এক অন্য ধাঁচের কবি

দেবাশিস মুখোপাধ্যায়



দীপংকর দত্তকে নিয়ে গদ্য লেখা কঠিন কারণ দীপঙ্কর ব্যতিক্রমী কবি । নিজের বিষয়ে একসময় দীপঙ্কর বলেই গিয়েছেন :-

"কারুর পদাঙ্ক অনুসরণ করা ,তেল মারা , লাইন মারা ,ধরণা দেওয়া , সুপারিশ অনুসারে নিজেকে দাখিল করা - আমার ধাতেই নেই। নিজের বিদ্যাবুদ্ধি ক্ষমতা অনুসারে সৎ পথে উপার্জন করি ,রুখা শুখা খাই ,তাতেই খুশি। বস্তুতঃ আমার এই অলসতা,এক গুঁয়েমি ,উচ্চশাহীনতাই বলতে গেলে আমাকে 'আউটসাইডার ' বা ' দি আদার ' করেছে।" আমার হাতে তার মুদ্রিত একটি মাত্র কবিতার বই । মৃত্যুর আগে শহর প্রকাশনা প্রকাশ করেছিল ," ব্রেইলবর্ণ বিষহরি " । অজিত রায় লিখেছেন,

"২০০৫-এ মাতৃবিয়োগের পর সৃষ্টিকর্তার প্রতি চূড়ান্ত রোষে নিজের তাবৎ সৃষ্টি ভরা কোটালের গড় গঙ্গায় আক্ষরিক অর্থেই জলাঞ্জলি দিয়ে লেখালেখি ছেড়ে দেন দীপঙ্কর। ২০০৫ থেকে ২০১২ এক বর্ণও লেখেন নি। শুধু আমাদের টানা খেউড় শুনে গেছেন। ফল হলো ২০১২-র শেষের দিকে, যখন ন্যাড়াকে ফের বেলতলায় হিঁচড়ে টেনে আনা গেল কোনও ক্রমে। নিজেকে ফিরে পাওয়ার অলস প্রস্তুতি পর্বেও ক্ষারধর্ম যেভাবে বজায় রেখেছেন তা কবির নিজের ভাষায় — 'চোরাবালি থেকে কখনো মাথা খুঁজে, / এক প্রস্থ ধড় খুঁজে খুঁজে জুড়ে জুড়ে ইন্দ্রপ্রস্থে একা / ফুলটু স্কিজয়েড খচ্চর চালনা শিখেছি অভিজাত ভীড়ে।' বিগত ৪ বছরে নেতি নেতি করে লেখা ৩০টি ব্যতিক্রমী কবিতার সার্জিকাল স্ট্রাইক এবার পাঠক সহা করুন নিজ নিজ মেধা ও মননে।"

একটি লেখা দেবার লোভ সামলানো গেল না :-


পাল্টাফাগুন


রাউন্ড দ্য উইকেট জোছন টিপ্পা নিচ্ছে

সিসিফিয়ান ঢেউ আর চার আঙুলে ফাটিয়ে ধরা

কাঁকড়ার দাঁড়া উজানো গুমটির ডোভার লেন বাই লেন কুঁড়ি ক্লিট ও গুলাল হিক্কাপে ঘড়ির নিংড়া ড্রিপ-কাৎরার মালার্মে বাজছে বোধলেয়ার

পান্তা খাই আর কুকবুকের প্যাপিরাস ঝুলে পড়ে

নিরীশ্বর হোলিকার বার্ন ড্রেসিং টেবলে

আর স্যুইং ডোর ফাঁকিয়ে ফাগ্ ফাগ্ ফাগ্ ফাগ্ আবীরের ঠাটানো মধ্যস্বত্ত্ব ঢুকছে বেরুচ্ছে পোলোনিয়াম দুশো দশ সুরুয়ার গড়চুমুচুমুকে

