অল্প অল্প গল্প



নন্দিতা সাহা




গল্প -- শুনলেই বুকের ভেতর কেমন ছলাৎ করে  ওঠে ! কেমন একটা ঢেউ--মনে হয়কেউ যেন বুকের ভেতর কান পেতে বসে আছে । গল্প  মানেই , ঠাকুরদাদা কে ঘিরে নাতি নাতনির  ভিড়, নিশুতি  রাতে গায়ে কাটা। গল্প মানেই  মায়ের  গা ঘেষে  বসে  সুয়োরানী, দুয়োরানী, ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমীর পিঠে চড়ে হু---স্ ।



                কখনত্ত  কখনত্ত  গল্পের  খেই হারিয়ে  যায়। গল্পের  সুতো ছিড়ে যায়। ঠাকুরদা সুতো খুঁজত।

                আমার গল্পে কিন্তু সুতো ছেড়ে না, খেই  হারায় না। আমার গল্প আমার এই  শরীরের চারপাশে বাতাসে মিশে থাকে। আমার গল্প প্রতিটি  পদক্ষেপে লুকিয়ে থাকে।  আমার গল্প খোদাই করা আছে , আমার বাড়ির উঠোনে, তুলসীতলায়,কলতলায় , চিলেকোঠায়, পুতুল খেলায়, বুড়িপিসির সাদা থানে,আমার ছোটবেলায় !!!

        কত গল্প কত গল্প, হাজারো গল্প। কোনটা ছেড়ে  কোনটা  কই। শুরু থেকেই শুরু করা যাক।



মনে পড়ে সেই সেদিনের কথা। আমাদের প্রাসাদোপম বাড়ির ঝুলবারান্দায় সকলে সারিবদ্ধ দাড়িয়ে আছে। বাড়িতে পবিবারবর্রগের ভিড়। জেঠু-জেঠি, কাকা-কাকি,খুড়তুত,জেঠতুত ভাই-বোনেদেরভিড়। দাদু-ঠামি। ঠাকুর-চাকর! গমগম করছে সারা বাড়ি।

আমি ছিলাম সকলের ছোট।বড় বড় সব দাদা আম ছিলাম  সকলের ছোট। বড়বড় দাদা-দিদি দের মাঝে আমাকে চোখেই  পড়ত না। একেবারে কুট্টি ছিলাম। সেই থেকে আমার নাম হয়ে গেল কুট্টি।কুট্টিবোন, কুট্টিদিদি। আজ আমি কুট্টি মাসি, কুট্টি পিসি,এমন কি কুট্টি দিদা, কুট্টি ঠামা।



          আমার এই কুট্টি নাম আমাকে বড় হতে দিল না, বুড়ি হতে দিল না ।আমার কুট্টি নাম আমাকে চির সবুজ করে রাখল।

        - - -          - - -          - - -             - - -



সেদিন কাকভরে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। চোখ মেলে তাকালুম। নতুন সূর্য। আমারওনতুন চলার পথ শুরু। সারা রাত মা পটি পটি করে কতকি শিখিয়েছে।

শুধু কি মা! কদিন ধরে যে যখন পেরেছে, সবাই মিলে  আমায়শিখিযেছে, ঠেসে ঠেসে। এটা করবি, ওটা করবি না। হ্যান করবি, ত্যান করবি না। উঃ, কি জ্বালা! আমি কি কিছুই জানিনা! সারারাত প্রায় ঘুমোই নি। বুকের ভেতর ধড়াস ধড়াস করছিল। তারপর এসে গেল সে---ই চরম সময়। অবিস্মরনীয় দিন।

                     সাত সকালে স্নান সেরে আমি তৈরি।পরনে লাল সার্ট কালো স্কার্ট।

মাথায় লাল রিবন্। ছোটকা আমার একটা ফটো তুলে নিল।সকাল থেকেই সকলে আমায় কেমন প্যাট প্যাট  করে দেখছে। আমি কোথায় যাচ্ছি ! যুদ্ধে! হ্যা, যুদ্ধ ই বটে! পরে বুঝেছিলাম। জীবন যুদ্ধে নাম লেখাতে যাচ্ছি ! !

