বেনারসের কিছু কথা



রীতা বিশ্বাস পাণ্ডে 





ফেব্রুয়ারি মাসটা পেরুলেই আমার কেমন ঘুরু ঘুরু মনটা করতে থাকে। বাড়ীর ভেতরে আর মন টেকে না মনে হয় কোথাও ঘুরে আসি। কাজেই ১০ই এপ্রিল বেড়িয়ে পড়লাম বাড়ী থেকে । উদ্দেশ্য বেনারস। জাগাটা বরাবরই আমাকে টানে কারণ ওটা আমার শ্বশুর বাড়ী ও বটে আর গঙ্গার ঘাট তো আছেই।





প্রায় পাঁচ বছর পর বেনারস যাচ্ছি। ষ্টেশনে আগের মতো আর শুধু সিঁড়ি না স্কেলেটর ও তৈরি হয়ে গেছে। আজকাল চারিদিকে এতো সুবিধে যে একা একা ও পুরো দেশ ঘোরা যায়। হটাত রেইল ওয়ে ট্র্যাক গুলোতে চোখ গেল। বিশাল একটা মাউস মানে ধেড়ে ইঁদুর। খুব নোংরা দেখতে গায়ের লোম গুলি ঝড়ে গেছে।ঈশ ভীষণ ঘেন্না করছে দেখতে। ইঁদুরটা একবার এদিক একবার ওদিক দেখে আবার তার গর্তে গিয়ে ঢুকে পড়ল। কোন একটা ট্রেন তিন নম্বর ট্রেকে দাঁড়িয়ে ছিল সেটা এবার ছাড়ল আর সেটা চলে যেতেই সেকি গন্ধ টয়লেটের রে বাবা। এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল তাই সবাই ফ্রেশ হয়ে নিয়েছিল আর তারই ফলস্বরূপ এই অবস্থা। তাড়াতাড়ি আমি আমার জানালাটা বন্ধ করে দিলাম। তখন সারে সাত টা বাজে। ট্রেন ছাড়ার আরও দশ মিনিট বাকী। কাল ওয়াট আপে একটা ম্যাসেজ পেয়েছিলাম সেটা হচ্ছে কিনা যাদের নাকি হার্টের প্রবলেম থাকে তাদের কানের লতিতে নাকি একটা দাগ থাকে। এসময়  ঐ কথাটা কেন মনে হল জানিনা। সেকেন্ড বার্থের পরিবারটা তখন ও ঘুমোই নি কাজেই ওরা দুজন তাদের তিনটা বাচ্চা আর আমরা দুজন বসে ছিলাম নীচের দুটো বার্থে।মুসলিম পরিবার। তৎকালে আমাদের সাথেই টিকিট বুক হয়েছে। কথাই কথাই জানতে পারলাম ওদের সবচে ছোট ছেলের নাম মুহাম্মদ ফারহান। ভীষণ টগেটিভ । যা বলছিলাম ঐ হার্টের কথাটা মনে হতেই একে একে সবার কানের লতিতে আমার চোখ বুলিয়ে নিলাম। না কারো লতিতেই সেই লম্বা দাগটি নেই। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। কেউ উঠছে কেউ নামছে কেমন একটা নিশ্চিন্ত ভাব যাত্রীদের মধ্যে যেন ট্রেনটা তাদের ছেড়ে কখন ও যাবে না।  ছোট বেলায় যেমন ট্রেন ধরার একটা হুট পুটি লেগে থাকতো আজকাল সেটা আর দেখা যায় না। এমন সময় বাচ্চা ফারহান আমার উপর হুমড়ি খেয়ে পড়লো আমি তাকে ধরে উঠিয়ে দিলাম একটু আদর করলাম। ও লজ্জাতে নিজের পুঁচকে দুই দিদিদের মাঝখানে মুখ লুকালো ।  দিদিরা আমার পাশে বসেই খেলা করছিল ‘ মছলি জলকে রানী হে,জিওন উস্কে পানি হে’। খুব মায়া হয় আজকাল ছোট ছোট কন্যা সন্তানদের দেখলে। এরা সুস্ত হয়ে সুন্দর হয়ে বেড়ে উঠবে তো? দুশ্চিন্তা হয়। যা সব আজকাল ঘটে চলেছে। ছি ছি ঐ একরত্তি বাচ্চাগুলিকে দেখলেও ওদের সুড়সুড়ি লাগে কি প্রকারে। ঐ শিশু কন্যাগুলি তো বিবেকানন্দের কুমারী। ওদের তো নিঃস্বার্থ ভালোবাসা দিয়ে বাড়তে দেওয়া উচিৎ। হায় পৃথিবী কোথার থেকে কোথায় এগিয়ে চলেছে। এরই নাম কি প্রগতি নাকি জঘন্য রাজনৈতিক খেলা? চোয়াল শক্ত হয়ে এলো বড় মমতাই হাতটা মেয়েগুলির মাথায় বুলাতে