এক বিকেলের  গল্প





চৈতালি দাস






পরমেশ বাজার থেকে এসে থলিটা রান্নাঘরের দরজার পাশে নামাতে নামাতে বলল, শুনছো আজ তাড়াতাড়ি বেরোবো অফিসে, নতুন একটা কাজের ব্যাপারে  মিটিং আছে।

নীলা  হাতের কাজ ফেলে থলি থেকে তরকারি পাতি নামাতে গিয়ে দেখলো আজও আদা আনেনি পরমেশ। ব‍্যস , সকাল সকাল নীলায মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে গেল।

একে তো পরমেশের অফিস বেরোনোর সময়ের কোনো ঠিক থাকে না, কখন বেরোবে তা আগে থেকে কিছু জানায়‌ও না ,তারপর হুড়োহুড়ি করে কোনোরকমে রান্না নামিয়ে খেতে দিতে হয়।



কিছু দিন হলো পরমেশ ওর খবরের কাগজের চাকরিটা ছেড়ে​ নিজের পাবলিশিং হাউস খুলেছে । একবার বাড়ি থেকে বেরোলে কাজ ছাড়া আর অন্যকোনো দিকে খেয়াল থাকেনা পরমেশের। এমনকি খেতেও ভুলে যায় । দিনের পর দিন অনিয়ম করতে করতে পেটে আলসার বাঁধিয়ে বসেছে সে । এখন ডাক্তারের কড়া নির্দেশে বাইরের খাবার খাওয়া  আর তেল ,মশলা, ঝাল এক্কেবারে বন্ধ   । তাই পরমেশ অফিস বেরোনোর আগে ভাত আর একটা পাতলা ঝোল যে ভাবেই হোক রেঁধে খাইয়ে পাঠায় নীলা।



 বাজারের থলি থেকে মাছ বের করে রান্নাঘরের বেসিনে রেখে নীলা বাজারে ছুটলো আদা আনতে কারণ এখন পরমেশ কে আর বাজারে পাঠানো যাবে না। সে এতক্ষণে বাথরুমে ঢুকে গেছে । দাড়ি কামিয়ে, স্নান, আহ্নিক সেরে ঠাকুরঘরে ঢুকবে। সেখানেই প্রায় তিরিশ চল্লিশ মিনিট কাটিয়ে জামা কাপড় পরে, চুল আঁচড়ে সোজা খাবার টেবিলে এসে বসবে ,এই ঘন্টা খানেক সময়ের মধ্যেই​ পরমেশের খাবার বেড়ে টেবিলে দিতে হবে নীলা।



   স্টেশনের কাছে লেভেল  ক্রসিং পেরোলেই রাস্তার দু ধারে সকাল ছ'টা বাজতে না বাজতেই বাজার বসে । সরু রাস্তা তখন আরও সরু হয়ে যায়। সাইকেল, রিক্সা,স্কুটার ,গাড়ী সব মিলিয়ে রাস্তায় হাঁটার জায়গা পাওয়া যায় না এই সময়টায়।



রোদ্দুর নেই , কিন্তু ভ্যাপসা গরমে নীলার সারা শরীরে ঘামাচি গুলো চিড়বিড় করছে  । ওড়নায় ঘাম মুছতে মুছতে একটা রিক্সার একেবারে সামনে এসে পড়লো সে।  একে তো গরমে কাহিল,  তায় আবার রান্নার তাড়া । রাগের মাথায় রিক্সা ওয়ালা কে খ্যাঁকানি  দিতে গিয়ে দেখে রিক্সায় বসে আছে আভেরী ! চোখাচোখি হতেই আভেরী ও নীলাকে  কে চিনতে পারলো । এই ভীড়ের মাঝে রিক্সা থামিয়ে কথা বলতে গিয়ে রাস্তায় যানজট হয়ে গেছে দেখে আভেরী তাড়াতাড়ি পার্স থেকে ওর ভিসিটিং কার্ড টা বের করে নীলার  হাতে দিয়ে বললো, দুপুরে কথা বলিস ,এখন মায়ের ব্লাড রিপোর্ট আনতে যাচ্ছি রে , খুব তাড়া আছে তাই আর রিক্সা থেকে নামলাম না।নলিনী ও সংক্ষেপে বললো , হ্যাঁ রে, আমিও ,রান্না পড়ে আছে।



আভেরী কে দেখে নীলা সেই  তিরিশ বছর পিছনে ফিরে গেলো স্কুলের দিনগুলোতে। আভেরী  যেমন মেধাবী ছিল তেমন সুন্দরী ছিল  ,  আজও ঠিক সেই রকমই সুন্দর আছে ও বরং চেহারায় একটু মাংস লেগে লাবণ্য যেন আরো বেড়ে গেছে।

 গ‍্যাসের দুটো আভেনের একটায় ভাত বসিয়ে , অন্যটায়  মাছটা সাঁৎলে একটু কালোজিরে কাঁচালঙ্কা ,নুন ,হলুদ ,আদা জিরে বাটা দিয়ে ফুটিয়ে ঝোল নামিয়ে পরমেশের খাবার টেবিলে বসার আগেই ভাত বেড়ে ফ‍্যান চালিয়ে খাবার ঠান্ডা হতে দিল,তা না হলে পরমেশ গরম ভাত খেতে পারেনা।