আমি দোতারার ইশকিয়াঁও ড়িং কে এমন আনুভূমিক ঢ়াং বাজিয়ে ছাড়ছি সুফিয়ানা,

যে সাঁই ভি শরমা যায়ে

উত্তরাষাঢ়া ও শ্রবণার টুইঙ্কল ছুঁয়ে থাকা ছাপ্পান্ন মিনিটের অভিজিৎকে

যখন রাণীমা চপিং বোর্ডে এনে ফেলেন

আমাদের টশন ও জলবা রিটায়ার করে না

জড় জোরু জমীনের আঙ্গিঠি হাত সেঁকি

মালসায় পিয়ানোর রীড আর তিনটি কাটা আঙুলের বেরঙরলিয়া

অ্যায়ে ক্ষুধা মুঝে বক্‌শ দে মেরী জান

এমসি স্কোয়ারে জন্মেজয়ের সর্পযজ্ঞে

আস্তিকের তাবৎ কেতন কেত্তন ঝুঁকে আছে পুরুষ ও প্রকৃতি – -


অনেকেই বলেন এইসব লেখা দুর্বোধ্য। কিন্তু বুঝতে না পারাটা তাদের অক্ষমতা স্বীকার করেন না । এই যে নতুন শব্দের ব্যবহার তা চমকে দেওয়ার মতো । রবীন্দ্র গুহর উপন্যাস বা গল্প যারা পড়েছেন তারাও চমকে উঠবেন এই ধরনের শব্দ ব্যবহারে।  বারীন ঘোষাল দীপঙ্কর সম্পর্কে বলেছেন - " শব্দের অসম্ভব ব্যবহার;- কবি যখন প্রচলিত রীতি,ছন্দপ্রকরণ এবং শব্দ শরব্যতায় শৃঙ্খলিত বা আন ইজি বোধ করেন ,তখনই

নতুনের জন্য এই যাচনা জন্মায়, নতুন কবিতার জন্ম হয় ।"


কবিতা জিনিসটা এমন যে অনেকটা অন্ধের হস্তী দর্শনের মতো, পাঠক যে যার মতো অর্থ বের করে নিতে পারেন। মানুষের লাগামহীন দৌড়কে ব্যঙ্গ করে এই অন্তর্লীন ভাবটাকে ছড়িয়ে দিয়ে তা ডায়াসপোরিক করে তুলেছেন দীপঙ্কর তার কবিতায়। 



রেলরোড হাংগার


সিন নাইন্টিফাইভ শট সিক্সটিওয়ান টেক থ্রি ঠাক। শুনিতে কি পাও পোস্ট ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল। পিনড্রপ অন দ্য রেট্রোকালচারাল ফ্লোর? ফেসপ্যাকের সারপ্লাস মিক্স অব লাইভ অ্যাও লিপ-সিঙ্কভ্ ভোকাট্স্ উড়ছে রাউটার পাথের খ্যাঙ্গলা তহেসন হেসে। উইথড্রন রিসিভার রাতভর যে টোন খেউড়ালো রিডায়াল রিপিট ডায়ালে ভোর কবুল হলে নেকড়ের দখলী হাউল আর উইণ্ডমেশিনের খোয়াইশপ্রাইস গলছে ডীপ ভি-নেক হল্টারের ডৌল থ্রাক্স লাচিতে। চোখে ঠুলি ছিলো বেতো ভাড়ে কা টাট্টুর। ফগফাড় রেল প্যারালাল ছুটতে ছুটতে রোডট্যাক্সের অলগ থলড জুদা কিন ও কিথেদের জোট এখন চাবিয়ে ফেলছে কুত্তি চীজ এই সাঁটা জিন স্টিরাপ লাগাম। হোল হুয়ীট টোস্ট শ্রেডেড চিকেনের তরে আজও মহীনেরা চরে। চেরা সাপ জিভ লং ঘূর্ণি প্লেয়াচ্ছে ক্লিট কুঁড়ির ছিলকা নিওলিথ দুব্বো র‍্যাম্প লেবিয়্যাল উপছা খিলানে—'


'ব্রেক টু গেইন অ্যাকসেস নামও কবিতার বইটির নামকরণও জোরদার অভাবনীয়। অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রের গায়ে এই নির্দেশিকাটি লেখা থাকে। একটি লিফটের পাশে ঐ মেসিনটি দেখে তাৎক্ষণিকভাবে তাঁর যে প্রতিক্রিয়া হয় তা কবিতায় লিপিবদ্ধ করেন। এমনিতেই তাঁর কবিতায় ইংরেজি শব্দ ব্যবহারের প্রাবল্য আছে। তিনি এখানে সামান্য একটা ইভেন্ট থেকে স্পেসে চলে এসেছেন। কবিতাটির উদ্ধৃতি দিলাম


