মানিক বৈরাগী
লেখক / সংকলক : মানিক বৈরাগী
মানুষ সিরিজ
মানিক বৈরাগী
পিতা
পিতা তোমাকে নিয়ে
একটি কবিতা রচনার আবদার রক্ষা করতে পারছি না।
যখনই কলম হাতে বসি কোথা হতে আমার চোখে ভাসে
রাসেলের ভয়ার্ত মুখচ্ছবি।
পিতা তোমাকে নিয়ে
ডামাডোলের ভেতরে ঠাঁই নিয়েছে শকুন শাবক
কলকল নদীর স্রোতের মত শনশন নির্মল বায়ুপ্রবাহের মত
একটি রচনার আবদার রক্ষা করতে পারছি না
যখনই কলম হাতে বসি কোথা হতে আমার চোখে ভাসে
সদ্য র্যাংকপ্রাপ্ত উজ্জ্বল উচ্ছল জামালের মুখ
নিমিষেই বুলেটের আঘাতে ঝাঁজরা হয়ে ভয়ার্ত শব্দে
রক্তনদী বয়ে যায় মধুমতীর দিকে
পিতা তোমাকে নিয়ে
যখনই কলম হাতে বসি সুবেহ-সাদিকের পরে কোথা হতে আমার চোখে ভাসে
উত্তাল উদ্দাম পৌরুষদীপ্ত কামালের মুখ
পিতা তোমাকে নিয়ে
কোমলে কঠিন একটি কাব্যনাট্যের আবদার রক্ষা করতে পারছি না
তোমারই শতবর্ষ আয়োজন স্মারকের জন্য
যখনই কলম হাতে বসি কোথা হতে আমার চোখে ভাসে মাতৃজন্মের আর্তনাদ,
সদাশান্ত মুক্তিচেতনায় অবিচল মমতাময়ী রেণু’মার মুখ।
এই শতবর্ষে তোমার নামে তোমার জন্য
কোন মঙ্গলকাব্য রচনার অক্ষমতা ক্ষমা করে দিও পিতা।
##
তুমি জননীর জননী- দিব্যমাতা
জননী ধরিত্রী সর্বংসহা মা আমার
অষ্ট্রিক, দ্রাবিড়, অনার্য, আর্য আরও আরও কতো
বাঙময় বাঙাল, বাঙ্গালী, জাত-উপজাত
আদী-অনাদি জাতিগোষ্ঠীকে
তোমার পবিত্র আচঁলে ধারণ করে,
কত সন্তানের আঁচড়ের আঘাত সয়েছো অনায়াসে
হাজার বছরের যমুনা-বিপাশা-গঙ্গা-পদ্মা-কর্ণফুলী,
মেঘনা-মাতামুহুরি হয়ে মধুমতীর তীরে তোমার আবির্ভাব
জন্মতে থিতু হয়ে তোমারই জন্মাবাস
তারপর খরস্রোতা মধুমতীর মতো
কখনো খুব ধীর কখনো অস্থির, কখনো সুস্থির শীতলক্ষা হয়ে
ঘাট থেকে ঘাটে, অবশেষে বুড়িগঙ্গা পেরিয়ে ধানমণ্ডি।
শৈশবেই হারিয়েছো জন্মদায়িনী মা জন্মদাতা পিতা
লুৎফর-সায়েরা আমার প্রপিতামহ-মাতা কখনো তোমার
ভরসা, ভালোবাসা, মমতার এতটুকু অভাব অনুভব করতে দেয়নি
তুমি জননীর জননী- দিব্যমাতা।
আমার সেই প্রপিতামহ-মাতা জানতেন,একটি ব্রাত্য জনগোষ্ঠীর জন্য
আপনাকে সর্বংসহা জননীর আসনে অধিষ্ঠের প্রয়োজন।
সর্বজয়া সর্বংসহা বেহুলা রেণু মা আমার
তুমি আগলে রেখেছিলে তোমার খোকাকে
তুমি আগলে রেখেছিলে হাসিনা-রেহেনা, কামাল-জামাল-রাসেলকে
তুমি আগলে রেখেছিলে আদরের ভাই-দেবর শেখ নাসেরকে
তুমি আগলে রেখেছিলে বৌমা আরজু মণি-রোজিকে
কিন্তু তোমার বুক বিদ্ধ করে ঘাতকের নির্মম বুলেট যখন
এফোঁড় ওফোঁড় করে প্রাণপাখিটাকে উড়িয়ে দিল
তখন সব যেনো তোমার আঁচলহারা হয়ে আকাশে আকাশে
একজন একজন করে উড়তে থাকলো!