এমন হুড়োহুড়ি করে যেদিনই পরমেশকে খেতে দেয় সেদিনই মেজাজের পারা চড়ে থাকে নীলার , সেই সঙ্গে নন স্টপ কাজের ফিরিস্তি চলতে থাকে পিন কাটা রেকর্ডের মত।

প্রথম প্রথম পরমেশ এই চিৎকার চেঁচামেচি তে বিরক্ত হয়ে নিজেও দু-চার কথা শোনাত,  আজকাল সয়ে গেছে , কোনটার পর কোনটা নীলা বলবে তা ও মুখস্থ হয়ে গেছে পরমেশের , কিন্তু আজ নীলাকে শান্ত দেখে পরমেশ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো --কি ব্যাপার ! আজ বাড়িতে কারফিউ লেগেছে মনে হচ্ছে,এত শান্তি ! নীলা তোমার শরীর ঠিক আছে তো?

নীলা নিস্পৃহভাবে জবাব দিল, হ্যাঁ ঠিক আছি, আমার আবার কি হবে?

--না মানে ইয়ে মানে যা গরম পড়েছে এর মধ্যে তোমাকে এত ছোটাছুটি করতে হচ্ছে।  আমি তো ঐ বাজার টুকু ছাড়া আর কিছুই করিনা ,তাও আবার প্রায়ই কিছু না কিছু ভুলে যাই আনতে ,যেমন আজ আদা আনতে ভুলে গেলাম আর তোমাকে ছুটতে হল।

কথাগুলো বলতে বলতে পরমেশ খেয়াল করলো নীলা  গুনগুন করতে করতে পাশের ঘরে গিয়ে শব্দ করে আলমারী টা খুললো। নীলাকে এতখানি অন্যমনস্ক দেখে পরমেশ বেশ চিন্তায় পড়ে গেল কিন্তু  অফিসের দেরী হয়ে যাচ্ছে দেখে আর কথা না বাড়িয়ে 'আসছি'  বলে ব‍্যাগটা নিয়ে বেরিয়ে গেল।



                                        ২

দুপুর দুটো বাজছে, নীলা সব কাজ সেরে সুরে পার্স থেকে আভেরীর ভিসিটিং কার্ড টা হাতে নিয়ে এ সি চালিয়ে বিছানায় শুলো ,কার্ডটা লাল রঙের তাতে সোনালী রঙে লেখা

Averi Mitra.

Online Culinary School.

Culinary School সম্বন্ধে নীলার কোনো আইডিয়া নেই।

এই শব্দটা আজ প্রথম সে শুনলো।



স্কুলে পড়াকালীনই আভেরী ক্লাশের মেধাবী ছাত্র ছাত্রীদের তালিকায় ছিল। উচ্চ মাধ্যমিকে খুব ভালো ফল করার পর প্রেসিডেন্সি কলেজে জুলজী নিয়ে ভর্তি হয়, ওখান থেকে পাশ করার পর‌ই আভেরীর বিয়ে হয়ে যায়। আজ প্রায় তিরিশ বছর পর এই ভাবে আভেরীর সাথে দেখা হ‌ওয়াটা খুবই আশ্চর্যের লাগছে নীলার ।



--হ‍্যলো কে ? আভেরী বলছিস ?



--বল নীলা  ,আমি তোর ফোনের অপেক্ষায় ছিলাম।  তোর বাড়ি  ঐ পাড়ায়? কাল তখন মায়ের রিপোর্ট গুলো নিয়ে ডাক্তারের কাছে দেখানোর জন্য আ‍্যপয়েনমেন্ট নেওয়া ছিল, একটু দেরী হয়ে গেলে ডাক্তার উঠে যায় তাই তোর সাথে কথা বলতে পারলাম না,স‍্যরি রে।



--না ,না কিছু মনে করিনি , তাছাড়া আমার ও তাড়াহুড়ো ছিলো ,পরমেশের  অফিসের রান্না হয়নি তখনো।



--ওও তোর বরের নাম পরমেশ? কি করে ?



---এখন‌ কিচ্ছু বলবো না, দেখা হলে সব বলবো,এখন এটা সাসপেন্স থাক।আজ ঐ ভীড়ের মাঝে তোকে দেখে যে কি আনন্দ হয়েছে কি বলবো।তুই এখনও সেই আগের মতই সুন্দর আছিস।ও হ্যাঁ , মাসীমার কি হয়েছে রে?তুই আমাদের পাড়ায় মাসীমার ব্লাড রিপোর্ট নিতে এসেছিলি,মাসীমা কি এদিকেই থাকেন?



--বাবা তো লেকটাউনে বাড়ি বানিয়েছিলেন , তারপর দু হাজার বারো তে বাবা মারা যাওয়ার পর মা ওই বাড়িতে একাই থাকতেন ।গত দুবছর ধরে মা খুব অসুস্থ , অ‍্যাকিউট ডায়াবেটিস এর পেশেন্ট । একা থাকা বিপদজনক ,তাই দাদা - বৌদি মা কে ওদের কাছে এনে রেখেছে। এখন ওরা মেয়ের কাছে বস্টনে গেছে তাই আমি প্রায় একমাস হল মায়ের কাছে এসে আছি,দাদারা আগামী মঙ্গলবার কলকাতায় ফিরবে,  তার আগেই তুই একদিন এখানেই চলে আয় নিরিবিলিতে দুজনে মিলে অনেক গল্প হবে। অনেক কথা তোকে বলতে ইচ্ছে করছে।



--ঠিক আছে কাল  তোর কাছে যাব,মাসীমা কেও দেখে আসা হবে,আর তোর সাথে জমিয়ে আড্ডা হবে ,তবে তুই তো আবার ব‍্যস্ত মানুষ কাল দুপুরে ফ্রী থাকবি তো?