লাগলাম। নিষ্পাপ মেয়েগুলির হোশ নেই তারা তাদের ভাইটিকে ও তাদের খেলার শরিক করেছে। ঠিক সাতটা বাজতে পাঁচ মিনিটে ট্রেনটা ধীরে ধীরে চলতে শুরু করল। আমার বেনারস যাত্রা শুরু হল। নিউ দিল্লি ষ্টেশনে লোকের ভীর দেখিনি। কিন্তু এখন দেখছি  বেশ ভীর। এক নম্বর প্ল্যাটফর্মটা লোকে গিজ গিজ করছে। সাউথে যাবে ট্রেনটা। আমাদের ট্রেনটা দু নম্বর দিয়ে যাচ্ছে। এতক্ষণ গতি স্লো ছিল এবার আমাদের ট্রেনটা গতি ধরল। ট্র্যাকের আশে পাশের ছোট ছোট তৃণ গুলি যেন তাদের হাত নাড়িয়ে আমাকে টা টা করছে আশীর্বাদ করছে বলছে যাও তোমার যাত্রা শুভ হোক। কেমন একটা নস্টালজিক ব্যাপার। আমি আনমনা হয়ে গেলাম হটাত। একটা আনন্দ আনন্দ ভাব। শিবাজি ষ্টেশনে সব অফিস ফেরত যাত্রীরা দাঁড়িয়ে আছে তাদের ট্রেনের অপেক্ষাতে। কোলকাতাতে এরকম অফিস ফেরত যাত্রীদের দেখতাম তাদের ডেইলি লোকাল ধরার তাগিদা। দিল্লীতে আমি এই দৃশ্য প্রথম দেখলাম। হয়তো ট্রেনের সময়ের তারতম্যের জন্যে আমি এটা দেখতে পায়নি। এই জীবনটা আমি কখনো উপভোগ করিনি।আমি অফিস ফেরত অফিসের ক্যাবেই বাড়ী ফিরতাম। তবে কোথাও একটা মিল আছে  ওদের ট্রেনে আসা যাওয়া আর আমার ক্যাবে আসা যাওয়া এই ফারাক।ট্রেন ছুটে চলেছে ললিত হোটেল ছাড়িয়ে তিলক ব্রিজ ক্রস করছে আমাদের ট্রেন। ধীরে ধীরে  দৃশ্য পালটে যাচ্ছে ।গাছ পালা তাদের রং পাল্টে ক্রমশ কালো কালো হয়ে অন্ধকারে নিমজ্জিত হচ্ছে। রাতের কালো চাদর লেপটে শহরটা ঘুমিয়ে পড়ার   জন্যে তৈরি হচ্ছে।  আর আমি শহরটাকে পেছনে ফেলে এগিয়ে চলেছি নিজের গন্তব্যে। আমার অতি প্রিয় গন্তব্য স্থান বেনারস। এবার অন্ধকারে প্রায় কিছুই দেখতে পাড়ছি না। কালো আকাশের পথে লাল আর সাদা  আলোর গয়না পড়ে প্লেন ও তার গন্তব্যে ছুটে চলেছে। হটাত অন্ধকার ভেদ করে আমরা একটা আলোয়  ঝলমল করা স্থান দিয়ে এগিয়ে চললাম। অসংখ্য গাড়ীর হেডলাইটে রাস্তা গুলি ঝলমল করছিল। মনোরম দৃশ্য। দিল্লীর রাতের এই দৃশ্যটি খুবই মনোগ্রাহী। আর হটাতই সামনে বিশাল যমুনা দেখা দিলেন। তার উপর আলোর মালা পড়ে উৎসবে মেতেছে যেন এই শহর। শহর দিল্লী। আমার দিল্লী। ট্রেন এগিয়ে চলল যমুনা ছাড়িয়ে। গাছপালার সারির ভেতর দিয়ে তখন ও আলো-ঝলমলে শহর দিল্লীকে দেখা যাচ্ছিল। খুব ভাল  লাগছে। দূরে অক্ষরধাম মন্দির দেখা যাচ্ছে ওটা পেরুতেই শুরু হল আনন্দবিহার রেইলওয়ে ষ্টেশন সেটা  ছাড়িয়ে আমরা এগিয়ে চললাম গাজিয়াবাদের দিকে।  পথে দু তিনটা জলাভূমি পড়ল । এদের নাম আমি জানি না। কোন এককালে এইসব দিয়ে হয়তো সাদা পরিষ্কার জল বয়ে যেতো এখন ফ্যাক্টরির সমস্ত ওয়েস্টেজ আর শহরের সিওেজ  বয়ে নিয়ে যাওয়াতে এর শুধু কালো জল আর  দুর্গন্ধ । পথে সম্পর্কক্রান্তি  ট্রেনটা দেখলাম। লোকে গিজ গিজ করছে। এবার আমরা সাহিবাবাদ ছাড়িয়ে গন্তব্যে এগিয়ে চললাম।