খ্বজার অভিশাপ



 





 





 





“আজ বড় আনন্দের দিন! এস তোমরাও হাত লাগাও! তোমাদের সামনে দাঁড়িয়ে আজ দিল্লির নতুন পাদশাহ! আজ কেবল ফুর্তির উৎসব হবে”, সদ্য সিংহাসন প্রাপ্ত দিল্লির সম্রাট হেমচন্দ্র তার সামনে রাখা মাংসের বাটিতে নরম রুটি ডুবিয়ে মুখে পুরে খুশিতে ডগমগ হয়ে বলে উঠলেন।





 হেমচন্দ্রের সম্মুখে বিস্বস্ত আফগান পারিষদেরা কিছুটা বিমুঢ়। পাদশাহের সামনে রাখা পাত্র থেকে খাবার মুখে তুলতে অস্বস্তি হওয়া খুবই স্বাভাবিক। কাল পর্যন্ত হেমচন্দ্র ছিলেন আদিল শাহের ভকিল-ই-আলা (মহামন্ত্রী)। আজ তিনি স্বঘোষিত সম্রাট। আগ্রা আর দিল্লি থেকে মোগলদের উচ্ছেদ করার উদ্দেশ্যে, গোয়ালিয়র থেকে সৈন্য নিয়ে আগ্রা রওনা দিয়েছিলেন। হেমচন্দ্রের নেতৃত্বে আদিল শাহের লক্ষাধিক সৈন্যের ভয়ে মোগল নগররক্ষক ইস্কান্দর খান সৈন্য সামন্ত নিয়ে দিল্লির পথে পালিয়ে যাওয়ার রাস্তা ধরেছিল। কাজেই আগ্রা অধিকার হেমচন্দ্রের পক্ষে একেবারে সহজ হয়ে গিয়েছিল। আগ্রার প্রাসাদ থেকে বিপুল অর্থ, মূল্যবান হীরে জহরত আর অস্ত্রশস্ত্রের মালিকানা পেয়েছেন হেমচন্দ্র, যাকে আদিল শাহ আদর করে ডাকেন – হেমু।





আগ্রা বিজয় করে দুদিন বিশ্রাম নিয়ে আবার শাহ-সৈন্য দিল্লি অধিকারের জন্য ইস্কান্দার খানের পিছু নেয়। আগ্রা থেকে দিল্লি অভিযানের সময় হিমুর আফগান সেনাপতিদের চোখে পড়েছে স্থানীয় মানুষের দৈন দশা। দুর্ভিক্ষ পীড়িত গ্রামকে গ্রাম পার হয়ে এসেছে এই সেনাবাহিনী। বাহিনীতে অবশ্য খাবারের কোনও অভাব নেই। আগ্রা থেকে যথেষ্ট রসদ সঙ্গে বেঁধে আনা হয়েছিল। তার উপর যেখানে চাষিদের গ্রাম চোখে পড়েছে, সেখানেই চলেছে দেদার লুঠতরাজ। হেমুর নেতৃত্বে আদিল শাহের সেনার দিল্লি অভিযানের খবর দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়তে দেরী হয়নি। দিল্লির নগররক্ষক তারদি বেগ তার বিশ হাজার সৈন্য নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল হেমুর সৈন্যদলের উপর। তারদি বেগ মোগলদের চাকরি করলেও একসময় শের শাহের দলে ভিড়েছিল, সেকথা হেমুর অজানা নয়।  এই দুর্বলতাই কাজে লাগিয়ে দিল্লি অভিযান তার। তুঘলকাবাদে বিশাল সৈন্যদল নিয়ে চতুর সমর নায়ক হেমু, ইচ্ছে করেই কিছুটা পিছিয়ে গিয়ে ভান করেছিলেন ছত্রভঙ্গ হওয়ার। সেই মুহূর্তে তারদি বেগ ধরে নিল হেমুর পরাজয় হয়েছে, আর সে সর্বশক্তি দিয়ে হেমুর কেন্দ্রীয় বাহিনীর উপর আক্রমণ করল। ডান ও বাম দিক দিয়ে সৈন্য আর ঘোড়া দিয়ে ঘিরে ফেলে তিনহাজার সৈন্য কচুকাটা করে ফেলল সূর সৈন্য। ঝটিকা আক্রমণের বেগ সামলাতে না পেরে তারদি বেগ যুদ্ধ ক্ষেত্র ছেড়ে পালিয়ে গেল। হেমুর দলে হতাহত যৎসামান্য।





তুঘলকাবাদে মোগলদের সঞ্চিত ধন এখন হেমুর দখলে। দিল্লির দুর্গ দখল করেই হেমু নিজেকে রাজাধিরাজ ঘোষণা করেছেন। শের শাহের গড়ে তোলা সূর সাম্রাজ্য এখন অস্তাচলে। ভোগবিলাস আর সুরার নেশা আদিল শাহকে অনেক আগেই দুর্বল করে তুলেছিল। হেমু শুধু তার সামনে আসা সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছেন।





তুঘলকাবাদ দুর্গে আপাতত সৈন্য সহ বিশ্রাম নেওয়া স্থির করেছেন রাজা হেমু। ধীরে সুস্থে যমুনার পাড়ে শের শাহের গড়ে তোলা দুর্গ অধিকার করা যাবে। দূত খবর এনেছে, সেখানেও মুষ্টিমেয় মোগল সৈন্য দুর্গের অবরোধ ছেড়ে পালিয়ে গেছে। 





রাজা হেমুর খাবারের থালা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সেনাপতি রামাইয়া, যে নাকি সম্পর্কে হেমুর আত্মীয়ও বটে, কিছুটা সংশয় নিয়ে স্বঘোষিত মহারাজের উদ্দেশ্যে বলে উঠল, “দিল্লি ও আগ্রায় মানুষের অবস্থা শোচনীয়। শুনলাম দুর্ভিক্ষ পীড়িত মানুষ এখানে মানুষেরই মাংস খায় খিদের জ্বালায়। এবছর তেমন বৃষ্টি হয়নি। চাষবাসের অবস্থা ভাল নয়। মহামারীতে মারা গেছে বহু মানুষ। এখনো আমাদের রসদ যা আছে, তাতে কিছুদিন চলে যাবে, তারপর...”