--তুই কি করে বুঝলি আমি ব্যস্ত !



--তোর ভিসিটিং কার্ডে দেখলাম, কি যেন culinery school এর কথা লেখা আছে। আমি তো ওসবের মানেও জানিনা হা হা হা হা।



--আরে না ,না এমন কিছু না রে,সোজা ভাষায় ওটাকে বলে রান্নার ক্লাশ,সে আমি বেশীরভাগ‌ই অনলাইনে করি, মাঝে মাঝে ডেমো দিতে যাই,সে ও খুব রেয়ার।এই কাজটায় কোনো চাপ নেই বুঝলি, সময় কাটানোর জন্য এইসব করি, তাছাড়া রান্নায় আমার বরাবরই খুব আগ্ৰহ ছিল,মা এবং শাশুড়ি দুজনেই খুব ভালো রাঁধতেন ,ওঁদের কাছ থেকে প্রচুর ভালো ভালো রান্না শিখেছি,এখন সেগুলোই শেখাই আমার ক্লাশে।



-তুই প্রেসিডেন্সি থেকে এতো ভালো রেজাল্ট নিয়ে বেরিয়ে রান্না শেখাচ্ছিস ?  তোর তো কোনো কলেজে পড়ানো উচিত ছিল।



--গ্ৰ‍্যাজুয়েশনের পর  বাবার মাথায় চাপল আমাকে পাত্রস্থ করার ভুত । খুব অল্প দিনের মধ্যে আমার বিয়েটা  হয়ে গেল সুবর্ণর সঙ্গে।  শশুরবাড়িতে এসে দেখলাম শশুর মশাই খুব অসুস্থ, শাশুড়ি আর্থাইটিস​ এর রুগী । সুবর্ণর তখন ট্যুরিং জব , মাসের মধ্যে কুড়ি দিন কলকাতার বাইরে থাকতে হত ওকে  অত‌এব বুঝতেই পারছিস ,বাড়ির সম্পূর্ণ দায়িত্ব আমার উপরেই পড়লো। আমাদের বিয়ের দেড় বছরের মধ্যে শশুর মশাই মারা গেলেন আর তার  কয়েকমাসের মধ্যে আমি প্রেগনেন্ট হলাম। ব‍্যস্ সংসার করা ছাড়া অন্যকোনো ভাবনা ভাবতেই পারিনি । ছাড় এখন এসব কথা ,অনেক্ষণ ধরে একটা ফোন আসছে বুঝলি,মনে হয় কোনো ক্লায়েন্টের  কল,কাল দুপুরে চলে আয়, আমার এখানেই খাবি।

তোর এই ফোন নম্বরে হোয়াটসঅ্যাপ আছে তো?আমি তোকে অ্যাড করে দাদার বাড়ির ঠিকানা টা  তোকে পাঠিয়ে দিচ্ছি । বাড়ির কাছেই রাস্তার বাঁদিকে একটা মিষ্টির দোকান পাবি, মহামায়া সুইটস্,ওখানে এসে আমাকে এই নম্বরে একটা ফোন করিস ,আমি তোকে নিয়ে আসবো আর তারপর প্রচুর গল্প হবে বুঝলি।এখন ছাড়ি ।টা টা।



                                          ৩

আকাশ বেশ মেঘলা , গুমোট ভাবটা কালকের  থেকে আজ একটু কম । কলকাতার এই দিকটায় এখনও বেশ কিছু গাছপালা আছে , নীলা ছাতা মাথায় কিছুটা হেঁটে একটা  রিক্সা​ পেয়ে গেল। ফুটপাতের ধারে পার্কের গা ঘেঁষে বাচ্চা ছেলেটা ওর মায়ের সাথে  নিভু আঁচে ভুট্টা পুড়িয়ে ভুট্টা বিক্রি করছিল , রিক্সা ওয়ালা রিক্সা থামিয়ে দশ টাকায় একটা পোড়ানো ভুট্টা কিনলো , নীলা ও কি মনে করে দুটো কাঁচা ভুট্টা কিনে নিলো , তারপর রিক্সাওয়ালার সাথে এই অসহ্য গরম,গ্লোবাল‌ওয়ার্মিং , রোজ বিকেলে কালবৈশাখী আর বীভ‍ৎস বাজ পড়ার গল্প করতে করতে  মহামায়া সুইটসের  কাছে পৌঁছে রিক্সার ভাড়া মিটিয়ে মিষ্টির দোকানে ঢুকলো ।