আমরা যেই ট্রেনে যাচ্ছি সেটা হচ্ছে শিব গঙ্গা এক্সপ্রেস এস ওয়ান এসি। সুন্দর গতি। বেশ ঝুক ঝুক করে এগিয়ে চলেছি আমরা। সারে আটটার সময় ডিনার এলো বিরয়ানী। যাচ্ছেতাই! কিন্তু কি আর করা। বিরয়ানীর সাথে যা কিছু এসেছিল সব কিছু খিদের জ্বালাই  গপা গপ খেয়ে নিলাম। তারপর বাচ্চাগুলি আর ওদের মাকে  ওদের উপরের সিটে পাচার করে নীচের বার্থে আমি শুয়ে পড়লাম। এসি চলছে। আরামদায়ক গদি তার উপর ভাল ব্লেঙ্কেট কাজেই ঘুম আসতে বেশী দেরী হল না। ঘুম ভাঙল ঠিক যখন এলাহাবাদ এলো। বিনোদ কখন ঘুমিয়েছিল জানি না।  দেখি ও উঠে ফ্রেশ হয়ে কাপড় জামা পাল্টে বসে আছে। আমার উপরের বার্থে মা তার বাচ্চাদের নিয়ে হিমসিম খাচ্ছে। উঠে ফ্রেশ হতে চলে গেলাম। এসে দেখি উপরের বার্থ নামিয়ে নিয়ে  ব্লেঙ্কেট একপাশে রেখে মা আর তার বাচ্চারা বসে আছে। আমি গিয়ে জানালার পাশে বসলাম। যেহেতু নীচের বার্থটা আমার তাই যেন জানালার পাশে বসার অধিকার ও আমারই। যায় হোক যা বলছিলাম, প্রায় এক ঘণ্টা ধরে নাকি ট্রেন এই এলাহাবাদ ষ্টেশনে দাঁড়িয়ে আছে। এখান থেকে বেনারস দেড় ঘণ্টার রাস্তা। কিছুক্ষণ পর ট্রেন ছাড়ল। একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়ল। আর বেশী দূর নয় আমার গন্তব্যস্থান!ছটা বাজে এখন। আঁটটা নটার মধ্যে পৌঁছে যাব নির্ঘাত।





এলাহাবাদ থেকে বের হবার সময় দূর থেকে প্রয়াগ সঙ্গম স্থল দেখা যাচ্ছিল এদিক থেকে গঙ্গাজি আর ওদিক থেকে যমুনাজি এসে মিশেছে একটা স্থানে। সেদিকটায় একটা গাড়ী চলাচলের ব্রিজ দেখা যাচ্ছে। আর এদিকে বিশাল ট্রেন চলাচলের ব্রিজের ওপর দিয়ে আমাদের ট্রেন সাই সাই করে ছুটে চলেছে। গরমে গঙ্গার জল অনেকটা শুকিয়ে গিয়েছে তাই তার তটে চাষিরা খরবুজার ক্ষেত করেছে। ট্রেন থেকেই দেখতে পাচ্ছি ক্ষেত গুলিতে হলুদ হলুদ খরবুজার ফুল ফুটে আছে। খুব মনোরম দৃশ্য।সামনে সবুজ মাঠ। ছোট ছোট কতকগুলি বসতি দেখা গেল তার মধ্যে। আঙ্গিনাতে  আম জাম কাঁঠালের গাছ আবার তার নীচেই গরু ছাগল বেঁধে রাখা হয়েছে। কোথাও কোথাও আবার সজনের গাছ ও দেখতে পেলাম। গাছের আগাগুলি কেটে দেওয়া হয়েছে। তার থেকে নতুন পাতা গজিয়েছে। বৃষ্টি শুরু হলেই এই গাছ আবার এদের খাবার থালিতে সজনে উপহার দেবে। বর্ধিষ্ণু গ্রাম দেখেই বোঝা যাচ্ছে। একপাশে একটা মসজিদ দেখতে পেলাম আবার ট্রেন কিছুদূর যেতেই শ্রী কৈলাসধাম নামের একটা মন্দির ও দেখা গেল। এখানে ধর্মের জঘন্য রাজনীতি প্রবেশ করেনি এখন ও হয়তো তাই সবাই মিলে মিশে আছে। একটা সুখের শ্বাস মন থেকে বেড়িয়ে এলো।বেঁচে থাক বাবা তোরা তোদের কন্যা সন্তানদের নিয়ে ।অনেক আমের বাগিচা ও দেখা গেল কিন্তু দুদিন ধরে প্রচণ্ড ঝড় বৃষ্টির কারণে আমের মুকুলগুলি ঝরে গেছে। চাষিরা যে গম কেটে রেখেছিল মাঠে মাঠে সেগুলিও বৃষ্টিতে ভিজে কালো হতে শুরু করেছে। সত্যি চাষিদের জন্যে খুব কষ্ট হয়। প্রতি বছরই তাঁদের এই প্রাকৃতিক আপদ সামলাতে হয়। কোন জানান না দিয়েই গত কদিন ধরে তুমুল বৃষ্টি হয়েছে সেটা দিল্লিতে ও দেখে এসেছি। তবু ও এখানে সবুজের কোন কৃপণতা নেই । চারিদিকে সবুজ আর সবুজ। এর মধ্যে একটা জিনিষ বড় খারাপ লাগছে ক্ষেতের জাগাতে জাগাতে লোকেরা তাদের প্রাতঃকৃত্য সারছে। মোদীর স্বচ্ছ ভারতের খুললেমে স্বচ্ছ বহিষ্কার যেন ততোটা সফল হয়নি এই সব জাগাগুলিতে। 