হেমুর হাত খাবারের থালার উপর মুহূর্তে থেমে যায় রামাইয়ার কথা শুনে। কিছুক্ষণ নীরব থেকে চিন্তিত গলায় হেমু বলেন, “মোগলরাই প্রজাদের এই দৈনদশার জন্য একমাত্র দায়ী। ওদের উচ্ছেদ না করলে দিল্লি-আগ্রায় জনজীবন স্বাভাবিক হবে না। তুমি এইসব চিন্তা না করে বরং খাবারে মন দাও।”





সম্রাটের খাবার সময় সাধারণ মানুষের দুর্দশার গল্প শোনানো বা দুর্ভিক্ষের বয়ান দেওয়া একান্তই অনুচিত, একথা জানা আছে অভিজ্ঞ সেনাপতির। অন্য কোনও রাজা হলে আজ হয়ত রামাইয়ার মাথা ধড় থেকে এতক্ষণে ছিটকে পড়ে মাটিতে গড়াগড়ি খেত। কিন্তু সদ্য সিংহাসন প্রাপ্ত হয়েছেন হেমু। অতি সাধারণ জীবন থেকে উঠে এসেছেন রাজার মসনদে। বিচক্ষণ হেমুর স্বভাবে নেই যখন তখন রেগে ওঠা।





শাহি খানসামা এসে সেনাপতিদের সামনে খাবারের থালা রাখে। পথশ্রম কিছু কম হয়নি! রাজা হেমুর এখন বিশ্রাম প্রয়োজন। কিন্তু মাথায় তার অনেক চিন্তার ভিড়। আশু কর্তব্য হল দিল্লির বুক থেকে মোগল সাম্রাজ্যের সব চিহ্ন লোপাট করা। এখন সুবর্ণ সুযোগ। সদ্য প্রয়াত হয়েছেন মোগল পাদশাহ হুমায়ূন। মোগল বেগদের মধ্যে একটুও বনিবনা নেই। ক্ষমতা লোভী বেগ আর কিছু আফগান সেনাধ্যক্ষ হুমায়ূন মারা যেতেই মাথা চাড়া দিয়েছে, শকুনে যেমন মরা দেখে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ওদিকে মোগল বংশের পরবর্তী ওয়ারিশ আকবরকে পাদশাহের সিংহাসনে অভিষিক্ত করেছে তার অভিভাবক বৈরাম খাঁ। লোকটার মতলব বোঝা মুশকিল। আকবরকে সামনে রেখে ক্ষমতার মধু চেটে খাচ্ছে বৈরাম খাঁ। আকবর এখন নেহাতই বালক। মোগল সেনার সাথে সে এখন কালানৌর (পাঞ্জাব) শিবিরে। হুমায়ূন মারা যাওয়ার পরও সে দিল্লি ফিরতে পারেনি এখনো পর্যন্ত।





দিবানিদ্রা দেওয়া ধাতে নেই হেমুর। কিন্তু শরীরকে ক্লান্তি মুক্ত করতে কিছুক্ষণ বিশ্রাম না নিলে হেমুর মাথা কাজ করবে না। দিল্লি তার অপরিচিত জায়গা নয়। এই দিল্লির বাজারেই তিনি একদিন ইসলাম শাহের আমলে বাজারের অধ্যক্ষ ছিলেন। আরও অনেক আগে দিল্লির ৫০ ক্রোশ দূরে রেওয়ারি থেকে লবণ কেনাবেচার ব্যবসা করতেন। এই শহর তাই নিজের হাতের তালুর মত চেনা হেমুর। সুখশয্যায় বিশ্রাম নিতে চোখ বুজতেই কত স্মৃতি ভিড় করে আসে সদ্য দিল্লির সিংহাসনে আরোহিত রাজা হেমুর। সাড়ে তিনশ বছর পর প্রথম হিন্দু রাজা আজ দিল্লির মসনদে। হেমু ঠিক করলেন, বহু ব্যবহৃত নামটা আর নয়, এবার থেকে নিজেকে বিক্রমাদিত্য বলে পরিচয় দেবেন তিনি।





দূরে আরবল্লি পর্বতের পিছনে সূর্য অস্ত যাচ্ছে, হয়তো বা মোগল সাম্রাজ্যের সূর্যও আজ অস্তমিত। দুর্গের বাতিদানে আলো জ্বালানোর ব্যস্ততা শুরু হয়েছে। সৈন্যেরা ক্লান্তি ছেড়ে নিজেদের মধ্যে হাসি মস্করায় মেতে উঠেছে। শাহি রসোইতে নানাবিধ ব্যঞ্জনের প্রস্তুতি চলছে। পঞ্চাশ হাজারেরও বেশি সৈন্যের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করা সোজা কথা নয়। হেমুর সবদিকে কড়া নজর। আদিল শাহের অব্যবস্থায় সৈন্যদলে অরাজকতা কী আকার ধারণ করতে পারে, তা তার ভালই জানা আছে। আফগান সেনাপতিদের অনেককেই হেমু সন্দেহের তালিকায় রাখেন। যদিও তার নিজস্ব গুপ্তচরেরা সৈন্যদলের মধ্যে থেকে বিদ্রোহের সামান্য আভাস দেখা গেলেই হেমুর প্রধান পারিষদকে সব জানিয়ে দেয়। শুধু বেতনে কাজ হয় না, ভাল থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা করতে না পারলে লড়াই করার মনোবল হারায় সৈন্যেরা।