এই মানুষগুলোর সঙ্গে অহেতুক গল্প জমাতে নীলার খুব ভাল লাগে।

 মিষ্টি পছন্দ করতে করতে মনে হল আভেরী বলেছিল মাসীমার ডায়াবেটিস তাই ওঁর জন্য অন‍্য কিছু নিলে ভালো হবে ।পাঁচশো গ্ৰাম মিষ্টি দ‌ই ,ছানার জিলিপি , আর ভাপা সন্দেশ নিলো। মিষ্টির দোকানের পাশেই একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর থেকে মাসীমার জন্য একটা ওটসের প‍্যাকেট কিনলো।দোকান থেকে বেরিয়ে আভেরীর নির্দেশ মত একটু এগিয়েই গোলাপি রঙের বাড়ি ,ঝুল বারান্দা,খিলান কাটা জানলা দেখতে পেল , বাড়ির গেটে লেখা ৩২,'আসিয়ানা' ।

নীলা গেট খুলে ভিতরে ঢুকে  কলিং বেল বাজাতেই দোতলার জানলা খুলে পর্দা সরিয়ে আভেরী নীলাকে দেখে বললো, আরে তুই চলে এলি !আমি তো তোর ফোনের অপেক্ষা করছিলাম। আমি নীচে আসছি এক মিনিট অপেক্ষা কর।



নীলা দেখলো বাগান ভর্তি বেলিফুল ,নয়নতারা ,গেটের উপরে আর্চ করে লাগানো  সাদা আর আবির রঙের বোগনভেলিয়া  আর বাগানের  ব‍্যাড়া জুড়ে মাধবিলতা ফুল ফুটে আছে। বেলি ফুলের গন্ধ পেলেই  নীলার রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন মনে পড়ে যায় । কেমন একটা গভীর ভাললাগা আচ্ছন্ন করে নীলাকে। ঝরে পড়া কয়েক টা বেলিফুল কুড়িয়ে হাতের মুঠোয় নিয়ে গন্ধ শুঁকলো নীলা।

  আভেরী দোতলা থেকে নেমে এসে নীলাকে জড়িয়ে ধরে বললো , বাড়ি চিনতে অসূবিধা হয়নি তো ? মিষ্টির দোকানের সামনে এসে ফোন করলিনা কেন? আমি তো রেডি হয়ে তোর ফোনের অপেক্ষা করছিলাম । চল চল উপরে চল ,ইস খুব ঘেমে গেছিস রে,এই গরমে আসতে খুব কষ্ট হলো বল।



সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে আভেরী বললো , বুঝলি মা আজকাল অনেক ভুলভাল কথা বলে,মায়ের মাথাটা একেবারে গেছে , উল্টো পাল্টা কথা বললে কিছু মনে করিসনা প্লীজ।



নীলা দোতলায় পৌঁছে দেখলো বিশাল হল ঘরে দেওয়াল জুড়ে বিশাল টিভি, তাতে খুব লো ভলিউমে বাংলা সিরিয়াল চলছে, সাদা আর ইঁট রাঙা ভারী ভারী পর্দায় ঘরটা বেশ অন্ধকার , হল ঘরের একপাশে একটা ডিভানে মাসীমা চিৎ হয়ে হাঁ করে ঘুমোচ্ছেন। নীলার  মনে পড়ে গেলো সেই স্কুলবেলার কথা, টিফিনের সময় স্কুল থেকে বেরিয়ে  আভেরীদের বাড়ি চলে যেতো মাসীমার হাতে বানানো আচার খাওয়ার লোভে ।মাসীমা ওদের আসতে দেখেই কাঁচের প্লেটে করে আচার এনে বলতেন দ‍্যাখ তো খেয়ে কেমন হয়েছে , এটা এবার নতুন বানিয়েছি। তেমন সুস্বাদু আচার এরপর খেয়েছে বলে মনে ওপড়েনা নীলার।অনেকবার মাকে বলেছে আচার বানাতে, মা ও বানিয়েছে কিন্তু মাসীমার হাতের আচারের মত হয়নি।



আভেরীর বাবা উচ্চ পদস্থ সরকারী কর্মচারী ছিলেন ,চার পাঁচ জন কাজের লোক,মালী সবসময় কাজ করত ওদের বাড়িতে।ওখানেই  প্রথম আর্দালী দেখেছিলো নীলা। ওদের ওই বাড়িতে বিশাল বড়ো বাগান ছিল , বাড়ির সামনে কত রকমের ফুল আর টবে নানা রঙের অর্কিড ফুটে থাকত । মাসীমা   বলতেন গাছগুলো তোর মেসোমশাই এর সন্তানের  মত, অফিসের কাজের পর  আর ছুটির দিন গুলোয়  এই গাছের পরিচর্যা নিয়ে পড়ে থাকে । যতবার ডুয়ার্সে যায় রঙবেরঙের অর্কিড আনে, একবার তো সেগুলো এনে ডীপ ফ্রীজে ভরে রাখলো সে কি ঝামেলা আমার ।



 ওদের বাড়ির পিছনের বাগানে মরসুমী সবজি হতো , এছাড়া আম,কাঁঠাল , পেয়ারা ,কলা  আর একটা  কাজু গাছ ছিল, নীলা এখানেই​ প্রথম কাজু গাছ দেখেছিল ,তবে কাজু গুলো খুব ছোট অবস্থাতেই শুকিয়ে ঝরে যেত  ।কাজু  যে কারো বাড়িতে ফলতে পারে এই ধারণা এর আগে ছিলো না।



