রাত একটা।

এয়ারপোর্ট থেকে গাড়ি হাকাচ্ছি ধানমন্ডিতে নিজের বাসার দিকে। আমার গাড়িটা ব্রান্ড নিউ টয়োটা এলিয়ন মডেলের। নতুন মাত্র পেয়েছি কোম্পানী থেকে।


এয়ারপোর্টে এসেছিলাম বিদেশি এক বায়ারকে নিতে। যে গার্মেন্টসে চাকরি করি সেখানকার মালামাল পরিদর্শন করবে সে। কিন্তু দুবাই থেকে ফ্লাইট মিস্ করায় আর আসতে পারেনি। এ ধরনের ঘটনা হলে বিদেশিরা আগেই ফোনে জানিয়ে দেয়। কিন্তু যে ব্যাটার আসার কথা সেই ব্যাটা জানায়নি। শেষে অনেক কষ্টে ফোনে যোগাযোগ করে জানা গেল আসবে আগামীকাল রাতে। এজন্যই এয়ারপোর্ট থেকে ফিরে আসা।


এত রাতে বাসায় ফিরে যাওয়া একটা ঝামেলার ব্যাপার। দারোয়ান চিৎকার করে শেষ রাতে বাসায় ফেরার কারণ জানতে চাইবে। আরও জানতে চাইবে কোথায় ছিলাম। শেষে বলবে, ’আপনি ব্যাচেলর মানুষ, এই বাসা ছাইড়া দ্যান, ঝামেলা কইরেন না। তা না হইলে বাড়িওয়ালারে সবকিছু বইলা দিব।’ অবশ্য এক দুইশ টাকা ধরিয়ে দিলে একেবারে চুপ হয়ে যায় সে। আমার ধারণা টাকা কিছু বাড়িয়ে দিলে দারোয়ান ব্যাটা মানুষ পর্যন্ত খুন করতে পারবে এবং কোনোকিছুই ফাঁস করবে না। টাকা পেলে সে একেবারে ঠান্ডা। তাকে ঠান্ডা রাখার জন্য মাঝে মাঝেই আমি তাকে টাকা দেই। কারণ আমার অনেক বিষয় আছে যা আমি কাউকে জানতে দিতে চাই না। কাজগুলো খুব গোপনে করতে হয়। এই গোপন কাজগুলো যে দুই একজন জেনে যায় বা যাদের জানাতে হয় তাদের মধ্যে দারোয়ান একজন। এজন্য দারোয়ানকে সবসময় খুশি রাখতে হয়।


আমার গোপন কাজগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো পুতুলদের নিয়ন্ত্রণ করা। নিয়ন্ত্রণের এই বিষয়টা খুব স্পর্শকাতর। সবাই পারে না, শুধু আমি পারি। পারি বলেই দ্রুত আমি এত বড় কোম্পানীর হিউম্যান রিসোর্চ বিভাগের লিয়াজো কর্মকর্তার দায়িত্বটা পেয়েছি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে উপরের স্যারদের কাছে আমার কদর অন্যদের থেকে বেশি।


পুতুলদের নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে আমি খুবই সতর্ক থাকি। কারণ তাদের নিয়ন্ত্রণ এবং ব্যবহারের ক্ষেত্রে যদি সামান্য ভুল হয় তাহলে অনেক বড় সর্বনাশ হয়ে যাবে, কোম্পানীর অনেক কাজ ছুটে যাবে। তখন আমার দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। অবশ্য সেই সুযোগ নেই। কারণ এক্ষেত্রে আমার পারদর্শীতা অতুলনীয়। আমি জানি কীভাবে পুতুলদের চিপে, নিংড়ে তাদের মধ্যে থেকে নির্যাসটা বের করে আনতে হয়। আর ঐ নির্যাসেই সন্তুষ্ট হয় কোম্পানীর বায়াররা, কোম্পানী পায় অনেক বড় বড় কাজ। অবশ্য আমি পুতুলদেরও কখনও অসন্তুষ্ট রাখি না। কারণ জানি, ওরা ভালোবাসে টাকা, শুধুই টাকা। টাকা খরচে আমার কোনো কার্পণ্য নেই। এক্ষেত্রে আমি উদার, অনেক বেশি উদার, আমার উদারতা পুতুলেরা সত্যি পছন্দ করে! আমিও ওদের পছন্দ করি, পছন্দ করি নীরব রাতে আমার পাশে ওদের সরব উপস্থিতি।