রামাইয়া ছাড়াও আর এক বিস্বস্ত সেনাপতি আছে হেমুর — সে হল সাদি খান কক্কড়। এই দুই সেনাধিনায়ক না থাকলে, আদিল শাহের হয়ে বাইশটা যুদ্ধ জেতা অসম্ভব ছিল হেমুর পক্ষে। ইসলাম শাহ মারা যাওয়ার পর অন্যায় ভাবে ক্ষমতা দখল করে কুটিল আদিল শাহ। হেমচন্দ্রের সাংগঠনিক দক্ষতা বুঝতে পেরে একেবারে গোপন বাহিনীর অধ্যক্ষ থেকে তুলে এনে মহামন্ত্রীর পদে বসিয়ে দিতে দেরী করেনি আদিল শাহ। নিজেকে সূর বংশের উত্তরাধিকারী ঘোষণা করে চরম বিলাসিতায় সে গা ভাসিয়ে দিতে পেরেছিল কেবল হেমচন্দ্রের ভরসায়। ব্যবসা থেকে শুরু করে যুদ্ধ, সবেতেই দক্ষ ছিল হেমচন্দ্র।





হেমু স্থির করেন —দিল্লি জয়ের পরই ক্ষমতার সদ্ব্যবহার করতে হবে। নইলে আদিল শাহের আজ্ঞাদাস হয়েই বাকি জীবন কাটিয়ে দিতে হবে তাকে। বিক্রমাদিত্য নাম গ্রহণ করে ঝেড়ে ফেলে দিতে হবে পিছনে ফেলে আসা সব ইতিহাস। দুই সেনাপতি রামাইয়া আর কক্কড়কে ডেকে পাঠালেন হেমু।


“কাল প্রত্যুষে আমি রাজপদে সরকারি ভাবে ক্ষমতা হাতে নেব। রাজপুরহিত চন্দ্রবর্মণকে জানিয়ে দাও, তিনি যেন দুর্গে এক যজ্ঞ করে আমার অভিষেকের পথ সুপ্রশস্ত করেন। কাল থেকে আমার নাম হবে বিক্রমাদিত্য।”





“জয় মহারাজ বিক্রমাদিত্যের জয়, মহারাজ বিজয়ী হন”, হাসি মুখে তিনজনের আলাপচারিতার মধ্যে প্রবেশ করেন চন্দ্রবর্মণ।





“জয়ধ্বনি না হয় কালই দেবেন মহাপণ্ডিত। আপনার আশীর্বাদ ছাড়া দিল্লির সিংহাসনে বসব কেমন করে?” দুই হাত প্রসারিত করে আবাহনের ভঙ্গি করলেন হেমচন্দ্র। চন্দ্রবর্মণ তার বহু সমর অভিযানের সঙ্গী। বয়সে সামান্য বড়ই হবেন হেমুর চাইতে। তবে দুজনের বন্ধুত্ব সর্বজনবিদিত। আজ নিজে থেকেই বন্ধুর কাছে এসে শুনলেন তারও পদোন্নতি ঘটেছে। হেমচন্দ্রের উপর তার একটু পক্ষপাতিত্ত্বও আছে, ধর্ম তার অতি অবশ্য একটি কারণ।





তামার পাত্রে রাখা চন্দন লেপে আঙুল ডুবিয়ে হেমচন্দ্রের ললাটে তিলক কেটে দিয়ে হাসতে হাসতে বলেন চন্দ্রবর্মণ, “তখন জয়ধ্বনি দেবে সভাসদেরা, আজ রাজগুরু তোমায় অভিবাদন করার লোভ সামলাতে পারছে না হেমচন্দ্র...ও হো, বড় ভুল হয়ে গিয়েছে... মহারাজ হেমচন্দ্র।”





হাসতে হাসতে বন্ধুকে আলিঙ্গনে বেঁধে ফেলেন সম্রাট হেমচন্দ্র। তাকে বিদায় জানিয়ে নৈশ অধিবেশন বসে দুই সমর অধিনায়ক আর সম্রাট। বাইরে তখন মানুষের কোলাহল স্তিমিত, হাতি-ঘোড়ার পালও খাবারে পেট বোঝাই করে বিশ্রাম নিচ্ছে। বৃংহিত আর হ্রেষাধ্বনিও সম্রাটের ঘর পর্যন্ত পৌঁছচ্ছে না।








কালানৌরের শিবিরে সেদিন সিংহাসনে বসা বালকটির দৃঢ় মুখমণ্ডল মশালের আলোয় উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। রাতের তৃতীয় প্রহরে গোটা শিবির নিস্তব্ধ। শুধু মাঝে মধ্যে আস্তাবলে বাঁধা অসহিষ্ণু ঘোড়াদের ক্ষুর ঠোকার শব্দ ভেসে আসছিল। শিবিরের অন্তরভাগে সম্রাটের দরবারে মাত্র চারজন সিংহাসন ঘিরে বসে। পর্দার বাইরে অতন্দ্র দুই প্রহরী, তাদের খোলা তরবারি  সামান্য আলোতেও ঝকমক করছিল। ঘরের মধ্যে চারজনের মুখে অনেকক্ষণ কোনও কথা ছিল না। সদ্য পিতৃহারা কিশোর সম্রাট আকবর, মশালের লেলিহান শিখার দিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবছিলেন।