এগারো তারিখে সকাল পৌনে নটাতে নিজেকে আবিষ্কার করলাম মোদী-জির মেক ইন ইন্ডিয়ার সিংহটার সামনে। একটা ছবি তুললাম। পরিষ্কার ষ্টেশন। কোন নোংরা নজরে পড়লো না। ষ্টেশন থেকে বেরিয়ে যে হোটেলে আমাদের বুকিং ছিল তার উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম একটা অটো ধরে। খুব পুরানো শহর কিন্তু খুব পরিষ্কার। হোটেলে পৌঁছেই প্রথমে চা খেলাম। তারপর চেঞ্জ করে তৈরি হয়ে নিলাম। খিদেই পেট চু চু করছিল। বাঙ্গালী খাওয়া আমাদের চাই জানতে পেরে হোটেল ম্যানেজার একটি বাঙ্গালী রেস্টুরেন্টের সন্ধান দিলেন গির্জা ঘর চৌ-রাহাতে।নাম জলযোগ। রেস্টুরেন্টটার সামনে গিয়ে দেখলাম  তার মালিক একটা বোর্ডে   লিখে রেখেছেন ‘ ঘরের বাইরে ঘর’ ।একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম।খাওয়া দাওয়ার জন্যে বেশী চিন্তা করতে হবে না। মাছের ঝোল, আলু পোস্ত, সুক্ত,দাল, পাঁপড় দিয়ে মধ্যাহ্ন ভোজন সারলাম। সত্যি ঘরের খাওয়াই  বৈকি।  তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে রেস্টুরেন্ট থেকে বেড়িয়ে এলাম।দুদিন বৃষ্টি হয়েছে তাই তেমন গরম নেই। কিছুদূর এগিয়ে একটা ছোট্ট দোকানে দেখলাম একটা লোক লসসি, শরবত বা ঠাণ্ডাই বিক্রি করছে। সামনে বিরাট বিরাট দুটো পরাতে ধহি আর মলাই ভরে রাখা। এখানে বেনারসে প্রায় সব যায়গাতেই শুদ্ধ দুধের এই সব খাওয়া গুলি বিক্রি হয়। লোভ সামলাতে পারলাম না। বড় গ্লাসে এক গ্লাস লসসি মালাই মারকে (এখানে এটাই বলে) খাওয়া গেল। আহা কি স্বাদ। দিল্লীর লসসিতে এই স্বাদটা আমি  পায় না। ট্রেনের জার্নির থকাওট ছিল তাই আমরা আমাদের হোটেলে ফিরে এলাম একটা ভাত ঘুম দেবার জন্যে।হাতে বেশী সময় নেই তাই নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই সব ঘুরে ফেলতে হবে।তাই একঘণ্টা পর আবার আমরা ঘাটের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়লাম। এতো বড় ঘাট একবারে ঘুরে শেষ করা যাবে না। কমসে কম আমি তো পারবো না। তাই রাজেন্দ্র প্রসাদ ঘাট আর দশাশ্বমেধ ঘাট ঘুরতে লাগলাম। ততোক্ষণে সন্ধ্যা আরতির সময় হয়ে এসেছিল । এই আরতি বিশ্ব বিখ্যাত। মোদী যখন এখানে এসেছিলেন তখন এই দুটো ঘাটের কায়া বদলে যায়। এখন প্রতিটা ঘাটই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। গঙ্গার জল ও পরিষ্কার। বেনারসে এসে আমি আর একটা জিনিষ লক্ষ্য করলাম সেটা হচ্ছে এর পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা। রাস্তা গুলি কোথাও ছোট কোথাও বড় আর খুব পরিষ্কার। মোদীর স্বচ্ছ ভারত মুহিম এখানে কামিয়াবি হাসিল করেছে তাতে সন্দেহ নাই। যথাসময়ে আরতি শুরু হল।  