ব্রেক টু গেইন অ্যাকসেস


ঘটনাটা এই যে আমি


যতবার বোঝাতে চেয়েছি যে আপৎকালে


ও সব মায়াফায়া দ্বিধা ঢ্যামনামো


ছেড়ে দিয়ে যা ভাঙার তা দ্রুত ভেঙে ফেলতে হয়


ততবারই তাদের হোহো আর হিহি আর


আব্বে চুপ।


আমাকে চুপ করিয়ে দিয়েছে 

এখন যখন ঘরে আগুন লেগেছে


আমি দেখিয়েছি


কাঁচের একটি বন্ধ খুপরীর ভেতরে অ্যালার্ম


লিফটের বোতাম, ট্যাপ আর ক্যাম্বিসের গোটানো


মাইটাক পাইপ


শাবলের পেছন দিকটা দিয়ে


ঠিস্


ঠিস্


ঠিন্‌ শব্দে ভাঙো


হ্যাঁচকা হিরহির পেতল নলের ওই হাঁয়ে বসাও প্যাঁচ খোলো দ্যাখো জলস্রোত কামাল... '


দীপঙ্করের এটি খুব সহজবোধ্য কবিতা। তিনি পোস্টজেনেরিক বা কোনোরকম জেনার-এর মধ্যে যেতে চান না। জেনার ট্র্যাপড্ হবেন না, বলেছেন। বলেছেন : 'কবিতাকে ওপেন-এনডেড রাখার জন্য শুরু শুরুতে একটা প্রয়াস অবশ্যই ছিলো। এখন আর কোনও জবরদস্তি করি না। কবিতা যা হবার হয়ে ওঠে। এসব সাক্ষাৎকার অর্বাচীন ধুলো ২০০০ সালে শুভঙ্কর দাশের পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিলো।


ইছামতী


যথেষ্ট বর্গী বাৎসন্যায়ের পরও যুথিকার ঠিক মোচন হয় না ফলে এমন চেঁচায় যে স্টীমার-এর যে কেবিনেই ছালায় শুয়ে পরছি আইদার দরজায় নক পরে নয় জানলার নিচ দিয়ে খেউড় পাড়তে পাড়তে একটা বোঝাই বজরা যায় করা ইটু আইস্তে গো কুমীরগুলান ঘুমাইছে!


ঢেউয়েরা কাজলা সোফোক্লিশে

আন্তিগোনে চিলানীর ছোঁ ছায়ার বিয়োগান্ত ডবল ডিপ দফনানা 

গুঁড়ো ইলশে বৃষ্টির পর রোদ চকমকি ঝিকিয়ে উঠছে নুড়ির সোঁদাল নুর-এ-দোজখ আর দূরে দূরে মানুষের জিরজিরে বোর্ন ভিটামাটি লাউডগার হিসিং সারাউণ্ড সাউণ্ড রুটির কুটির শিল্প আর গাছে গাছে আমের হাইনরিশ বোল হরি হামিং মলিকা-এ-তরুন্নুম পাখি


খাতুনের লাশটা আট ইঞ্চি ব্যাসের পোর্টহোল গলিয়ে জলে ফেলে দেওয়ার

চেষ্টা করে দেখলাম সব বৃথা কুপিয়ে কাটার কুড়োল জাতীয় কোনো অওজারও নেই গলায় নাইলন ফাঁসের লিনিয়ার একচাইমোসিস

ল্যারিনজিয়াল রাপচারের পর দড়ি দড়ি গ্যাজলা আলকাতরা আমি ডেক স্টেওয়ার্ডদের

বোঝাতে পারবো না এটা ওরকমই আকছার একটা ইসাডোরা ডানকান সিনড্রোম—


উজান এলো উতল কবোতল এনেথ হুলু হুলু অনর্গল স্বন ইছামতী মোচাখোলাদের লায়লা টিমটিম করছে 

হাট্টিমার ফোঁপরা ইষল্লাল লেবিয়ার চেরি কুঁড়ির গার্নিশে 

আমি কি ঝাঁপ দেবো, সাঁতরে উঠবো যোগিনীঘাট? প্রবল হাওয়ায় বিষের মতো টলটল করছে ছাঁদনাতলা মৃন্ময়ী কি পিঁড়েয় ঘুমিয়ে পড়েছে?

