তারপর এদিক ওদিক ট্র্যান্সফার হয়ে হয়ে আসলেন শেষে শিলঙে। এতো সুন্দর পাহাড়ি শহর দেখে এখানেই ডেরা গাড়লেন।আর সেখান থেকেই দুবছর অন্তর এদিক ওদিক ট্র্যান্সফার নিয়ে চাকরী করতে লাগলেন। জীবন শৈলী একজন ইংরেজ অফিসার থেকে কোনমতেই কম নয়। এদিকে বাড়ীতে বউ অনামিকা একা। না না অনামিকা নয় কৃষ্ণা! বাবা বিয়ের পর নাম দিয়েছিলেন কৃষ্ণা বিশ্বাস। দেখতে শ্যামলা তাই কৃষ্ণা । তারপর রিটায়ার্ড হবার সময়।  হলেন। হাসি খুশিতে কিছুদিন কাটালেন।

১৯৮৬ সালে একবার কোলকাতাতে শ্বশুর বাড়ী গেলেন।সেই প্রথম বাবার শ্বশুর বাড়ী যাওয়া। বাবা সব ত্যাগ করেছিলেন আগেই বলেছি।  ফিরে যখন আসলেন একেবারে অন্য মানুষ। সেই প্রথম ত্যাগী বাবাকে দেখলাম জীবনের প্রতি অসম্ভম মায়াতে জড়িয়ে পড়তে। দত্ত বাড়ীর সবাই তখন কোলকাতাতে বিশাল বিশাল অস্তিত্ব নিয়ে বসবাস করছে। তাই দেখে কি বাবার ঐ পরিবর্তন।আনমনা একটা হেরে যাওয়া মানুষ যেন।মাঝে মধ্যে বাবার কাছে গিয়ে বসতাম আর সেই সময় বাবার মুখে বাবার  অতীতের এইসব ঘটনা শুনতাম।যদিও তার আগেই মায়ের কাছে কিছুটা শোনা ছিল। কাজেই বেশী কিছু নতুনত্ব ছিল না বাবার ইতিহাসে। আর তখন থেকেই শুরু হল আমার ব্রাসো দিয়ে সব পুরানো সো পিস গুলোকে  ঝকঝকে করে রাখা।একদিন কাজের জন্যে বাবার কাছে ক্যাসিনো ক্যালকুলেটর  চাইলে পর আমার রিটায়ার্ড বাবা সেটা আমাই দিয়েই দিলেন। খুব আনন্দ হল। খুশীর চোটে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে চোখ পড়ল বাবার বুক শেল্ফে রাখা কাজললতাটার উপর।চেয়ে বসলাম বাবার কাছে কাজললতাটা। দুটো কাজললতা রাখা    ছিল পাশাপাশি। একটি খুব কারুকাজ করা ছোট যেটা কিনা ছিল মায়ের আর একটু বড়টা ছিল ঠাকুর্মার। বাবা উঠে ঠাকুর্মার কাজললতাটা আমাই দিয়ে দিলেন । আর  দিলেন হাতীর দাঁতের সেই ছোট্ট সুন্দর নারী মূর্তিটা। তারপর! তারপর অনেক যায়গাতে ঘুরেছি থেকেছি।এই যমুনা দিয়ে অনেক কালো জল বয়ে গেছে। অনেক স্মৃতি বিছিন্ন হয়ে গেছে কিন্তু কাজললতাটা আজও আমার সো কেস আলো করে থাকে। মনে করিয়ে দেয় এক দেশে এক জমিদার  গিন্নী ছিলেন!  


( সত্য ঘটনা অবলম্বনে)