ঘরের নিস্তব্ধতা ভেঙে দিয়ে চারজনের একজন বলল, “মাপ করবেন জনাব, আমার মনে হয় দিল্লি জয়ের আশা ছেড়ে দেওয়াই ভাল।”








তার কথা শুনে উঠে দাঁড়ালেন বৈরাম খাঁ।  চেঁচিয়ে উঠলেন, “না, কক্ষনো না। সাচ্চা যোদ্ধা কখনো যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পিঠ ঘোরায় না। তুমি বুড়ো হয়ে যেতে পাড় তারদি বেগ, কিন্তু আমার হাড়গুলো এখনো শক্ত আছে।” তারপর সম্রাট আকবরের দিকে ফিরে গলা নামিয়ে বললেন, “গুস্তাখি মাফ করবেন জাঁহাপনা। আমার হয়তো মন্তব্য করা উচিত হয়নি। তবে এই অন্যায় আমি হতে দেব না। এই মুহূর্তে হেমুর ভয়ে পশ্চাদপসরণ করার অর্থ মোগল সাম্রাজ্যের অবসান। এবার আপনি আপনার রায় দিন হুজুরে আলা।”








আকবর সবার মুখের প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করলেন, কিন্তু কিছুই বললেন না। বয়সে নবীন এই সম্রাটকে বৈরাম খাঁ ভালই চেনেন। সিদ্ধান্তে স্থির আছেন ঠিকই, কিন্তু তিন প্রদেশের রাজপালক যতক্ষণ না মুখ খুলছেন, স্ব-মতামত খুলবেন না। ইস্কন্দর খান মুখ নিচু করে আছে, কারণ প্রায় বিনা যুদ্ধে আগ্রা ছেড়ে দিয়ে এসেছে হেমুর হাতে। তারদি বেগও শোচনীয় ভাবে হেমুর সৈন্যের হাতে পরাজিত হয়েছে। লোকলস্করই শুধু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাই নয়, দিল্লির রত্নভাণ্ডার হেমুর হাতে তুলে দিয়ে পালিয়ে এসে, এখন দিল্লি বিজয়ের বাসনা ত্যাগ করতে পরামর্শ দিচ্ছে। লোকটা মোটেই সুবিধের নয়। মনে এক আর কাজে আর এক। স্বার্থপর একটা সুবিধাবাদী সেনানায়ক। হুমায়ূনকে বহুবার প্রতারণা করেছে। তলায় তলায় মোগলদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে আফগানদের সাহায্য করেছে এমনও খবর আছে বৈরাম খাঁর কাছে। হুমায়ূনের প্রশ্রয়েই লোকটা এখনো এই পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। নইলে বৈরাম খাঁর হাতে অনেকদিন আগেই তাকে বিদায় নিতে হত ধরাধাম থেকে। তৃতীয় জন হল আলি কুলি খান শাহবানি। এই লোকটা মন্দ নয়, একজন অত্যন্ত সমর কুশলী সেনাধ্যক্ষ, অনুগতও বটে। সম্ভলের ক্ষমতা হারিয়ে সে-ও কালানৌর শিবিরে আকবরের ছত্রছায়ায় শরণ নিয়েছে।





আলি কুলি খান সভয়ে বলল, “জাঁহাপনা যদি সম্মতি দেন, তবে এই বান্দা তার মতামত জানাতে পারে।”





আকবর তার মস্তক সামান্য ঝুঁকিয়ে সম্মতি দিলেন নীরবে। আলি কুলি খান বলল, “আমাদের সব সৈন্য মিলিয়ে মেরেকেটে পঁচিশ বা তিরিশ হাজারের বেশি হবে না। ওদিকে হেমুর সৈন্যদলে কমপক্ষে লাখ খানেক সেনা আর অত্যন্ত বিপদজনক হাতিয়ার আছে। এই সময়ে তার সাথে যুদ্ধে না নেমে বরং কাবুলের দিকে যাওয়া যাক। আরও সৈন্য সংগ্রহ করে, তারপর সময় বুঝে দিল্লি বা আগ্রা আক্রমণ করাই বুদ্ধিমানের কাজ।”





তারদি বেগ সাগ্রহে বলে উঠল, “এই কথাটাই আমিও বলতে চাইছি। আমি নিজে হেমুর সাথে যুদ্ধ করে যা বুঝেছি — ওর দলের সৈন্য সংখ্যাই শুধু নয়, পাঁচ ছশো হাতিই এই যুদ্ধে আমাদের বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।”





আকবর ইস্কন্দর খাঁর দিকে তাকালেন। সে মুখ নিচু করে নিঃশব্দে জানিয়ে দিল - বাকি দুই সমর নায়কের সাথে সে একমত। বৈরাম খানে চোখ মশালের আলোতেও ধকধক করে জ্বলছে। তারদি বেগের কথায় তার সারা শরীর জুড়ে জ্বালা ধরেছে। সদ্য সম্রাটের সিংহাসনে বসা পাদশাহকে সবার সামনে তারদি বেগের প্রতারণার কথা খুলে বলতেও পারছেন না।  কিন্তু ততক্ষণে তার করণীয় স্থির করে ফেলেছেন। আগ বাড়িয়ে তিনিই বলে উঠলেন, “অনেক রাত হয়েছে। সম্রাটের এখন বিশ্রাম প্রয়োজন। আগামীকাল আবার আলোচনা করে যুদ্ধ হবে, না কাবুলের পথে পা বাড়াবো, সে কথা ভেবে নেওয়া যাবে।” তারপর সম্রাট আকবরের দিকে ঘুরে মাথা উঁচু করে বললেন, “জাঁহাপনা, যে যাই বলুক, আমার মনে হয় আপনার পিতার শ্রমকে বিফলে যেতে দেওয়া উচিত হবে না। আর মনে রাখতে হবে, সম্রাট বাবরের গড়ে তোলা হিন্দুস্তান, আদিল শাহের ভাড়াটে সেনাপতির কাছে বিকিয়ে দেওয়া উচিত কাজ হবে না।”