পুতুলদের সাথে যোগাযোগ আগে বেশ কঠিন ছিল। এখন আর আগের মতো কঠিন নেই। কিছু গোপন ওয়েবসাইট আর ফেইস বুক এড্রেস আছে। সেগুলোতে ঠিকানা দেয়া থাকে, দেয়া থাকে ফোন নম্বরও। যোগাযোগ করে ক্রেডিক কার্ডে পেমেন্ট করে ঠিকানা দিলে সরাসরি বাসায় চলে আসে। ইদানিং সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় অগ্রিম পেমেন্টেরও প্রয়োজন হয় না। পরে পেমেন্ট করলে হয়। তবে এই ওয়েবসাইট আর ফেইবুকের এড্রেসগুলো খুব বেশিদিন একটিভ থাকে না। কয়েকদিন পর পর নাম পালটানো হয়। পুরোনো কাস্টমারদের মেসেজ দিয়ে নতুন নাম জানিয়ে দেয়া হয়।


গতকাল নতুন একটা ফেইসবুকের সন্ধান পেয়েছি আমি। ফেইসবুকে পুতুলদের যে ছবিগুলো দেয়া আছে সবই খুব সুন্দর আর আকর্ষণীয়। অবশ্য কারো নাম লেখা থাকে না। শুধু নম্বর দেয়া থাকে। গাড়ি থামিয়ে মোবাইল ফোনে সংশ্লিষ্ট ফেইসবুকে লগইন করে একজনকে পছন্দ করলাম। তারপর ফোন করলাম নিচে উল্লেখ করা নম্বরটিতে। ওপাশ থেকে মিষ্টি কণ্ঠের এক নারী চাইল, পছন্দের নম্বর কত?


আমি একটু সময় নিয়ে বললাম, ছয় নম্বর পুতুল।

এত রাতে ছয় নম্বর পুতুলকে পাওয়া যাবে না। অন্য কোনো পছন্দ আছে?

দুই।

দুইও নেই। ইচ্ছে করলে আট কিংবা এগারো নম্বরকে নিতে পারেন।

আমি বললাম, আট।

এখন অনেক রাত। পুতুলের পক্ষে আপনার ঠিকানায় যাওয়া সম্ভব নয়। আপনাকে তাকে তুলে নিতে হবে।

কোথা থেকে তুলে নেব?

আপনি কোথায় আছেন?

এয়ারপোর্ট গোলচত্বর পার হয়েছি। যাব ধানমন্ডি।

আপনার গাড়ি আছে?

হ্যাঁ আছে। আমি নিজেই ড্রাইভ করছি।

আর কেউ আছে সাথে?

না নেই।


চমৎকার। আমরা শতভাগ গোপনীয়তা রক্ষা করে চলি। আপনার আর আমাদের সম্পর্ক তৃতীয় কেউ জানুক তা আমরা কখনো হতে দেব না। যাইহোক, উলটো ঘুরে উত্তরা চার নম্বর সেক্টরে চলে আসুন। ছয় নম্বর রাস্তায় ঢুকে গোল চত্বরে এসে কল করবেন। তিন মিনিটের মাথায় বোরকা পরা দুই পুতুল আপনার কাছে পৌঁছে যাবে। ক্যাশ পেমেন্ট করতে হবে। একজন পুতুল টাকা নিয়ে চলে আসবে, অন্যজন আপনার সাথে যাবে। রাজি?

হ্যাঁ রাজি।


আমি উত্তরার পথ ধরলাম। উত্তরা আমার পুরোটাই চেনা। চার নম্বর সেক্টরের ছয় নম্বর রাস্তাটা আমি চিনি। রাস্তার গোলচত্বরটা বেশ ভিতরের দিকে। ওখান থেকে যে কোনো দিকে যাওয়া যায়। ঐ দিকে মানুষের চলাচল কম থাকে। এত রাতে রাস্তাঘাট একেবারেই নির্জন থাকবে। অবশ্য এটা সত্য, পুতুলরা নির্জন নিরিবিলি স্থানই বেশি পছন্দ করে। তারা নিজেদের প্রকাশ করতে চায় না। আগে তাদের হোটেলে পাওয়া যেত। এখন সবাই বাসাকেন্দ্রিক হয়ে গেছে। উত্তরার দিকে প্রবণতাটা বেশি। এর কারণটা অবশ্য আমার জানা নেই।


পুতুলেরা এক বাসায় অবশ্য বেশিদিন থাকে না। কয়েক মাস পর পর বাসা পালটে নতুন বাসা নেয়। কারণ তারা আশেপাশের ফ্ল্যাটের মানুষদের কাছে নিজেদের প্রকাশ করতে চায় না। এজন্য তাদের অনেকে বোরকা পরে চলে। নতুন যে পুতুলদের সে সন্ধান পেয়েছে তারাও সম্ভবত বোরকা পরে চলাচল করে। কারণ মোবাইল ফোনে সেরকমই ঈঙ্গিত পেয়েছে সে।