 হল ঘরের অন্যপ্রান্তে রান্নাঘর আর তার সাথে লাগোয়া  আট চেয়ারের বিশাল ডাইনিং টেবিল।নলিনী কথা বলতে বলতে ডাইনিং টেবিলের একটা চেয়ার টেনে বসলো।

রান্নার মাসী কাঁচের গ্লাসে জল আর প্লেটে করে দুটো সন্দেশ এনে নীলা কে বললো দিদি এইটুক খেয়ে নাও। নীলা মাসীর দিকে তাকিয়ে ধন্যবাদ সূচক হাসি দিল একটা।



আভেরী ততক্ষণে এলোমেলো ঘরটা ঠিকঠাক করতে করতে বললো , নীলা  তোর নিশ্চই এখন‌ই খিদে পায়নি ,  নীলা মাথা নাড়লো।আভেরী বললো চল দাদাদের বেডরুমে বসি, এখানে বসলে গল্প করা যাবেনা।মা জেগে গেলে মুশকিল , তখন তোকে শুধু মায়ের  সঙ্গেই  কথা বলতে হবে, না হলেই ক্ষেপে যাবে। মা একেবারে ছোট বাচ্চার মত হয়ে গেছে বুঝলি।

     

                                 ৪

আভেরীর দাদা বৌদি র বেডরুম টা খুব সুন্দর ছিমছাম সাজানো,পুরো বাড়ির ডেকোরেশনে পোড়ামাটি আর  ডোকরার ব‍্যবহার বেশি।এই ঘরের পর্দা গুলো খুব সুন্দর  , বন্ধ কাঁচের জানলা ভেদ করে বাইরের আলো পর্দায় পড়ে বৈশ একটা মায়াবী রঙ ছড়িয়ে পড়েছে সারা ঘরে। দেওয়ালের রঙের সাথে দারুণ কন্ট্রাস্ট  ! নীলা হাত দিয়ে পর্দা গুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছিলো । আভেরী বললো ,জানিস এই বাড়ির কম্পলিট ইনটেরিয়র আমার বৌদির করা । নীলা বললো,বাহ দারুন তো? তোর বৌদি কি ইন্টেরিয়র ডেকরেশন পড়েছে?  আভেরী বললো , না না, বৌদি তো প্রেসিডেন্সিতেই ছিলো  , আমারই সাব্জেক্ট ,আমার থেকে এক ইয়ার সীনিয়র ছিল।  ও এখন বিবেকানন্দ কলেজে পড়ায়।

 এই দ‍্যাখ এই হলো আমার দাদা , বৌদি আর ওদের মেয়ে , আমার পুক্কুড়ি। আর এই হলাম আমি,সুবর্ণ আর আমাদের মেয়ে মিলি , ভালো নাম ক‍্যামেলিয়া ।  এন,আই,টি দুর্গা​পুরে  পড়ে, এবার থার্ড ইয়ারে উঠবে। এখন ওর গরমের ছুটি চলছে কিন্তু ইনটার্নশিপ চলছিল , আজ শেষ হবে। কাল‌ই বাড়ি চলে আসবে। নীলা  বললো , বাঃ  ! তোর মেয়ে তো রূপে গুণে ঠিক তোর মত হয়েছে দেখছি , দারুণ দেখতে ঠিক সুস্মিতা সেনের মত। আভেরী খুব জোরে হেসে বললো  ,না রে সবাই বলে মিলি নাকি একেবারে সুবর্ণর মতো দেখতে হয়েছে  , তবে ভীষণ চঞ্চল, সুবর্ণর মত শান্ত নয়।

আভেরী বললো ,খুব ভাল তো, পিতৃমুখী কন‍্যা সুখী।



আভেরী এবার নীলাকে  বললো,শোন  তখন থেকে আমার কথাই বলে চলেছি । কালকেও ফোনে আমার কথাই বলেছি কিছুটা । দুদিন ধরে আমি অনেক বকবক করেছি , এবার তুই বল দেখি তোর কথা ।



-- আমার কথা?  কোথা থেকে শুরু করি বলতো?