কেল্লার বিজয় মণ্ডলে সুউচ্চ সিংহাসন প্রস্তুত। সম্রাট হেমচন্দ্রের আজ অভিষেক। বিজয়মণ্ডলের মিনারকে রঙ বেরঙের পতাকা দিয়ে সুসজ্জিত কড়া হয়েছে। কেল্লার উঁচু প্রাচীরের উপর সসস্ত্র সৈন্যদল পাহারা দিচ্ছে। সফর (অক্টোবর) মাসের শেষ ভাগ বলে বাতাস এখন ঠাণ্ডা। দু দুটো যুদ্ধ জিতে সৈন্যেরা হালকা মেজাজে নিজেদের মধ্যে ঠাট্টা তামাশা করছে। বিজয়মণ্ডলের নিচের রুদ্ধকক্ষে শাহি পোশাক গায়ে পরে নিতে নিতে সম্রাট তার খাস বান্দা গোলাম আলিকে জিজ্ঞেস করলেন, “এই কেল্লাটা প্রায় দুশো বছরের পুরনো, কিন্তু এখনো বেশ নতুন আছে। কে বানিয়েছিল জানিস?”





গোলামের রাজশাহী কথা জানার কথা নয় সম্রাট যেন নিজেই স্বগতক্তি করলেন। গোলাম সম্রাটের কাপড়ের ভাঁজ ঠিক করে দিচ্ছিল। সে অস্ফুটে বলল, “বুড়ো আসগর বলতে পারবে জনাব। আমি মুখ্যু মানুষ, কী-ই বা জানি...”





হেমু ধমক দিয়ে বললেন, “শোন তবে, এই কেল্লা বানিয়েছলেন ঘিয়াসুদ্দিন তুঘলক। তুর্কি আর মঙ্গোলদের হানা থেকে দিল্লিকে বাঁচাতে এইখানে তিনি কেল্লা বানান। দাপুটে সুলতানকে ভয় পেত সারা হিন্দুস্তানের লোক। দিল্লির সব কারিগরকে সুলতান লাগিয়ে দিয়েছিলেন কেল্লা বানানোর কাজে। খ্বাজা নিজামুদ্দিন তখন জলের কষ্ট থেকে মানুষকে বাঁচাতে ঘিয়াসপুরে একটা বিশাল কুয়ো তৈরি করবার কথা ভাবছিলেন। সব কারিগর ঘিয়াসুদ্দিনের কেল্লা বানাতে চলে গেলে খ্বাজার কুয়ো তৈরি করা মুশকিল হয়ে গেল। খ্বাজা সুলতানকে অভিশাপ দিয়ে বলেন, ‘ইয়া রহে উজাড়, ইয়া বসে গুজ্জর’। ব্যাস, কেল্লা বানাবার পর সুলতান মরল, এই কেল্লায় নতুন সুলতান মুহম্মদ মসনদে বসল, সেও টিকল না। মোগলরা এই কেল্লা দখল করল, মসনদ তাদেরও হাত ছাড়া হয়ে গেল। এবার যে সম্রাট বসবে, তার গায়েও খ্বাজার অভিশাপ লাগবে, সেও...।” সম্রাটকে উদাস হয়ে যেতে দেখে গোলাম আলি বিব্রত হল। রাজ পুরোহিত চন্দ্রবর্মণ এলেন সেনাপতি রামাইয়াকে সঙ্গে নিয়ে। অভিষেকের লগ্ন আসন্ন। সম্রাটকে নিয়ে যেতে এসেছেন তারা।





এক হাজার শঙ্খধ্বনি উঠল। কেল্লায় সৈন্য সামন্ত, গায়ক, ভিখারিরা সসম্মানে উঠে দাঁড়িয়ে সম্রাট হেমচন্দ্রকে কুর্নিশ করল। রণভেরী বাজল বিজয় মণ্ডলের তোরণ থেকে। হাতির দল শুঁড়ে করে গোলাপ-জল ছিটাতে লাগল। রাজপুরোহিত জলদগম্ভীর স্বরে মন্ত্র উচ্চারণ করলেন। দুই হাত তুলে সৈন্য ও প্রজাদের আশীর্বাদ জানালেন সম্রাট হেমু। উপস্থিত প্রতিটি মানুষকে দেওয়া হল একটা করে স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা। সম্রাটের ললাটে রক্ত চন্দনের তিলক কেটে দিলেন রাজপুরোহিত। গুপ্তচর প্রধান কাসেম খান এসে সেনাপতি রামাইয়ার কানে কানে কিছু বলতে সে সজাগ হয়ে উঠল। নিচুস্বরে সম্রাটকে বলল, “মোগল সৈন্য পাঞ্জাব থেকে দিল্লির দিকে রওনা দিয়েছে। অবিলম্বে সৈন্য সাজানো প্রয়োজন। পরবর্তী আজ্ঞার জন্য বান্দা প্রস্তুত।”