সামনে লোকের বসার জন্যে চেয়ার পাতা হয়েছে। আরতি শেষে আবার চেয়ারগুলি উঠিয়ে নেওয়া হবে। এখন চেয়ারগুলির একটাও খালি নেই। চারিদিকে লোকে লোকারণ্য। রাজেন্দ্রাপ্রসাদ ঘাট আর দশাশ্বমেধ ঘাটে আলাদা আলাদা ভাবে আরতি করা হয়। দশাশ্বমেধ ঘাটে পাণ্ডারা লাল রঙের ধুতি কুর্তা আর কোমর বন্ধনী পড়েছিল আর রাজেন্দ্রাপ্রসাদ ঘাটের পাণ্ডারা হলুদ রঙের ধুতি কুর্তা আর কোমর বন্ধনী পড়েছিল। আমি  যেই গোল মঞ্চটাতে দাঁড়িয়েছিলাম সেখান থেকে দুটো ঘাটই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল।  টি ভি তে মোদীকে দেখেছিলাম এই সেম মঞ্চ থেকে আরতি দেখতে। যথা সময়ে শঙ্খ ধ্বনি করে পাণ্ডারা আরতি শুরু করল। সেকি সুন্দর শঙ্খ ধ্বনি। যে না শুনেছে এই শঙ্খ ধ্বনি সে এটার সৌন্দর্য বুঝতে পারবে না অথবা বলা যেতে পারে আমি তাদের বোঝাতে পারবো না এর সৌন্দর্য। হৃদয়ে একটা অদ্ভুত শান্তি অনুভব করছিলাম।বিশাল প্রদীপ,ফুল, কাপড়, চামর আর ময়ূর পঙ্খ দিয়ে গঙ্গা দেবীর আরতি করা হল। আরতি শেষে খুবই তৃপ্ত মন নিয়ে আমরা চললাম জলপান রেস্টুরেন্টের উদ্দেশ্যে যেখানে মাছ ভাত আমাদের অপেক্ষা করছে।





পরদিন তাড়াতাড়ি চান করে চললাম  বিশ্বনাথ মন্দির। বেনারসে যখন এসেছি তখন একটা পূজা না দিলেই নই। আজ নীল পূজা তাই সাংঘাতিক ভিড় মন্দিরে। লম্বা লাইন দিলাম ঠাকুর দর্শন করার জন্যে। মন্দিরের রাস্তাটা একটা সরু গলির মতন। দুদিকে একটার গায়ে আরেকটা দোকান । ফুল, বেলপাতা,  ঠাকুরের বাসন গয়না আদি নিয়ে দোকানদারেরা তাদের পসরা সাজিয়ে বসেছে। মুলতঃ এগুলি এক একটা বড় বাড়ী যার নীচের তালাটা দোকানের আকার ধারণ করেছে তীর্থ যাত্রীদের তাকিদা দেখে। দোকান গুলিতে আবার জুতো রাখার ও ব্যবস্থা আছে। আমরা ও একটা দোকানে নিজেদের জুতো খুলে রেখে হাত ধুয়ে নিলাম একটা ঝুড়ি কিনলাম যাতে ফল মূল মিষ্টির সাথে সাথে শিবের প্রিয় ধূতরা বিচি আর মানারফুলের মালা আর গেঁদা ফুলের মালা ছিল। মানার বা মান্দার ফুলটি নাকি খুব বিষাক্ত হয় শুনলাম। এটি ভৈরবের ও খুব পছন্দের ফুল। বিষাক্ত ফুল ঠাকুরের কেন পছন্দ তা মাথায় ঢুকল না। কিন্তু ধর্ম ভীরু তাই ভক্তিভরে হাতে তুলে নিলাম ঝুড়িটা। পাঁচ দশমিনিট তপ্ত রোঁদে লাইন দিয়ে চলার পর অবশেষে মন্দিরের দরজা এলো। এখানে পুলিশ সিকুরিটি প্রবল। কেন টা ভেতরে গিয়ে বুঝতে পারলাম। মেইন দরজাটা রুপো দিয়ে তৈরি। শিব লিঙ্গে জল দুধ ভাং ফুল মিষ্টি চড়ালাম।দুই তিন সেকেন্ডের মধ্যে তা চড়াতে হল। পেছনে ভিড় উপচে পড়ছে। পুলিশরাই সেই ভিড় সামলাচ্ছে। তাই নীচে কুয়োতে  শিবলিঙ্গ দর্শন করে ( কোনমতে বির বির করে যতটা পারি মন্ত্র উচ্চারণ করে নিলাম) ভেতরে ঢুকলাম। মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেব এই মন্দিরটি আক্রমণ করেন তাই তার হাত থেকে শিবলিঙ্গকে বাঁচাতে নাকি কুয়োর মধ্যে লুকিয়ে রাখা হয় যা এখন ও সেই অবস্থায় আছে।যা বলছিলাম, তড়িঘড়িতে সামনের রুপোর দরজা দিয়ে ঢুকতেই দেখলাম যে  সামনে বিশাল রুপোর সিংহাসনে সোনা দিয়ে মোরা শিব ঠাকুর।