হ্যাঁ শোন ,যেটা সেদিন তুই ফোনে জানতে চেয়েছিলি,সেখান থেকে শুরু করি।

উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত আমি মামাবাড়িতে থেকে পড়াশুনা করেছি তোর মনে আছে নিশ্চয়ই । আমি ক্লাস ইলেভেনে পড়াকালীন আমার মামার বিয়ে হয় ।মামার বিয়ের পর ওখানে আমার থাকা নিয়ে মামীর সাথে মামার প্রায়ই ঝামেলা হত তারপর কোনোরকমে টুয়েলভের পরীক্ষা দিয়ে আমি আমার মা বাবার কাছে বিহারে চলে যাই।ওখানেই পলিটিক্যাল সায়েন্স নিয়ে বি এ পাশ করি।  ছোটবেলা থেকে মা কে চাকরি করতে দেখেছি তাই আমার ও চাকরি করার খুব শখ ছিলো। চাকরি করবো বলে একটা টাইপ শর্টহ‍্যাণ্ড স্কুলে বাবা আমাকে ভর্তি করে দিলেন। ওখানেই আলাপ হলো শতানিক এর সাথে। ওর বোন পৃথা আমার‌ সাথে টাইপ ,শর্টহ‍্যাণ্ড শিখতো। শতানিক আমার থেকে   চার বছরের বড়ো ছিলো , স্টীল কোম্পানি তে চাকরী করতো ,খুব স্মার্ট, সুন্দর কথা বলতে পারে , দারুণ আবৃত্তি করে,নাটক করে ।কয়েকদিনের আলাপেই আমি শতানিক এর প্রেমে পড়ে গেলাম।ব‍্যস্, তারপর শুরু হলো আমাদের প্রেম পর্ব, লুকিয়ে চুরিয়ে দেখা করা, সিনেমা দেখা , চলতে লাগল ।মা বাবা দুজনেই অফিসে চলে যেতেন ,সেই সুযোগে  বেশ কয়েকবার আমি আর শতানিক একা বাড়িতে কাটিয়েছি।এরকম একদিন দুপুরে মায়ের শরীরটা  খারাপ হ‌ওয়ায় মা হঠাৎ বাড়িতে এসে  আমাদের দুজনকে দেখে । মা একটাও কথা বলেনি শুধু আমাদের দিকে প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল ।মায়ের ওই রকম চোয়াল শক্ত করা ভয়ংকর রূপ আমি কোনদিন দেখিনি। শতানিক মাথানীচু করে চুপ চাপ বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছিল সেদিন । শতানিক চলে যাবার পর  মা আমাকে শুধু জিজ্ঞেস করেছিল  যে , আমরা কি আমাদের বিয়ের​ কথা ভেবেছি? আমি বললাম এমন আলোচনা কখোনো হয়নি আমাদের মধ্যে। এরপর মা ঢকঢক করে দু গ্লাস জল খেয়ে ঘর অন্ধকার করে ফুল স্পীডে ফ‍্যান চালিয়ে শুয়ে পরেছিল বিছানায়। বাবা অফিস থেকে ফিরে আসার পর আমার সামনেই মা  বাবাকে সব জানালো ।বাবা খুব গম্ভীর হয়ে  আমাকে বললো কালকেই শতানিক কে বাড়িতে আসতে বলো, আমি কথা বলব ওর সাথে। পরদিন শতানিক এলো। আমাকে বিয়ে করার প্রস্তাব জানালো বাবাকে । বাবা বললেন খুব শিগগিরই ওর মা বাবার সাথে দেখা করবেন।দুই বাড়িতে কথা হলো। শতানিকের মা বাবার এই বিয়েতে প্রথমে  আপত্তি ছিল আমি কালো বলে ,তারপর অবশ্য ওঁরা রাজী  হয়ে গেলেন । আশীর্বাদের দিন , বিয়ের দিনক্ষণ সব  ঠিক হয়ে গেল ।  আশীর্বাদের দু দিন আগে শতানিকের বাবা এক লাখ টাকা পণ চাইলেন বাবার কাছে। আমার মা বাবার তো মাথায় হাত, সামান্য কেরানীর চাকরী করে এত টাকা কোথা থেকে জোগাড় করবেন! আমার তখন পাগলের মত অবস্থা ,বার বার শতানিক কে খবর পাঠাচ্ছি আমার সাথে কথা বলার জন্য কিন্তু ও কিছুতেই যোগাযোগ করলোনা,রাগে,দুঃখে ,অপমানে আমি বিয়ে টা ভেঙে দিলাম।

এতক্ষণ আভেরী মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনেছিলো , এবার চমকে উঠে বললো ,কি সাংঘাতিক ! সেই সময় এতবড়ো পদক্ষেপ তুই নিতে পারলি? তোকে দেখে তো একটু ও বোঝা যায় না তোর এত সাহস! তারপর কি করলি? তবে খুব ভালো করেছিস। এমন ছোটলোক ফ‍্যামিলিতে ভাগ্যিস বিয়ে করিসনি ।



-- কি আবার করবো ? মানসিক ভাবে একেবারে ভেঙ্গে পড়লাম। আমার এই মানসিক অবস্থা দেখে মা বাবা আমাকে কিছুদিন কাউন্সিলর এর কাছে কাউন্সিলিং করালেন , খুব একটা উন্নতি হলনা আমার । তারপর সাইকায়াট্রিস্ট এর কাছে ট্রিটমেন্ট করালেন।। উনিই বললেন জায়গা পরিবর্তন করার কথা । আমাকে সুস্থ করার জন্যে  মা চাকরি ছেড়ে আমাকে নিয়ে কলকাতা চলে ‌এলো। প্রায় দুবছর এখানে ভাল সাইকায়াট্রিস্টের কাছে ট্রিটমেন্ট করে যখন পুরোপুরি সুস্থ হলাম তখন ওখানেই​ এক পরিচিতের মাধ্যমে সম্বন্ধ করে পরমেশের সাথে আমার বিয়ে হয়ে গেল। বিয়ের আগে পরমেশকে  শতানিকের ব্যাপারে সব জানিয়েছি ,সব জেনে শুনেই পরমেশ এই বিয়েতে রাজি হয়। আমাদের এক মেয়ে ,এখন ব‍্যাঙ্গালোরে চাকরী করছে।



আভেরী জিজ্ঞেস করলো শতানিক মানে‌ কি রে?



