নীলাশিস ঘোষদস্তিদার
নীলাশিস ঘোষদস্তিদার
লেখক / সংকলক : Web Admin
গলির দুই বুড়ো
নীলাশিস ঘোষদস্তিদার
ই-রিকশা থেকে নেমে ভাড়া দিতে দিতে ভুরু কুঁচকে গেল অর্চিষার। বুড়োদুটো রোজকার মতই গলির মোড়ে মোটা মোটা ছড়ি হাতে দাঁড়িয়ে। শুধু দাঁড়িয়ে গল্প করলে কথা ছিল। কেমন ড্যাবড্যাব করে চেয়ে আছে দ্যাখো! একজন আবার ঘড়ি দেখল! মানে? ও কটায় ফেরে লক্ষ রাখছে নাকি? হ্যাঁ, আজ একটু দেরি হয়েছে। এক কলিগের হ্যাপি বার্থডে পার্টি ছিল, সেখানে অর্চিষাসুন্দরী মধ্যমণি ছিল, যেমন হওয়া উচিৎ। একটু দেরি তো হবেই! তা এরা, তাই বলে মাতব্বরি করবে নাকি?
পাশ দিয়ে হনহন করে যাবার সময় ওরা কিছু বলল না অবশ্য। কেমন যেন একটা ঘেমো গন্ধ ওদের গায়ে। দুই বুড়োর কেউই অবশ্য খুব সাফসুফ থাকে না। পুরনো, একই জামা কাপড় দেখা যায় অঙ্গে, চুল-দাড়ি-গোঁফ খুব বিন্যস্ত থাকে না । এই ভাবতে ভাবতেই একটা দারুণ, একটু কড়া গন্ধ পেল সে। জিম করে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে হ্যান্ডসাম ছেলেটা। কুণাল কাপুরের মত দেখতে বলে নয়না এর নাম রেখেছে, কুণাল। চোখাচোখি হতেই হাই করল কুণাল। অর্চিষা ঘাড়টা বাঁদিকে পঁয়ত্রিশ ডিগ্রি মত কাত করে একটা সেলফি স্মাইল দিল। কুণালও ঘড়ি দেখল, তার পর ভুরু তুলল। মিষ্টি হাসল অর্চিষা, ‘বার্থডে পার্টি’! ‘আই সি’, বলে এগিয়ে গেল কুণাল। কোথায় থাকে কে জানে! গলির মুখেই একটা সিকিউরিটির কেবিন। এই সময়ে রোজ ডিউটি বদল হয়। পরের শিফটের লোকটাকে দেখা যাচ্ছে না। আগের শিফটের গার্ড বিদায় নেবার জন্য ইউনিফর্ম বদলে তৈরি। নমস্তে করল।
বাড়িতে ঢুকেই হই হই করে সে পার্টির গল্প করতে থাকল এবং, দেরি হল কেন কাউকে এই প্রশ্ন করবার সুযোগই দিল না । বাবা পরদিন ভোরে ট্যুরে যাবে, তাই গোছগাছ করছে। শুধু একবার বলল, ‘এরকম দেরি কোরো না’। রাগ হয়ে গেল অর্চিষার। মেল কোলিগরা কেমন মস্তি করছে এখনও। মেয়ে বলে তাকে ঘেরাটোপের মধ্যে থাকতে হবে সারাক্ষণ?
পরদিন গলির মোড় থেকে ই-রিকশা ধরার সময় রিয়া আন্টিও উঠল। মেট্রো স্টেশন অবধি গল্প করা যাবে । দাঁড়িয়ে থাকা দুই বুড়োকে ইশারায় দ্যাখাল অর্চিষা। তাদের দেখছিল বুড়োরা। রিয়া ওদের চেনে, হাত নাড়ল। ‘স্টকারস’, মুচকি হেসে অর্চিষা মন্তব্যটা করায় অবাক হয়ে তার দিকে তাকাল রিয়া আন্টি। ‘জানতি হো কিতনে অচ্ছে হ্যায় দোনো?বিশ সাল পহেলে দেখতে দোনো কে জোশ অউর জলওয়া! প্রফেসর সাব কি বেটিকে সাথ উয়ো হাদসা হুয়া...ব্যস’। বাকি রাস্তা চুপ করে রইল আন্টি!
অর্চিষাও ভুলেই ছিল। আজ সন্ধ্যায় অটো ধরে ফিরে মোড়ে নামার পর ভাড়া নিয়ে একটু বচসা হতেই লক্ষ করল দুই বুড়োই এসে হাজির। তবে, তাদের দেখে অটোওয়ালা যেন রণে ভঙ্গ দিয়ে পালাল। বুড়োগুলো কি বাড়াবাড়ি করছে না? অর্চিষা কি কচি খুকি? প্রোটেকশন লাগবে?