সভা ভঙ্গ করে দিলেন সম্রাট হেমু। কপালে তার গভীর ভাঁজ। বাইশটা যুদ্ধ জেতার অভিজ্ঞতা আছে বলেই তিনি জানেন, প্রতিটি যুদ্ধ একেবারে আলাদা চরিত্রের। শত্রুকে ছোট করে ভাবলেই হার নিশ্চিত। এবার যে মোগলেরা দিল্লি আবার জয় করার জন্য সর্বশক্তি লাগিয়ে দেবে, সে বিষয়ে তিনি নিশ্চিত। হেরে যাওয়া শত্রু এখন তীরের আঘাতে রক্তাক্ত হওয়া বাঘের চাইতে কম হবে না। ইতিমধ্যেই গুপ্তচরের খবর বলছে আগ্রা থেকে পালিয়ে যাওয়া ইস্কান্দর খাঁ আর দিল্লিতে পরাজিত হওয়া তারদি বেগ, দুজনেই মোগল শিবিরে আশ্রয় নিয়েছে। নাবালক সম্রাট আকবর অভিজ্ঞতায় নেহাতই কাঁচা হতে পারে, কিন্তু তার অভিভাবক বৈরাম খাঁ একজন ধুরন্ধর রাজনিতিক এবং যুদ্ধ বিশারদ। তিনি যে আবার কী চাল চালছেন, কে জানে?





শাহি কক্ষে সদ্য পাতা গালিচার উপর পায়চারী করতে করতে সম্রাট সেনাপতি সাদি খান কক্কড়কে হুকুম দিলেন, “এখনই অস্ত্রশস্ত্রের ভাণ্ডার পাঞ্জাব অভিমুখে রওনা করিয়ে দাও। বিশ্বস্ত একজনের নেতৃত্বে সেই ভাণ্ডার পাহারা দেওয়ার ব্যবস্থা কর। তারপর তিনটে সেনাদল পর্যায়ক্রমে রওনা কর। আমি কাল সকালে তিরিশ হাজার সৈন্য নিয়ে নিজে এগিয়ে যাব। আমার যাত্রার আগে তুমি ও রামাইয়া তোমাদের সৈন্য দল নিয়ে রওনা দেবে। এই দুর্গের দায়িত্ব দাও রাজপুরোহিত চন্দ্রবর্মণকে। শাহি খাজানা তার কাছেই বেশি সুরক্ষিত থাকবে। এখানে মহামারীতে মানুষের যা দুর্দশা, যে কোনও মুহূর্তে গুজ্জরেরা কেল্লার দখল নিতে পারে। খ্বাজা নিজামুদ্দিনের অভিশাপ আছে এই কেল্লার উপরে। যাও প্রস্তুতি নাও।”





কালানৌর শিবিরে দিনের প্রথম প্রহরেই দাবানলের মত খবরটা ছড়িয়ে পড়ল – মোগল সেনাপতি তারদি বেগ নিহত। গত রাতেই তাকে গলা কেটে হত্যা করা হয়েছে। সেনা শিবির তাই নিস্তব্ধ। তাকে দিল্লির কেল্লা ছেড়ে দেওয়ার শাস্তি পেতে হয়েছে, এমনটাই ধারনা সেনা ও সেনাপতিদের। আলি কুলি খান আর ইস্কন্দর খানকেও এই হত্যার মাধ্যমে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, মোগল-শাহির বিরুদ্ধ মত দিলে কারো নিস্তার নেই। যে কজন সেনা তারদি বেগের অধীনে ছিল, তাদের অবিলম্বে বৈরাম খানের অধীনে নিয়োগ করা হয়েছে।





দিল্লি অভিযানের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। মাহুত আর ঘোড়সওয়ারেরা তাদের হাতি-ঘোড়াদের স্নান করিয়ে দীর্ঘ যাত্রার জন্য তৈরি। তলোয়ার শান দিতে ব্যস্ত যোদ্ধারা। ইস্কন্দর খানকে আদেশ দেওয়া হয়েছে সর্বাগ্রে যুদ্ধ যাত্রা করার জন্য। গুপ্তচরের খবর অনুযায়ী, হেমুর সৈন্যদলের একটা বিরাট অস্ত্রভাণ্ডার দিল্লি থেকে রওনা দিয়েছে। বৈরাম খাঁ ইস্কন্দরকে সেই ভাণ্ডার লুঠ করার জন্য পাঠাচ্ছেন। আলি কুলি খানকে দ্বিতীয় সৈন্যদল নিয়ে এক প্রহরের সময় ব্যবধানে যাত্রা করতে বলা হয়েছে। মোট তিন ভাগে আকবরের সৈন্যদল বিভক্ত করা হয়েছে। বাম এবং ডান দিক থেকে আক্রমণ করবে দুই সেনাপতি ইস্কন্দর আর আলি কুলি খান, মধ্যভাগ সামলাবেন বৈরাম খান স্বয়ং। সম্রাট আকবরের অবস্থান হবে তারও পিছনে।





আকবর তার কক্ষে ধীর পদক্ষেপে পায়চারী করছেন। বৈরাম খান সেনাপতিদের নির্দেশ দিতে ব্যস্ত।  কথা বলতে বলতে আড় চোখে পাদশাহের দিকে লক্ষ্য করে তার মনে হল তিনি যেন একটু বিচলিত। তারদি বেগের মৃত্যুটা মেনে নিতে পারেননি। এতবড় শাস্তি না দেওয়ার পক্ষেই ছিলেন আকবর। কিন্তু সুযোগ বুঝে বৈরাম তার বহুদিনের ক্রোধ মিটিয়ে নিয়েছেন। একটা শত্রুর বিনাশ হয়েছে। একবার দিল্লির মসনদ হাতে এলে নাবালক সম্রাটকে সরিয়ে দেওয়া যাবে ধীরে সুস্থে। বৈরাম খাঁ নিজে সিয়া মুসলমান। কখনো কখনো সুন্নি মোগলদের উদারনীতি তিনি মন থেকে মেনে নিতে না পারলেও, পরিস্থিতির চাপে পড়ে বাধ্য হয়ে সম্মতি দিয়েছেন।