            আমাদের  বাড়িতে একটা নিয়ম আছে। শুভ কাজে বেরোনোর আগে ঠাকুরঘরে প্রনাম করতে হয়। তারপর একে একে সব গুরুজনদের,যারাই বয়সে বড় তাদের সকলকে পায়ে হাত দিয়ে প্রনাম করতে হয়।

              ঠাকুমার নির্দেশ  মতো ঠাকুরঘরে সব দেবতাদের প্রনাম সারা হল। এবার বড়দের প্রনাম করবার পালা।

   একধার থেকে শুরু হল। ঠামি, জেঠু,জেঠী,কাকু,পিসি,বড়দা,মা,বাবা----। আমার ছোট্ট ছোট্ট হাত সবার পা স্পর্শ করতে করতে যখন কাহিল,তখন আরেক জোড়া পা স্পর্শ করতে গিয়েই বিষম বিপদ। কালো কুচকুচে পদযুগল সাৎ করে পেছনে সরে গেল, মুখে অস্ফুট  আর্তনাদ---আমাকে না, আমাকে না।

          আমি চোখ তুলে চাইলাম। ঘোমটার আড়ালে রাধার মায়ের মুখ কিছুটা দেখা যাচ্ছে । লজজায় সংকোচে কুকড়ে গেছে। জিভটাও বেরিয়ে এসেছে।

   সে কি! ভয় পেলাম । আমি  কি কিছু  ভুল বললাম । আড়চোখে একবার একবার সকলের দিকে দেখে নিলাম। সবাই যেন কেমন হতভম্ব। কারও ভ্রু কুঁচকে গেছে, কেউ একেবারে হাঁ। কারও গালে হাত,কেউ ঠোঁট উল্টে  আছে। আমার মাথায় কছুই ঢুকল না। মোটে তো ছয় বছর বয়স।

  প্রথম স্কুলে যাচ্ছি । বড়দের আশীর্বাদ নিয়ে শুভ কাজ শুরু করতে হয়। আমাকে তাই ই শেখানো হয়েছে। আমি তো তাই ই করতে গিয়েছিলাম। রাধার মা-- সেও তো কত বড়। ঠামির চাইতেও বড়। তার আশীর্বাদ কেন বাদ থাকবে!! অবশ্য রাধার মা তার ঘোমটার  আড়াল থেকে আমাকে আশ্বস্ত করেছিল,---আমি তুমারে এমনিই আশীর্বাদ করি মামুনি, তুমি লেখাপড়া শিখ্যা অনেক  অনেক বড় হইবা, আকাশের চাঁদ হইবা।

       তবু আমার মনে প্রশ্ন কিন্তু রয়েই গেল। আমার সব চাইতে বড় শিক্ষক আমার মা। বিশ্বাস, মা যা বলে ঠিক বলে। মায়ের কোমর জড়িয়ে ধরে চোখে র দিকে চাইলাম। মায়ের মনের  খবর চোখের চাউনিতে পড়ার চেষ্ট করলাম। মা একটু হাসল । মাথায় হাত রেখে কইল, ঠিক আছে, এবারে  স্কুলে যাও।

            মায়ের মনের খবর কেমন ধোঁয়াশার মতো লাগল। স্পষ্ট  হল না। উত্তর পেলাম না।  আমি বড় বিপাকে পরলুম।



 সেদিন স্কুল  থেকে ফিরে ঠামির ঝাঁঝাল কন্ঠস্বর শুনেছিলুম।

  -----হায়,হায় মেয়ে যে ছোটবড়সব এক কইরা ফেলাইল। চাকর-মনিব যে এক কইরা ফেলাইল বৌমা। মেয়েরে কিছু শিখাও। মান-সম্মান যে আর রইল না।

         সেদিন কেন সবাই অমন করল? মা কে অনেক বার শুধিয়েছি। উত্তর পাইনি।

           আজ আমার পরিপক্ক বয়স, পরিপক্ক মগজ সব বুঝতে পারে। সব উত্তর খুঁজে পায় নিজের  মধ্যে, নিজের চারপাশটার মধ্যেই ।শুধুমেনেনিতে পারে না আমার মন।শিশুর স্বর্গীয়  সারল্য থেকে আমি বেরিয়ে এসেছি । আমি বুঝেছি আমি মনিব, সে চাকর। তাই আমার স্হান ওপরে, তার স্হান আমার পায়ের কাছে। আমি মাথা ঝুঁকে তার পায়ে হাত দিতে পারি না।তেমনটা হলে আমি সকলের কাছে মজার পাত্র।

      এ কেমন তরো নিয়ম! এনিয়ম রড় কষ্ট দেয়। এ নিয়ম মানুষে মানুষে বিভেদ তৈরী করে।  মানুষ  কে ছোট  করে। এ নিয়ম পীড়া দেয়। মনে মনে ভাবি এ নিয়ম  বহির্রভূত একটা সমাজ তৈরী করা যায় না!! সেখানে সবাই সমান।

নিশ্চই যায়। শুধু একটুসময় চাই। আর চাই কিছু  দিল দরিয়া মানুষ ।