এক এক করে উড়তে থাকলো তোমার প্রিয়তম খোকা,
তোমাদের আদরের কামাল-জামাল-রাসেল
মা, রেণু মা আমার, আমরা পারিনি তাদেরকে আগলে রাখতে
আমরা পারিনি, সেই ভোররাতের প্রথম প্রহরে কোনো প্রতিরোধ গড়ে তুলতে।
##
রবি দা
তুমি এখনো দারুণ সমারোহে আমাদের রমণীকুলের কাছে অসাধারণ প্রৌঢ় যুবক। আকর্ষণীয় প্রেমিক পুরুষ। এই গভীর সত্য আবিষ্কার করি যখন আমার বউ কাজের ভেতর রবি দা’র গান গুনগুনায়।
তখন আমার রবি দা’কে খুব ঈর্ষা হয়। ঈর্ষা হয় বউ যখন গোল কোর্তা পড়া দাঁড়ি গোফওয়ালা বুড়োর ছবিটি যত্ন করে ঝাড়ামুছা করে। দেখি, তার হৃদয়ের
সমস্ত ঐশ্বর্য ঢেলে দিচ্ছে এক দাড়িওয়ালা সন্তের ছবিতে। ছবির কথা ওঠতেই
মনে পড়ে-একবার বলেছিলে ‘তুমি কি কেবল ছবি/শুধু পটে আঁকা’। আমি বলি-
রবি দা তুমি কেবল ছবি নও, ছবির ভেতর এক মহান কবি।
সে যখন গীতবিতানকে অন্যসব বই থেকে আলাদা করে রাখে, অবসরে ছোট গল্প সমগ্র, গল্পগুচ্ছ নিয়ে বসে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা উল্টাতে থাকে গভীর মনোযোগে, তখন খুব হিংসে হয়। তার পাঠের একাগ্রতার ভেতর আমি যেন অনস্থিত্ব এক সত্তা। যুথবদ্ধ আমাদের সংসারে রবি দা’র কবিতা-গান-গল্প আমাকে নিয়ে যায়
আরো দূর একাকীত্বের প্রান্তরে।
আজো বাংলার সুকণ্ঠি শ্যামল মেয়েরা তোমর গানের রাগ-রাগীনিতে
বিভোর হয়ে থাকে। আর আমার বউ মজে আছে ‘শেষের কবিতা’য়।
এখন তাকে আমার লাবণ্য লাবণ্য লাগে। রবি দা, বলো তোমাকে ঈর্ষা না করে উপায় আছে !
##
জীবনানন্দ দাশ
স্যার আমাদের ইংরেজি সাহিত্য পড়াতেন,
ক্লাসে আসতেন উদাস মুখে,
পুরুল্যান্সের চশমা খোলে চোখ মুছতেন।
স্যারকে আমরা কেউই মান্য করতাম না,
স্যার ওসবের ধার ধারেন না।
আমাদের বকাও দিতেন না।
আমরা যারা একদম পেছনে বসে তাস খেলতাম,
স্যার দেখেও দেখতেন না।
স্যারকে মনে হতো পৃথিবীর একমাত্র নিরীহ-নির্জন প্রাণী,
দুনিয়ার তাবত দুঃখ ও হতাশার বোঝা একাই বয়ে বেড়াচ্ছেন।
তাই তিনি আমাদের কোলাহল, তাসখেলা,
সামনের বেঞ্চের কমলার সাদাপাড়ের শাড়িতে
ফাউন্টেন পেন এর কালি লাগিয়ে দেয়া সব দেখতেন।
কিন্তু ভয়ে বা আদরে কিছুই বলতেন না।
একসময় কিছু লেসন বলে নিরবে প্রস্থান করতেন।
স্যার এমন ভাবে হাঁটতেন
পায়ের চাপে ঘাস যেনো ব্যথা না পায়।
ডানে বায়ে তেমন তাকাতেন না,
আকাশের দিকে এমন ভাবে তাকাতেন
যেনো সূর্যকে গলিয়ে তারা গুনবেন।
একদিন আনন্দবাজারে সিঙ্গেল কলামে
স্যারের পাসপোর্ট সাইজের ছবিসহ
ট্রাম দুর্ঘটনায় এক কবির মৃত্যু হয়েছে হাসপাতালে
নিউজ বেরুলো।
নিউজের আদ্যোপান্ত পড়লাম,
আমি খেলা ও বাজারের খবর ছাড়া
অন্য কিছু পড়িনা বা প্রয়োজন বোধ করিনা।
এরপর ছবির দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম,
আমার চোখ বাষ্পীভূত হলো অপরাধে,
শ্রদ্ধায়।
যখন জানলাম তিনিই কবি জীবনানন্দ দাশ।