দিন দুই পর আবার একটু দেরি হল ফিরতে। একটু শপিং। আজ বৃষ্টি হয়েছে। রাস্তায় লোক কম। একটু ঝুপসি আঁধার। ই রিকশা থেকে নেমে হাঁটছে অর্চিষা, পাশে ব্রেক কষে থামল একটা গাড়ি। কুণাল নেমে এল। ‘হাই, ওয়ান্ট আ লিফট’?
‘হেলো? নো, থ্যাঙ্ক ইউ।’ এর বেশি বলার সু্যোগ পেল না অর্চিষা। পিছন থেকে কেউ ওর মুখ চেপে ধরে ওকে শূন্যে তুলে নিয়েছে। এর মধ্যে গাড়ির পিছনের দরজা খুলে গেছে। সেখানেও কেউ একজন আছে, যে ওর একটা পা ধরে ভিতরে টানছে। কুণাল বলছে ‘জলদি, জলদি’! চিৎকার করতে পারছে না অর্চিষা। কিন্তু, মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে। কি হবে?
ঠিক এই সময়েই একটা খট করে শব্দ, আর, পিছনের লোকটার হাত যেন শিথিল হয়ে গেল। অর্চিষার মুখ থেকেও হাতটা সরে গেল। প্রাণপণে একটা চিৎকার করেই সে সজোরে হিলসুদ্ধ জুতোর একটা লাথি কষাল ভিতরের লোকটার মুখে। অন্য পা টা ছেড়ে দিয়ে লোকটা মুখ ঢাকল। বোধহয় চোখে লেগেছে। পিছনের লোকটা তাকে ছেড়ে দিয়েছে। নিজের পায়ে দাঁড়িয়েই সে দেখল গাড়ির বনেটের উপর লুটিয়ে পড়ছে কুণাল। আর, তাকে চ্যাঙাব্যাঙা করে মোটা ছড়ি দিয়ে পেটাচ্ছে দুই বুড়োর একজন। পিছনের লোকটা ততক্ষণে রক্তাক্ত মাথা দুই হাতে চেপে ধরে মাটিতে গড়াচ্ছে, আর, তাকে বেদম পেটাচ্ছে অন্য বুড়োটা। এদিকে তার হাত স্বয়ংক্রিয় ভাবে সাইড ব্যাগ থেকে বার করে এনেছে পেপার স্প্রেটা। গাড়ির মধ্যের লোকটা বেরোতে যাচ্ছিল, তার মুখের উপর প্রায় পুরো ক্যান স্প্রে করে দিয়েই দরজাটা দড়াম করে বন্ধ করে দিল অর্চিষা। দম বন্ধ করে থাকলেও এই সময়ের মধ্যেই তারও হাঁচি পাচ্ছে। তবে, গাড়ির মধ্যে স্প্রের ফল যে ভয়াবহ হয়েছে, তা বোঝা গেল ড্রাইভারকে দেখে । কোন মতে ওপাশের দরজা খুলে বেরিয়ে কাশতে কাশতে রাস্তায় পড়ে গেল। কুণালকে যে পেটাচ্ছিল সেই বুড়ো চেঁচিয়ে বলল, ‘তু ভাগ বিট্টো, ভাগ, হাম দেখ লেঙ্গে’।
দৌড়তে যাবার আগে, কুণালের মুখে ক্যানের বাকিটুকু স্প্রে করে দিল অর্চিষা। ফেটে চৌচির মুখে স্প্রের ফল যে নিদারুণ হল, কুণালের আর্ত চিৎকারে বুঝল অর্চিষা। কিছুদূর গিয়েই সে দেখতে পেল লাঠি হাতে দৌড়ে আসছে সিকিউরিটি গার্ড, আর কোন বাড়ির একজন ড্রাইভার। থেমে গেল অর্চিষা। বাঁদিকে নির্মীয়মাণ একটা বাড়ির সামনে কয়েকটা লোহার রড পড়ে আছে না? একটা হাতে নিয়ে সে পিছন ফিরল। জানোয়ারগুলোকে উচিৎ শিক্ষা নিজের হাতে দিতে হবে।
বুড়ো দুজন তখনো থামে নি। তাদের উদ্দেশ্য চ্যাঁচাল অর্চিষা, ‘বিট্টো হ্যায়, পাপ্পাজি’।
Review Comments
সোসাল মিডিয়া কামেন্টস