সেনাপতিদের বিদায় জানিয়ে তিনি আকবরের কাছে এসে বললেন, “এই যুদ্ধের স্বার্থে তারদি বেগকে মারা ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না জাহাঁপনা। তার চাইতে দক্ষ সেনাধ্যক্ষের অভাব নেই মোগল শিবিরে।”





কিশোর আকবর পদচারনা থামিয়ে বৈরাম খাঁর মুখের দিকে তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, “যুদ্ধের প্রস্তুতি নিন। আব্বা হুজুরের স্বপ্ন আমি পূরণ করবই। যুদ্ধে আমাদেরই জয় হবে। প্রথম পানিপথের যুদ্ধে যেমন আব্বা হুজুরের পিতা বিজয়ী হয়েছিলেন, এবার তার অউলাদের অউলাদ খালি হাতে যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে ফিরবে না।”





“জাহাঁপনা জালালুদ্দিনের জয় হোক। এবার তাহলে অনুমতি করুন, যুদ্ধযাত্রার প্রস্তুতি নিই”, বলেই চিন্তা মগ্ন হলেন বৈরাম খাঁ।  আকবরের এই দৃঢ় মনোবলের কাছে তার হার হবে না তো! দেখাই যাক, রাজনীতির কূট খেলায় কে জয়ী হয়। আপাতত যুদ্ধের আয়োজনের দিকেই মন দেওয়া শ্রেয়।




কালানৌর শিবির খিজির খান ও তার পাঁচ হাজার সৈন্যের তত্ত্বাবধানে রেখে বৈরাম খাঁ বিশ ক্রোশ পথ পাড়ি দিয়ে প্রথম সুসংবাদ পেলেন – ইস্কন্দর হেমুর বিপুল অস্ত্রভাণ্ডার লুঠ করতে পেরেছে। পানিপথের কাছেই সে সৈন্যদল নিয়ে আগলাচ্ছে সেই ভাণ্ডার।  দাবা খেলার প্রথম বাজী তিনিই জিতেছেন। হেমুর আস্ত্রভান্ডারের অনেকটাই মোগলদের আগ্রা ও দিল্লির কেল্লা থেকে হেমু কেড়ে নিয়েছিল। এবার হেমুর সংখ্যায় বড় সৈন্যদলকে কৌশলে জব্দ করাই হচ্ছে আসল কাজ। কেন্দ্রীয় বাহিনীতে দশ হাজার সৈন্য নিয়ে বৈরাম খাঁ এগিয়ে চলেছেন। তার পিছনে দশ ক্রোশ দূরে আছেন পাদশাহ আকবর। তাঁকে পাহারা দিচ্ছে দুই হাজার সশস্ত্র ঘোড়সওয়ার। এতক্ষণে আলি কুলি খানের পৌঁছে যাওয়ার কথা। দুদিক থেকে আক্রমণ করে হেমুকে পরাস্ত করতে পারলেই শেষ মারটা বৈরাম খাঁ-ই দেবেন।





ওদিকে অস্ত্রভাণ্ডার লুঠ হয়ে যেতে হেমু যথেষ্ট চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। সামান্যই হতাহত হয়েছে যদিও, কিন্তু এতে যে মোগলদের শক্তি বৃদ্ধি হল, এ বিষয়ে তিনি নিশ্চিত। একটাই ভরসা— প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত পাঁচশো হস্তিযূথ আর দশ হাজার অশ্বারোহী সৈন্য হেমুর দখলে।





শের শাহ্‌ সূরের তৈরি রাস্তা ধরে এগিয়ে চলেছে দিল্লির সম্রাট হেমচন্দ্রের সেনাদল। ঘোড়ার ক্ষুরের আঘাতে ধুলো উড়ছে। হেমু বসে আছেন তার প্রিয় হাতি কালাপাহাড়ের উপর। পুরুষ হাতিটির নাম তাঁরই দেওয়া। সবকটা যুদ্ধে কালাপাহাড় তাকে সুরক্ষিত অবস্থায় শিবিরে পৌঁছে দিয়েছে। বেলা তৃতীয় প্রহরে রোদের তেজ যথেষ্ট, কিন্তু পথের দু’ধারে আকাশ ছোঁয়া গাছেদের ছায়া পথশ্রম কমিয়ে দিয়েছে। শের শাহ্‌- এর পৃষ্ঠপোষকতায় যে সমস্ত সরাইখানা রাস্তার দু’ধারে বসানো হয়েছিল, তার গুটিকতকই এখন বর্তমান। সৈন্য আগমনের আগাম খবর পেয়ে সরাইখানার মালিকেরাও পালিয়েছে। হেমু মনে মনে স্থির করেন, মোগলদের উচ্ছেদ করে প্রথম কাজই হবে এই সুবিশাল রাস্তার দুধারে সরাইখানার পুনর্স্থাপন। ব্যবসা বাণিজ্যের উন্নতি করতে গেলে সড়ক উন্নয়ন আশু কর্তব্য।





