নানারকম চরকা












কথাটা হল নিজ চরকায় তেল দাও গিয়ে, অন্যের চরকার স্পাইকের গতিবিধি তো তোমার জানা নেই, তা ছাড়া তেল দেওয়ার পর সে যদি নিজ চরকা ফেরত চেয়ে বসে তবে তেলও গেল, পরিশ্রমও গেল। কিন্তু সে যদি তার চরকায় প্রস্তুত সুতো জড়ো করে এনে বলে, এ দিয়ে তোমাকেই টুপি বানিয়ে দিতে হবে, তখন কিন্তু জীবনের অনেক কিছুই ওলোট পালট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। তাই নিজের আয়নায় মুখ দেখা ভালো, কিন্তু ঘাড়ের পাশ থেকে যদি আরও একটি দাঁত কেলানো হাসি, যা বিব্রত করে,  আয়নার কাচে দেখা যায় ত হলে অ্যাকশনটা একটু চেঞ্জ করা ছাড়া কোনও উপায় আপাতত দেখি না।  প্রথমত ভেবে দেখা দরকার আমি কী রকমভাবে বেঁচে আছি, আমার পরবর্তী পদক্ষেপ শুধু কি আমার নিজের উপরেই নির্ভরশীল, আমার নেক্সট সিগারেট ঠিক শেষ হয়ে যাওয়ার মুহূর্তে কেউ কি এসে কাউন্টার চাইতে পারে বা কেউ আর সিগারেট খেয়ো না, এই বলে ফিল্টারের মুখে লেগে থাকা তখনও অবশিষ্ট পুড়তে চাওয়া তামাকটাকে কেড়ে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারে রাস্তায়, নর্দমায়, নাকি একজন সদ্য হায়ার সেকেন্ডারি পাশ হওয়া সেলসম্যান হাসি হাসি মুখে একটা অন্য ব্র্যান্ডের সিগারেট এগিয়ে দিয়ে বলতে পারে, স্যার, এটা আমাদের কোম্পানি নতুন বের করেছে, একবার টেস্ট করে দেখুন স্যার, আর আপনার ফিডব্যাকটা দিন, হাতে বাড়ানো তার একটা ফর্ম, সেখানে সে আমার নাম, জন্মতারিখ, প্রিয় ব্র্যান্ড, ফোন নাম্বার এইসকল যাচ্‌ঞা করছে ! এই সমস্ত কিছু, এই কাউন্টার খাওয়া বন্ধুর আমার প্রতি সখ্যতা অথবা ফোকটে সিগারেট খাওয়ার অভ্যাস, এই কেড়ে নেওয়া মানুষটির আমার প্রতি ভালোবাসা অথবা নির্ভরশীলতা, এই সেলসম্যানের রিপোর্ট ভর্তি করে তাড়াতাড়ি বাড়ি যাওয়ার অভিপ্রায় অথবা তার বাবার অসময়ে রিটায়ারমেন্টের পর রাস্তায় দাঁড়ানোর বাধ্যবাধকতা সমস্ত কিছু আমার দু’আঙুলের মাঝে ধরে থাকা বস্তুটির স্বাদ এবং আত্মাহুতির সময় তথা পরিবেশকে প্রভাবিত করছে। এমন কী তার তামাক, তার ইতিহাস, তার চাষ এবং চাষী, তার ফিল্টারের হলুদ বা সাদা, তার মার্কেটিং, তার বিরুদ্ধবাদী নো স্মোকিং সব সমস্ত ; দেখতে দেখতে পরের চরকার চাকার এক কোণ দিয়ে তেল গড়িয়ে আসে।  সিগারেট ক্রমে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চরকার সুতো ওগরাতে থাকে।




কলেজ লাইফের সিগারেটের অর্থনীতি নির্ভর করত টিউশনের টাকার ওপর, তার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নির্ভর করত শৈশব থেকে কৈশোর পেরিয়ে বড়ো হয়ে ওঠার প্রণালীর ওপর, যে কারণে নন্দন সিনেমা হলে বড়ো বড়ো পর্দায় ফেলুদাকে আঙুলের ফাঁকে চার্মিনার ধরাতে দেখে গা শিরশির। সেই প্যাকেটের গায়ে যে ছবিটি থাকত, চার্মিনার, সেখানে গিয়ে সেই স্থাপত্যের নিচে দাঁড়িয়ে চার্মিনার সিগারেট খাওয়ার উত্তেজনা আমাদের সামাজিক প্রেক্ষাপট বর্ণনা করে আর আমরা হতবাক হয়ে দেখি যে কত মানুষকে আমরা সারা জীবনেও চিনে উঠতে পারিনি, কত অতীত আমাদের ইতিহাসে নেই, অথচ সেই সব অতীত, সত্য অতীত, বিভ্রান্ত করার মতো মিথ হয়ে গপ্পো হয়ে গড়ে ওঠা অতীত আমাদের বর্তমানকে আচ্ছন্ন করে, আমাদের বিভ্রান্ত করে। সিগারেট হয়ে ওঠে রাজনৈতিক, তা-তে চার্মিনার আঁকা আছে। চার্মিনারের নিচে গড়ে ওঠে ভাগ্যলক্ষ্মী মন্দির, ক্রমে জাগ্রত হয়ে ওঠে দেবী এবং তা-কে ঘিরে পুনঃ পুনঃ দাঙ্গাও সংঘটিত হয়েছে বলে শোনা যায়। এইভাবে চরকা ঘুরতে থাকে এবং সে দেখিয়ে দেয় চার্মিনার খাওয়ার অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটটিও। তার সময়কাল, যখন টিউশনের টাকা ; তখন মধ্যবিত্ত বাবা মায়েদের হতে এত টাকা এসে যায়নি,  যখন বাজার এমন উন্মুক্ত হয়নি। এমনকী এখান থেকে সে খানিকটা স্বাস্থকেন্দ্রও ঘুরে আসে এবং ল্যাংটো চার্মিনার কোমরে ল্যাঙট পরিধান করে। মধ্যবিত্ত ক্রমে মেডিক্লেম করতে থাকে, সে সহসা বুঝে ওঠে স্বাস্থ্য খানিকটা সম্পদও বটে। অথচ দেশের সমস্ত মানুষের কাছে যে সুস্থ সুন্দর জীবানুহীন পানীয় জল পৌঁছে দেওয়া একটি কর্তব্য সে জলপান অবাক পথিকের কাছে অধরা থেকে যায়। সম্পদ বিনে স্বাস্থ্য দুর্মূল্য হয়ে ওঠে। ঘুমড়ি থেকে মামারা আসে চরকাকে দেখতে, চরকা দক্ষিণ আফ্রিকার গল্প শোনায় আর কাগজে চরকার বিয়ের জন্য স্বজাতির পাত্র খোঁজে তার বাবা।