মুন্সিগঞ্জ পুলিস শুঁকতে শুঁকতে ঘিরে ফেলছে গোটা তল্লাট—


এইভাবেই কবিকে আবিস্কার। দিল্লির বাসিন্দা হিসেবে তার কবিতায় গতানুগতিক বাংলা কবিতার ছাপ লাগতে দেন নি কবি ।বরং হিন্দি উর্দু ইংরেজি শব্দের তোড়ে উপস্থাপিত করেছেন লেখাকে । তিনি জনপ্রিয় হতে চান নি । এড়িয়ে গেছেন মঞ্চের হাতছানি। একা একা নীরবে বিদায় নিয়েছেন। ব্রেইলবর্ণ বিষহরি থেকে একটি লেখা :-



সাপবাক্য


ট্রেন চলে গেলে যখন থ্যাৎলানো ইস্পাত যমজে জোছন ঝকঝক করে ওমটির সাপযুবতীদের ড্রাগ ওভারডোজ ও খুঁটির ম্যাচিং বিন্দিয়ার ওপর গড়িয়ে যায় ঘুণফোঁপরা একটি ছক্কা --


শীতে সাপ পেটিকোট কে পিস্যু, থুৎকারা চিকনি খোলশ ও মোরগফুলের ধুনি জ্বালিয়ে স্যান্ডেলে বাতাস ফটফটিয়ে কাচ্চি গুলাবী নেরোল্যাক এলো ভলভোরা মেলডি চকলেটি টাইমলাইনে -


বুড়ো সমুদ্দুরের হেমিং ওয়ে আউট ছাড়া সাপেরা যখন কোনো হানিমুন স্পট খুঁজে পায় না আর এদিকে ভল্ভোরা ছাড়ি ছাড়ি, কাঁকই ছেঁকে ইশ্চেমিক আলো এলো আরশিনগরে, নেউল সাজনার ট্রিন বাইসিকলের সিঁথিপথ -


ঢেলারা স্কিপিংয়ে উছাল উছাল খানিক আলগা হলে সেমিজসহ নিড়েনিতে ফাটিয়ে ছেড়ে দিয়ে দেখছি রাজ কোব্রাদের উষ্ণীষ র‍্যাকেটে পিংপং এ কোর্ট ও কোর্ট ধ্বজ্জিয়া উড়ছে তাদের মলেস্টেড আধর্ষপত্র - -


ফেকু তক্ষকদের শ্লোগানে আজকাল হর হর প্রিফিক্স বসে না, উল্কিগুলো জীবন্ত সাপ হয়ে আস্তিকের আস্তিন ও হোয়াটস্অ্যাপের দুধ-কলায় পাঁচ পা শিকড় চারিয়ে যায় আর একদিন চমড়িতে দগদগ করে ওঠে কেতকা ক্ষেমানন্দর কাউন্টার ট্যাটু


স্নেক চার্মারদের ভেঁপুর ভেতরে ব্লাডারে পেচ্ছাবের কেলাস যখন সাপেরা অহো একেকটি চার্মিং শীতরাত ঘুমিয়ে ওঠে তাদের ল অফ ডিমিনিশিং রিটার্নস বোঝানো যায় না, স্মোকি বাণলিঙ্গ ভেঙে পড়ে মূলাধারে --


কুলিক সেফোলজিস্টদের হেপাটাইটিস, ঝাঁপি থেকে ট্যারো কার্ড উল্টে উল্টে চ্যানেল সামলাচ্ছে ভূঁইচিচির একগলা খ্যামটা, বালুরঘাট থেকে র‍্যাম্প খুঁজতি খুঁজতি শেষে পেণ্ডুপাছা ব্রিগেড এয়েচো! দিল্লী মারাগে যা, রামলীলা, যন্তরমন্তর- -


পাঠক বুঝতে পেরেছেন কিভাবে আধুনিক শব্দগুলো কিভাবে ঢুকে পড়ে দীপঙ্কর এর কবিতাকে অন্য মাত্রা দিয়েছে। এ কবিতা অনেক এগিয়ে। একদিন পাঠক ঠিক খুঁজে নেবে গতানুগতিক এর বাইরে আগামীর কবিতাকে। দীপঙ্কর বাঁচে নি কিংবা বাঁচতে চায় নি এই একশ্রেণীর ধান্দাবাজ সাহিত্যের

মাঝখানে। তার কবিতা হয়তো সহজে হজম হবে না কিন্তু অনেক দিন পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া রেখে যাবে ।এখানেই দীপঙ্কর এক সার্থক ভাষাশিল্পী ।