হটাত সৈন্যদলের পুরোভাগে চাঞ্চল্য দেখা গেল। সচকিত হলেন হেমু। হাতির উপর বসে দূরে তার নজর গেল মোগল ঘোড়সওয়ারদের উপর। প্রবল বেগে ঘোড়া ছুটিয়ে আসছে মোগল সেনা। হেমুর সৈন্যরা হাতির বেষ্টনী তৈরি করেছে অগ্রভাগে। হাতির পাল যেন জগদ্দল পাহাড়। পদাতিক সৈন্যেরা হাতির আড়াল থেকে তীর ছুঁড়ে পর্যুদস্ত করছে মোগল বাহিনীকে। কালাপাহাড়ের হাওদায় খোলা তলোয়ার নিয়ে সমরনায়কদের নির্দেশ দিতে থাকলেন হেমু। ডান দিক থেকে ঘোড়া ছুটিয়ে আসছে ছোট একটা সৈন্যদল। সামনের পতাকা আর তাদের পোশাক দেখে বোঝা যাচ্ছে, তারা হেমুরই সৈন্য। বার্তাবাহক হেমুর হস্তি যূথের কাছে এসে জানালো – হেমুর দুই সেনাদল শোচনীয় ভাবে পরাজিত হয়েছে মোগল সেনাদের হাতে। প্রায় হাজার তিনেক সৈন্য মারা পড়েছে মোগলদের হাতে। ছত্রভঙ্গ হয়ে তারা কেন্দ্রীয় বাহিনীর কাছাকাছি আসছে সম্রাটকে রক্ষা করতে। খবর শুনে বিমর্ষ হয়ে পড়লেন না হেমু। এবার পদাতিক বাহিনীকে পিছনে সরে গিয়ে হাতিদের এগিয়ে দিতে বললেন।





হেমুর হস্তি যূথ মোগল সৈন্যদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পিছিয়ে গেল। হেমুর সৈন্যরা বিজয়োল্লাসে চিৎকার করতে করতে হাতির উপর থেকে প্রবল বেগে তীর নিক্ষেপ করতে লাগল। বহু মোগল সেনা হাতির পায়ের চাপে পিষ্ট হল। হেমু যুদ্ধক্ষেত্রের অগ্রভাগে উপস্থিত হলেন। সম্রাটকে যুদ্ধে সক্রিয় ভাবে পেয়ে রাজপুত ও আফগান সৈন্যরা বীর বিক্রমে মোগল সেনাদের পিছনে ধাওয়া করে গেল।




দিনের আলো কমে আসছে। মোগল সেনারা পিছিয়ে গেলেও হেমুর সেনা খুব বেশি অগ্রসর হতে পারেনি। সৈন্যদল নিয়ে ছত্রভঙ্গ হওয়া দুই সেনাপতি রামাইয়া আর সাদি খান এখনো হেমুর সাথে যোগ দিতে পারেনি। তবে দুত বাহিত খবর বলছে তারা দুজনেই অক্ষত। আলোর অভাবে খুব বেশি দূর দেখা যাচ্ছে না বলে অধৈর্য হয়ে হেমু মাহুতকে কারণ জানতে বললেন। মাহুত জানালো, সামনে ঢালু জলাজমি আছে বলে পুরোভাগে হাতিরা এগোতে চাইছে না। এর অর্থ, হয় এখানেই শিবির ফেলতে হবে, নইলে পিছু সরে যেতে হবে।





জলা জমি পর্যবেক্ষণ করতে হেমু এগিয়ে গেলেন সম্মুখ ভাগে। তখনই হেমুর সৈন্যদলের পিছন থেকে ঘোড়ার ক্ষুরের আওয়াজ পাওয়া গেল। শোরগোল উঠল – “পালাও, মোগল সেনারা ঘিরে ফেলেছে।”





বিচলিত হিমু সামনের দিকে এগোতে হুকুম দিলেন আর পদাতিক সৈন্যদের আদেশ দিলেন পিছন থেকে মোগল আক্রমণ প্রতিহত করতে। জলা জমির কাছে গিয়ে হেমু দেখলেন, সামনে থেকেও মোগল সেনারা ঘোড়া ছুটিয়ে আসছে। তিনি হাতির হাওদা থেকে তীব্র তীর বৃষ্টি করতে লাগলেন। কালাপাহাড় শুঁড় তুলে গগনভেদী রব তুলল। সে আজ রক্তের গন্ধ পেয়েছে। শত্রুর তীরের আঘাতে মাহুত জখম হল। কালাপাহাড় জলাভূমির দিকে রাজা হেমুকে নিয়ে এগিয়ে গেল। হেমুর ডান চোখে তীর বিদ্ধ হল। তিনি ভয়ঙ্কর যন্ত্রণায় শিউরে উঠে একহাত দিয়ে তীর বার করে দিলেন সর্বশক্তি দিয়ে। তার চোখ দিয়ে স্রোতের মত রক্ত পানিপথের মাটি শিক্ত করে তুলল। হেমু হাতির হাওদায় শুয়ে পড়ে আকাশের দিকে চাইলেন। চেতনা হারাতে হারাতে বুঝলেন হাতির পিঠ থেকে তিনি মাটিতে গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছেন।





জ্ঞান ফিরতে চোখ ও মাথায় প্রবল যন্ত্রণা টের পেলেন হেমু। বোঝা গেল কোনও ঢাকা স্থানে শুয়ে আছেন তিনি। চারিদিকে মশাল জ্বলছে। অনেক মানুষের মৃদু গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে, কিন্তু কাউকে চেনবার মতো অবস্থায় নেই তিনি। প্রচণ্ড পিপাসায় বুকের ছাতি ফেটে যাচ্ছে, উঠে বসবার শক্তিটুকুও তিনি হারিয়েছেন। সারা শরীর জুড়ে নেমে আসছে শীত। দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছে, এবার মৃত্যু আসন্ন রাজা বুঝতে পারলেন।





“শত্রুর শেষ রাখতে নেই জাঁহাপনা। নিন, এক কোপে ধড় থেকে মুণ্ডুটাকে আলাদা করে দিন। আপনার তরবারি উন্মুক্ত করুন।” বৈরাম খাঁ আকবরকে উদ্দেশ্য করে বললেন।








শেষ মুহূর্তে কে যেন সম্রাট হেমুর কানে কানে বলল, “ইয়া রহে উজাড়, ইয়া বসে গুজ্জর”।