কাশীর বিশ্বনাথ মন্দির নাকি হিন্দুদের অন্যতম পীঠস্থান। আমরা দর্শন করে মন্দির চত্বরে চলে এলাম। মন্দিরের চুড়ার নীচে অবধি সোনা দিয়ে মোড়ানো। বুঝতে পারলাম মোবাইল কেন ভেতরে এলাউ করে না। সব সিকুইরিটির ব্যাপার। খুব পুরানো মন্দির। কাশী বিশ্বনাথ মন্দির বেনারসে গঙ্গার পশ্চিম তীরে অবস্থিত একটি বিখ্যাত মন্দির। এটি জ্যোতির্লিঙ্গ  মন্দির নামে ও পরিচিত। ১৪৯০ সালে নতুন করে এই মন্দির আবার পুনারাঘটিত হয়।এই পুজো টুজোর চক্করে খুব খিদে পেয়ে গেছিল তাই যেই রেস্টুরেন্টটাতে আমরা ব্রেকফাস্ট করতাম সেখানে গিয়ে পুরি তরকারি আর রাবড়ি খেলাম পেট ভরে। আবার অনেকদূর যেতে হবে। আমাদের নেক্সট গন্তব্য হচ্ছে বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়। এই বিশ্ববিদ্যালয় সম্বন্ধে যত বলা যাবে ততো কম। আমাদের মহান ঐতিহ্য এটি ১৯১৬ সালে মদন মোহন মাল্ভিয়া কার্তিক স্থাপিত হয়। কথিত আছে মাল্ভিয়া মহাশয়ের একটি কলেজ তৈরির ইচ্ছা যাগে কিন্তু তার কাছে পর্যাপ্ত জমি না থাকার দরুন তিনি কাশী নরেশের কাছে গিয়ে তার মনোবাঞ্ছা প্রকাশ করেন।কাশী নরেশ বলেন যদি মাল্ভিয়া মহাশয় সারাদিনে পায়ে হেটে যতদূর জমি অধিকৃত করতে পারবেন ততোটা জমি তাঁকে কলেজ স্থাপনের জন্যে দিয়ে দেওয়া হবে। মাল্ভিয়া মহাশয় সারাদিনে ১৩০০ একর জমি পায়ে হেটে অধিকৃত করেন আর ফলত কাশী নরেশ ঐ ভূসম্পত্তি তাঁকে দান করেন। আজকের দিনে ৭৫ টি ছাত্রাবাসে প্রায় ১২০০০ ছাত্র এতে বসবাস করে পড়াশুনা করে।মোট ২৭৩৫৯ ছাত্র এতে পড়াশুনা করে। এশিয়ার বৃহত্তম ছাত্রাবাস এটি।৪৮ টি দেশ থেকে ছাত্ররা এখানে পড়াশুনা করতে আসে।  যা বলছিলাম চা টা খেয়ে একটা অটো ধরলাম ......।।থেকে। সেটা বিশ্ববিদ্যালয়ের গেট অবধি গেল। বিশাল গেটটি তার ঐতিহ্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।তাতে লিখা কাশী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়। গেটের ঠিক ওপাশে গেটের দিকে মুখ করে মদন মোহন মাল্ভিয়ার বিশাল স্ট্যাচু। গেটের বাইরে অসম্ভব ভীর আর যানবাহনের চলাচল। সেখান থেকে একটা রিক্সা ধরে আমরা ক্যাম্পাসের ভেতর প্রবেশ করলাম। প্রাণ জুড়িয়ে যাবার মতো দুধারে সবুজ  গাছ পালা লতা বাহার। আম গাছ আর পিপলের গাছ গুলি নাকি খুব পুরানো। রাস্তার ডান পাশে বোটানিক্যাল গার্ডেন দেখতে পেলাম। সময়াভাবে ভেতরে না ঢুকে আমরা এগিয়ে গেলাম। একটা পুরাতন বিশালাকায় বট গাছের নীচে রিক্সা থামল। গাছ টা এতো সুন্দর যে আমি তার নীচে দাঁড়িয়ে কয়েকটা ফটো না তুলে পারলাম না। কয়েকজন পুলিশ এই তপ্ত রোঁদে গাছ তলায় বসে একটু জিরিয়ে নিচ্ছিল । বলতে ভুলেছি আসার সময়  একটা বহু পুরাতন আম গাছে একটা কাঠ ঠোকরা পাখীকে দেখেছিলাম তার ঘরের থেকে মুখ বার করে ডেব ডেব করে চেয়ে থাকতে। পুরাতন বলে বেশীরভাগ আম গাছকেই উপর থেকে ছেঁটে দেওয়া হয়েছে।তাতে নতুন ডাল পালা বিশেষ চোখে পড়ল না। কয়েকটা গাছে আবার আমের মুকুল দেখা যাচ্ছে। ছাত্রাবাসের ছাত্ররা নিশ্চয় আমের দিনে খুব মজা পায় আম কুড়োতে গিয়ে। কে জানে? হাটতে হাটতে আমরা শ্রী বিশ্বনাথ মন্দিরে গেলাম।এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরের মধ্যেই। এটি  আরেকটি বিশাল শিব মন্দির যা নতুন গঠিত হয়েছে। এটির চূড়া বা মীনার বিশ্বে সব চাইতে উঁচু চূড়া। বিড়লা পরিবার ১৯৩১ সালে এটি বানাতে শুরু করেন আর এই মন্দিরটি বনে তৈরি হয় ১৯৬৬ সালে । বিড়লা মন্দির ও এর পাশেই অবস্থিত। মন্দিরের প্রবেশ দ্বারের দুধারে দোকানদার তাদের পসরা সাজিয়ে বসেছে। সব হাতের তৈরি গয়না। আমি ও টুক করে গলার জন্যে একটি আদিবাসী মালা কিনে ফেললাম। দিল্লীতে এইসব কিছু পাওয়া যায় কিন্তু ঘুরতে এসে শপিং করবো না এটা কি করে হয়। এতো পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন মন্দির কালে কস্মিন কালে দেখা যায়। আমি সকাল থেকে কপালে বিশাল তিলক কেটে ছিলাম এবার গরমে থাকতে না পেরে পিয়াও থেকে জল নিয়ে মুখটা ধুয়ে নিলাম। দিল্লীর মেয়ে আমি কিন্তু বেনারসের এই কটকটে রোদ্দুর যেন সহ্য হচ্ছিল না। যদিও খুব মজা করছিলাম। ফটো উঠতে গিয়ে মন্দিরের কোনা কাটা ও বাদ যাচ্ছিল না। ছোট ছোট টবে মিনিএচার পাতাবাহারগুলো বেশ লাগছিল দেখতে।সেগুলোর সাথেও একটা ফটো উঠলাম। মন্দিরের ভেতরের মার্বেল পাথরের চত্বর গুলি ঠাণ্ডা একেবারে। কিছুক্ষণ বসে জিরিয়ে নিলাম তাতে। ফিরে আসতে ইচ্ছে করছিলো না।  কিন্তু ফিরতে হল। ফেরবার সময় ফুড স্টল থেকে বড় গ্লাসে করে এক গ্লাস লসসি মালাই মারকে খেলাম। আহা খাটি দুধের এই লসসি,মালাই আর রাবড়ির স্বাদ আমি জীবনে ভুলবো না। সামনে গীতা পুস্তকালয়  বইয়ের দোকান থেকে একটা ভগবত গীতা কিনলাম কাউকে উপহার দেব বলে। আমার কাছে আমারটা আছে যেটা আমি সুযোগ পেলেই পড়ি।রাস্তাতে একটা হোটেলে মধ্যাহ্ন ভোজ সারলাম। এবার প্রসন্ন চিত্তে হোটেলে  ফিরে এলাম। স্নান টান করে একটু রেস্ট নিয়ে তারপর তৈরি হয়ে  আবার বেরিয়ে পড়লাম ঘাটের উদ্দেশ্যে। আজ অসসি ঘাটে অঙ্কিত ফাউন্ডেশনের ‘স্পর্শ গঙ্গা অভিযান’ এর ফাংশন চলছে। লোক্যাল মিনিস্টার এসেছেন।  তাঁদের ফাউন্ডেশনের তরফ থেকে স্বারক পত্র দেওয়া হল। পারফর্মাররা পারফর্ম করল। কতগুলি ছেলে সারা গায়ে ভস্ম মেখে ভৈরব ড্যান্স করল। খুব ভাল লাগল দেখতে। টিভিতে আমরা এরকম পারফরমেন্স দেখে থাকি। খুব ট্যালেন্টেড বাচ্চাগুলি। ওদের সাথে পরে একটা ছবি উঠালাম।দিল্লী থেকে এসেছি জেনে ওরা ও খুব খুশী হল। সবাই পোজ দিয়ে দিয়ে আমার সাথে ফটো উঠালো। তারপর গঙ্গার বালুচরে হেটে বেড়াতে লাগলাম। কি সুন্দর সব পুড়ানো মহল এখনও তার ঐতিহ্য নিয়ে সটান দাঁড়িয়ে আছে। একটার গায়ে আর একটা। তিলমাত্র ফাঁক নেই কোথাও। শুধু মাঝখান দিয়ে লম্বা লম্বা সিঁড়ি উঠে গেছে ভেতরের বসতির দিকে। গঙ্গার দিকে সব হোটেল অথবা মন্দির অথবা পাণ্ডাদের ঠিকানা আর সিঁড়িগুলো বেয়ে ভেতরের দিকে এগুলেই সরু সরু গলি যার দুপাশেই হয় মানুষের বসতি না হয় হোটেল না হয় কোন গুরুর আশ্রম। সরু গলি গুলো দিয়ে একজনের বেশী চলাচল করতে পারবে না তথাপি কি পরিষ্কার কি শৃঙ্খলা। মাঝে সাজে