নীলা হেসে বললো মহাভারত পড়,  উত্তর পেয়ে যাবি।

আভেরী দু হাত উপরে তুলে আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে  রঙ করা সোনালী চুল গুলোতে আঙ্গুল চালাতে চালাতে বললো  আমি বেশ ভালো আছি বুঝলি , জীবনের কোনো গল্প নেই আমার  অজয় নদীর মত বয়ে চলেছি সারাবছর শুকনো আর বর্ষায় বন্যা  । এই বলে হাসতে হাসতে নীলার কোলের উপর লুটিয়ে পারলো, ঠিক যেমন সেই স্কুলবেলায় হেসে গড়িয়ে পড়া স্বভাব ছিল, আজও তেমনি আছে ।নীলা  বললো তা আর বলতে হবেনা। আমি বেশ বুঝতে পারছি যে তুই খুব ভালো আছিস, আমার মত বুড়িয়ে যাসনি ।এই পঞ্চাশে এসেও তোর রূপ যৌবনে কোনো খরা তো নজরে পড়ছেনা ,বলতে বলতে দুজনে হাসতে হাসতে এসে ডাইনিং টেবিলে বসলো।



                                         

       .                              ৫

নীলার থালায় সুন্দর করে সাজানো বাটি মাপা ভাত,পটল ভাজা,ঢ‍্যাঁরস ভাজা ,আলু ভাজা,বাটিতে মুগের ডাল ,শুক্তো, ঝিঙে পোস্ত ,সর্ষে দিয়ে পাবদা মাছের ঝাল,আমের টক আর কাঁচের প্লেটে চারটে মিষ্টি  আর দই । অনেক দিন পর এমন সুন্দর করে গুছিয়ে নলিনী কে কেউ খেতে দিল। দেড় বছর হল মা মারা যাবার পর থেকে এমনটা পায়নি নলিনী । দেখলো আভেরীর থালায় এক হাতা ভাত, একটু ডাল ,অল্প শুক্তো আর একটা ছোট পাবদা মাছ। নলিনী বললো ,তুই ওই টুকু খাবি! এবার বুঝতে পেরেছি এত সুন্দর ফিগার তুই কি করে মেনটেইন করিস।আভেরী  বললো , এই দেখ আমি সকাল থেকে কি কি খাই ,বলে কামিজ টা পেটের উপরে তুলে পেটে ইনসুলিন নিল।নলিনী বললো ,ইস কি সব আজে বাজে রোগ বাঁধিয়েছিস ,আভেরী বললো , শোন ,শোন আরও আছে,ঘুম থেকে উঠে থাইরয়েডের ওষুধ , ব্রেকফাস্টের পরে হাইপারটেনশন এর ওষুধ, দুপুরে খাবার পর কোলেস্টেরল এর ওষুধ রাতে হার্টের ওষুধ আর এর সাথে তিন বেলা খাওয়ার আগে ইনসুলিন তো আছেই। এই সব নিয়ে বিন্দাস আছি বুঝলি ।

নীলা বললো , তাহলে তুই দ‌ই, মিষ্টি কিচ্ছু খাবিনা ? মাসীমার জন্য একটা ওটসের প‍্যাকেট এনেছি কিন্তু তোর জন্যে তো কিছু আনা হলনা , ভাগ্যিস ক‍্যাডবেরি আনিনি ।আভেরী বললো ছাড়তো , তুই ও পারিস ,মা'র জন্য আবার ওটস আনতে গেলি কেন পাকামো করে ? তুই যে এলি এটাই তো আমার অনেক বড়ো পাওয়া।

নীলার হঠাৎ মনে পড়লো আসার সময় দুটো ভুট্টা কিনেছিল, বললো ,আভেরী তুই ভুট্টা খাস ? আভেরী মাথা দুলিয়ে বললো ভীষণ ভালোবাসি ভুট্টা খেতে।

নীলা  বললো , আমার ব‍্যাগে দুটো ভুট্টা আছে আসার সময় কিনেছিলাম। খেয়ে উঠে , হাত ধুয়ে ব‍্যাগ থেকে বের করে তোকে দিচ্ছি দাঁড়া । রান্না গুলো দারুণ হয়েছে কিন্তু তুই কিছু খাচ্ছিস না দেখে একটুও ভালো লাগছে না।

আভেরী রান্নার মাসী কে বললো ,মাসী আমার বন্ধু তোমার রান্নার প্রশংসা করছে, নীলাও  সাথে সাথে মাসীকে বললো দারুণ রেঁধেছো মাসী ,ঝিঙে পোস্তটা ফাটাফাটি হয়েছে । মাসী খুব খুশি হয়ে বললো , তাহেলে আরাকটুন দি? নীলা বললো ,না মাসী পেটে আর জায়গা নেই, বাড়িও ফিরতে হবে,  প্রায় চারটে বাজে।

মাসী বললো তোমরা উঠে হাত মুখ ধুয়ে গল্প করো ,এঁটো তো হাতেই শুকিয়ে গেলো।

বেসিনে হাত ধুতে ধুতে আভেরী বললো তুই বললি তোর মেয়ে চাকরি করছে তোর মেয়ের বিয়ে দিবিনা ? প্লীজ তাড়াতাড়ি বিয়ে দে, আমার অনেক গুলো নতুন শাড়ী আলমারিতে পরে আছে, ভাঙা হয়নি, আজকাল দামি শাড়ি পরাই হয়না , তোর মেয়ের বিয়েতে দারুণ দারুণ শাড়ি পরবো আর হেব্বি মাঞ্জা মেরে বুড়ো গুলোর মাথা ঘুরিয়ে দেব ,হাহাহাআআ।