গোলচত্বরে এসে দেখি একপাশে শুধু ফকির টাইপের এক লোক রাস্তার উপর শুয়ে আছে। আশেপাশে আর কেউ নেই। ফকিরটা ঘুমিয়ে আছে বলেই মনে হলো। আমার কিছুটা ভয় ভয় করতে লাগল। অবশ্য এরকম ভয় প্রত্যেকবারই করে। তারপর আবার ঠিক হয়ে যায়।


আমি ফোন করলাম। আগের সেই নারী মিষ্টি কণ্ঠে বলল, আপনি এসেছেন?

হ্যাঁ এসেছি।

আপনার গাড়ির নম্বর কত?

আমি গাড়ির নম্বর বললাম।

গাড়ির রঙ কী?

আমি গাড়ির রঙ বললাম।

আপনি অপেক্ষা করুন। কিছুক্ষণের মধ্যে দুজন আপনার কাছে পৌঁছে যাবে। আপনি আপনার পরিচয়ের যে কোনো প্রমাণ সাথে রাখবেন। আর পেমেন্টটাও রেডি রাখবেন।

ঠিক আছে।

এরপর লাইন কেটে গেল।


এবার শুরু হলো অপেক্ষার পালা। এক মিনিটকে এক ঘণ্টার মতো মনে হচ্ছে। একবার মনে হলো চলে যাই। পরে বাদ দিলাম চিন্তাটা। এত কষ্ট করে যখন এসেছি শেষটা উপভোগ করতে চাই।


ঠিক তিন মিনিটের মাথায় সামনের রাস্তার বাক থেকে বোরকা পরা দুই পুতুল আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। আট নম্বর পুতুল কে বুঝতে পারছি না। ছবিতে আট নম্বর পুতুলকে বেশ লম্বা মনে হয়েছিল। কিন্তু এখন বোঝা যাচ্ছে সে আসলে লম্বা না। কারণ যে দুজন আসছে তারা উচ্চতায় যথেষ্ট খাটো। খাটো পুতুল আমার পছন্দ না। এতে মনটা আমার বেশ খারাপ হয়ে গেল।

আমি ভেবেছিলাম কাছে আসার পর দুই পুতুল মুখের উপর থেকে বোরকা সরিয়ে ফেলবে। কিন্তু তারা তেমন কিছুই করল না। বরং একটা পিস্তল আবার পেটের দিকে তাক করে পুরুষালি কণ্ঠে বলল, চাবিটা দে।


আমি বিস্ময়ে একেবারে হতভম্ব হয়ে গেলাম। বুঝতে পারছি ভয়ানক বিপদে পড়েছি।


চাবি এগিয়ে দিতে অনুধাবন করলাম পিছনে আর একজন এসে দাঁড়িয়েছে। আড়চোখে তাকিয়ে দেখি, লোকটি আর কেউ নয়, রাস্তার উপর শুয়ে থাকা ফকির। এরা যে সবাই এক দলের বুঝতে বাকি থাকল না আমার।


আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই ওরা আমার কাছ থেকে মানিব্যাগ, মোবাইল নিয়ে গেল। তারপর অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সাথে গাড়িতে উঠে গাড়িটি নিয়ে ডান দিকে বের হয়ে গেল। এদিক দিয়ে দ্রুত বড় রাস্তায় উঠা যায়।


বুঝলাম আমি বিশেষ এক প্রতারক চক্রের পাল্লায় পড়েছি। এই চক্র মূলত গাড়ি হাইজ্যাক করে। ফাঁদ পাতার জন্য তারা মেয়েদের ব্যবহার করে। এতে যে কেউ সহজে প্রলুব্ধ হবে। আমি নিজেও প্রলুব্দ হয়েছি এবং বলতে গেলে সর্বস্ব হারিয়েছি। পকেটে অবশ্য কিছু টাকা আছে। এই টাকাগুলো আমি পুতুলকে দিব বলে আলাদা করে রেখেছিলাম। প্রতারক চক্র কেন যেন খুঁজে পায়নি। ওরা মানিব্যাগ, গাড়ি, ঘড়ি আর মোবাইল পেয়েই খুশি।


এ মুহূর্তে খুব ইচ্ছে করছে পুতুলদের ফোন নম্বরটায় ফোন করে ইচ্ছেমতো বকতে। অবশ্য আমি জানি ঐ নম্বরটা এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে, কিছুক্ষণের মধ্যে হয়তো ওয়েবসাইট আর ফেইসবুকও বন্ধ হয়ে যাবে।