     


আর ইদিকে পূর্ব দেশে যা কি না ম্লেচ্ছ দেশ, তারা ইলিশের দাম শুনে বলে, কই, আমাদের সময়ে তো হাবুদের বাড়িতে ইলিশ ভাজলে আমাদের বাড়িতে গন্ধ ছুটে আসত। তারা হা হুতাশ করে ইলিশে গন্ধ নেই বলে, আর সমস্ত চাকরি সমস্ত ব্যবসা সমস্ত বড় বড় কলেজের অ্যাডমিশন ছাতুদের হাতে চলে গেছে বলে আরো আরো নিতম্বপ্রদেশের খাঁজে আঙুল গুঁজে নিতে থাকে। বাচ্চারা কাটা ১৪০ গোটা ৮০ -তে ক্রমশ মজে যেতে থাকলে তারা আফসোস করে পরবর্তী প্রজন্মের মগজ তৈরি হবে না বলে, কারণ মাছ, মাছেই আছে মগজ গঠনের যাবতীয় উপাদান, মাছই সমস্ত শক্তি ও বুদ্ধির আকর। কিন্তু সেই শক্তি কোন কাজে লেগেছে ? কেন, সুভাষ বোস, রবীন্দ্র, বিবেকা… ! তারপর ? একটু ভেবে অমর্ত সেন, তারপর ? কেন, দাঁত বের করে, দাদা ! দাদা নেই ? ক্রিকেট খেলা দেখাই ছেড়ে দিয়েছিলুম, এখন  তা-ও আবার একটু একটু করে, তবে, এখন অবশ্য ফুটবলটাই, সেই খেলা, সে-ই পায়ে পায়ে বল নিয়ে দৌড়ে যায় ২২ জন ডাক্তার, আর মাঠের বাইরে থেকে ইট সাপ্লাই করে রবি ঘোষ । আর আগন্তুক বাড়িতে এলে গাইতে বসেন মমতাশঙ্কর, তা-ও সেই বাড়িতে যার কর্তা শিল্পনগরীর অ্যসিস্টান্ট জেনারেল ম্যানেজার, সুন্দরী স্বজাতি মিলিয়ে বিয়ে করা স্ত্রী থাকেন বাড়িতে যিনি বিয়ের আগে ভরতনাট্যম জানতেন, একটা বাংলো বাড়ি যার বাগানে রোজ রোজ মালি এসে দোপাটি ফুল ফুটিয়ে দিয়ে যায়, যিনি বিমল করের গল্প পড়েছেন এবং ল্যাবরেটরির চ্যাটার্জি সাহেবের কথা মতো এরিক সিগালের লভ স্টোরি-ও পড়তে শুরু করেছেন, যিনি বছরে দুবার কলকাতায় নিজের বাড়িতে যান আর যাঁর বাড়ির দেয়ালে থাকতে থাকতে রবীন্দ্রনাথের চুলে ঐশ্বরিক ঝুল জমে গেছে। তাঁরা এখন কেন যেন অবশ্যকর্তব্য হিসেবে কোলকাতার ধার ঘেঁষে ট্যু বা থ্রি বি এইচ কে-র ফ্ল্যাট কিনেছেন, অবশ্যই আফটার রিটায়ারমেন্ট। তাঁদের অনেকের মোবাইলের রিংটোন কফিহাউসের সেই আড্ডাটা, আমরা তাঁদের অনেককেই মাঝে মাঝে বড় বড় হাসপাতালে অর্থোপেডিক বা কার্ডিওলজি বিভাগে অপেক্ষারত দেখতে পাই। এখন তাঁদের বড়োছেলে ব্যাঙ্গালোরে, ছোটজামাই গুরগাঁও, এখন আর সকাল সকাল বয়লার ইন্সপেক্টার আসবে বলে কোমরে বেল্ট গুঁজে ছুটতে হয় না, কী অফুরন্ত আমোদের বিষন্নতা।