 নীলা  বললো তুই দুর্বার বিয়ে নিয়ে  এত প্ল‍্যান করে ফেললি আর  ওটা নিয়েই আমি  খুব অশান্তি তে আছি বুঝলি।

দুর্বা যাদবপুর থেকে ইংরেজি তে অনার্স করে জে এন ইউ  থেকে মাস কমিউনিকেশন নিয়ে মাস্টার্স করে বছর চারেক হল, একটা ভালো চাকরি করছে ব‍্যঙ্গালোরে ।

 ছোটবেলা থেকে নিবিৎ  নামে ওর‌ই ক্লাশের একটা ছেলের সাথে ওর খুব বন্ধু্ত্ব ছিল।স্কুলে দুর্বার রেজাল্ট সবসময় নিবিতের থেকে অনেক ভালো হত । হায়ার সেকেন্ডারি তে ও দুর্বা নাইন্টি  পার্সেন্ট মার্কস পায় আর নিবিৎ এইট্টি টু পার্সেন্ট এর মতো পেয়ে জয়েন্ট এন্ট্রান্স দিয়ে প্রাইভেট কলেজে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে । তারপর খুব একটা ভালো কম্পানি তে ওর প্লেসমেন্ট না হ‌ওয়ায়  চাকরি ছেড়ে ম‍্যনেজমেন্ট পড়ে।ম‍্যানেজমেন্টের রেজাল্ট খুব ভালো হয় নিবিতের।  একটা আমেরিকান ব‍্যাংকে ভালো প‍্যাকেজের চাকরি পেয়ে যায় এক বছর হলো।এখন আমরা চাইছি দুর্বা আর নিবিতের  বিয়েটা  দিয়ে দিতে। নিবিতের মা ,বাবাও তাই চাইছেন ,ওঁরা দুর্বাকে খুব ভালোবাসেন । আমরা সবাই চাইছি আগামী বছর ওদের বিয়ে হোক  কিন্তু দুর্বা হঠাৎ বেঁকে বসেছে , ওএখন নিবিতকে কিছুতেই বিয়ে করতে চাইছেনা কারণ নিবিতের মাইনে ওর মাইনের থেকে অনেক বেশী। এই নিয়ে আমাদের সঙ্গে দুর্বার খুব ঝামেলা চলছে। আমি আর ওর বাবা চাইছি ব‍্যাঙ্গালোরে গিয়ে সামনাসামনি ওকে বুঝিয়ে আসি কিন্তু আমাদের কিছুতেই যেতে দিচ্ছে না ও।

পনেরো দিন হয়ে গেল আমাদের সাথে কথা বলেনা মেয়ে, আমরা ফোন​ করলে ফোন কেটে দেয়। অপারক হয়ে নিবিৎকে ফোন করি, নিবিৎ জানায় যে ওদের দুজনের মধ্যে কথা কাটাকাটি ,ঝগড়া রোজ হচ্ছে। এই  তোর এখানে আসাবো বলে যখন রেডি হচ্ছি তখন নিবিৎ  আমাকে ফোন করে জানালো কাল রাতে দুর্বা ওকে ফোনে বলেছে ওদের এই বিয়েটা হবেনা কারণ দুর্বার এ বিয়েতে আপত্তি আছে।

নিবিতের ফোন টা পেয়ে আমি খুব একটা আশ্চর্য হইনি জানিস ,আমার মনে হয়েছিল এমনই একটা কিছু ঘটতে চলেছে।

তবে দুর্বার এই সিদ্ধান্ত নিবিতের কাছ থেকে শুনে মুহুর্তের মধ‍্যে তিরিশ বছর আগের ছবি ভেসে উঠলো আমার চোখের সামনে । আমিও একদিন আমার বিয়ে ভাঙার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আর আজ আমার মেয়েও নিজের বিয়ে ভাঙার সিদ্ধান্ত  নিল অথচ দুটোর মধ্যে কতখানি তফাৎ!

আমি মনে হয় দুর্বাকে ভালো ভাবে মানুষ করতে পারিনি বুঝলি। মাইনের ফারাকের জন্য কেউ বিয়ে ভেঙে দিতে পারে ,এটা আমি ওর মা হয়ে বিশ্বাস করতে পারছিনা।



   নীলার চোখ মুছিয়ে দিতে দিতে আভেরী জানলার পর্দা সরিয়ে নীলাকে বললো, আরে দ‍্যাখ ,দ‍্যাখ বাইরে তাকা ,কি রোমান্টিক ওয়েদার ! বৃষ্টি শুরু হয়েছে ,চল চল দুজনে মিলে বৃষ্টিতে  ভিজি, কতদিন বৃষ্টিতে ভিজিনি।



"এমন দিনে তারে বলা যায় ,এমন‌ও ঘনঘোর বরিষায়---- "

    নীলার উদাত্ত কণ্ঠ  মিলে মিশেএকাকার হয়ে যেতে লাগলো শেষ বিকেলের বৃষ্টিতে ।