ঠিক করলাম বড় রাস্তায় গিয়ে একটা সিএনজি কিংবা ট্যাক্সি নেব। তা না হলে বাসে উঠব। তাই হাঁটতে শুরু করলাম। আমাকে অবাক করে দিয়ে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি শুরু হলো। দ্রুত হেঁটে যখন যাত্রী ছাউনির নিচে এলাম, তখন বলতে গেল একেবারে ভিজে গেছি।


যাত্রী ছাউনির নিচে এসে দেখি সতের আঠার বছরের হালকা পাতলা গড়নের একটি মেয়ে বসে আছে। মেয়েটি নিম্নবিত্ত ঘরের হবে। তবে দেখতে সুন্দর, শাড়ি পড়ে থাকায় আরও সুন্দর লাগছে। এত সুন্দর যে আমার তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে। মেয়েটিও আমার দিকে তাকিয়েছিল। আমার সাথে চোখাচোখি হতে সে চোখ ফিরিয়ে নিল।


আমি বেঞ্চের উপর বসতে বসতে বললাম, কী নাম তোমার?

মেয়েটি আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বলল, পুতুল।

পুতুল নামটা শুনে চমকে উঠলাম আমি। তোতলাতে তোতলাতে বললাম, এ..এত..রাতে তুমি এখানে কী করছ!

পুতুল চোখ বন্ধ করে আবার তাকাল। তারপর টেনে টেনে বলল, হয়তো আপনার মতো কাউকে খুঁজছি।

কথাটা শুনে আমি বিব্রতবোধ করলাম। নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, আজ রাতে বোধহয় বৃষ্টি থামবে না। তুমি বরং এক কাজ করো, বাসায় চলে যাও। আমার মতো কাউকে তুমি খুঁজে পাবে না।

তাহলে আমার চলবে কীভাবে?

আমার কাছে কিছু টাকা আছে, আমি তোমাকে দিয়ে দিচ্ছি।

পুতুল ডানে বামে মাথা নেড়ে বলল, আমি কাজ ছাড়া টাকা নেই না।

কিন্তু আমি তোমাকে টাকাগুলো দিতে চাই।

টাকাগুলো আমার নিজেরও খুব প্রয়োজন। পরিবারের সবাই খুব অভাবে আছে। সকালে সবাই অপেক্ষা করে থাকবে কখন আমি হোটেল থেকে সবার জন্য রুটি আর ডাল নিয়ে যাব।

তাহলে উপায়?

পুতুল খানিকটা চিন্তা করে হাত বাড়িয়ে দিল। তারপর বলল, আমাকে স্পর্শ করুন। আমাকে স্পর্শ করলেই আমি আপনার কাছ থেকে টাকাগুলো নেব।

আমি ডানে বামে মাথা নেড়ে বললাম, না পুতুল, আমি আজ তোমাকে স্পর্শ করব না।

কেন?

আমি আর কোনোদিন কোনো পুতুলকে স্পর্শ করব না। বরং আমি চাইব পুতুলরাই আমাকে স্পর্শ করবে। তুমি আমাকে স্পর্শ করো, আমার হাতটা ধরো।


পুতুল এবার করুন একটা হাসি দিল। তারপর টেনে টেনে বলল, কাউকে স্পর্শ করার ক্ষমতা পুতুলদের নেই। মানুষ যখন পুতুল হয় তখন তার ’স্পর্শ’ করার ক্ষমতা হারিয়ে যায়। আমারও অন্যকে স্পর্শ করার ক্ষমতা হারিয়ে গেছে। সত্যি আমার খুব ইচ্ছে করছে আপনাকে ম্পর্শ করতে। কিন্তু আমি পারছি না, কোনোদিন পারবও না, আমরা পুতুলরা সত্যি বড় অসহায়। আসি, ভালো থাকবেন।


শেষের কথাগুলো বলার সময় পুতুলের চোখ দিয়ে পানি বের হয়ে এলো। শাড়ির আঁচলে চোখ মুছে সে হাঁটতে শুরু করল বৃষ্টির মধ্যে।

এর মধ্যে একটা বাস চলে এলে আমি বাসে উঠে পড়লাম। জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতে দেখি বাস পুতুলকে অতিক্রম করে যাচ্ছে। বৃষ্টিতে ভিজে একেবারে চুপসে গেছে পুতুল। কী সুন্দর লাগছে পুতুলকে! একেবারে পরীর মতো! তবে মুখের কোথায় যেন একটা কষ্টের ছাপ! আমি জানি কেন ওর মনে কষ্ট? আজ রাতে যে সে আমার মতো কাউকে খুঁজে পাবে না!