গরুরা ও বসে থাকে। প্রথম প্রথম আমি ভয় পেয়েছিলাম এদের মস্ত শিং দেখে কিন্তু লোকেরা আশ্বস্ত করল যে এরা নেহাতই গোবেচারা পশু। পথ যাত্রীদের কিছু করে না। সুড়ুত করে এদের পাশ কাটিয়ে বেড়িয়ে যেতে হয়। এখানে আর একটা জিনিষ লক্ষ্য করলাম যে ইলেক্ট্রিকেল লাইনগুলো মাটীর নীচ দিয়ে গেছে। তা নইলে এই সরু গলিতে যে বাতাস ঢোকার সুযোগ পেতো না যেমন তেমন বিপদ ও ছিল অনেক। যা বলছিলাম, আসসি ঘাটে ছেলেগুলোর সাথে ফটো তুলে দক্ষিণ দিক ধরে হাটতে লাগলাম আমরা। প্রথমেই পথে পড়ল গঙ্গা মহল ঘাট তারপর একে একে তুলসী ঘাট, শ্রী ভদৈনিজী দিগম্বর জৈন তীর্থ





ক্ষেত্র , জৈন ঘাট, শ্রী স্বাদ্ধাত মহাবিদ্যালয়, নিষাদ রাজ ঘাট, বিশাল একটি সুয়েজ ক্যানেল, প্রভু ঘাট ধরে আমরা এগিয়ে চললাম। এবার বালুচর থেকে আমরা উপরে উঠে এলাম। সেখান থেকে গঙ্গার ওপার দেখতে লাগলাম। সত্যি কি অপূর্ব গঙ্গার এই তীর। তাই বোধহয় যুগ যুগান্তর ধরে রাজা মহারাজারা এর উপর মহল বানিয়ে থাকতে ভালবাসতেন আর ঢলানের দিকটাতে সিঁড়ি বানিয়ে নিয়ে নিজের নিজের ঘাট তৈরি করতেন। এখানে মোট ৮৮ ঘাট। উপরের সিঁড়ি ধরে রাজেন্দ্রা প্রসাদ ঘাট হয়ে আমরা ফিরে আসলাম মেদাগিন। রওয়ানা দিলাম নিকটের জলপান হোটেলের উদ্দেশ্যে রাতের খাবার খেতে হবে যে। জলপানে ঢুকে ঠেসে পাবদা মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খাওয়া গেল। মাত্র ১৫০ টাকা এই থালি। ভাবা যায়! রুই মাছের থালি মাত্র ১০০ টাকা। ডিমের থালি ৯০ টাকা আর ভেজ থালি ৭৫ টাকা। এ যেন স্বর্গ একেবারে। খেয়ে দেয়ে বেড়িয়ে এলাম। সামনে লসসির দোকানটা দেখে আবার লালসা। ঢুকে পড়লাম আর এবার ঠাণ্ডাই খেলাম। ঠাণ্ডাই এরা কি ভাবে বানাই ঠিক জানি না তবে তাতে ডিম্যান্ড অনুসারে দু চামচ ভাং মিশিয়ে দিল দোকানদার। এখানে ভাং মোটেও বেনো নয়।   তারপর এক ঘুমে সকাল ছয়টা।





চোখ খুলতেই একটা খুশী খুশী ভাব অনুভূত হল। ঠাকুর নাম করে উঠলাম। চা খেলাম।হোটেলে মসালাদার এক কাপ চা ১৫ টাকা। সেই চা আবার বাইরে ফুটপাতে ৫ টাকা অথবা ৭ টাকা। তবে ফুটপাতে চা মাটীর কুলপিতে দেয়। তাতে স্বাদ যেন বেড়ে যায়। আজকে আমাদের গন্তব্য স্থান হচ্ছে সারনাথ। সারনাথ সম্বন্ধে বহু কথা পড়েছি। তাই সেখানে যাবার জন্যে যেন তর সইছিল না। তার আগে গঙ্গাতে ডুবকি লাগাতে হবে।আজ চৈত্র সংক্রান্তি।  নাইট সুইট পড়েই রওয়ানা দিলাম। গোধূলিয়া মোড়ে আমাদের হোটেল ‘সূর্য রেসিডেন্সি’ থেকে এক কিলোমিটার দূরেই দশাশ্বমেধ ঘাট। তাই অসুবিধা নেই। অথৈ জল দেখলে বরাবরই আমার ভয় লাগে।তবে খুব ভাল ও লাগে।  একটা নোকার রশি ধরে জলে নামলাম।  কয়েকটা ডুবকি লাগালাম। সেকি আনন্দ। ফটো উঠলাম আবার। এই গঙ্গাতে ডুবকি দেওয়াটা ভুলবার নয়। ভীষণ ভীর তীরে। সব চেঞ্জিং রুম গুলো অকুপাইড। কিছুক্ষণ পর একটা খালি হল সেটাতে গিয়ে চেঞ্জ করে নিলাম। আজ সারনাথ! কি মজা! হোটেলে ফিরে নাস্তা করে তৈরি হয়ে নিয়ে সারনাথের উদ্দেশ্যে আমার যাত্রা শুরু হল।অনেক দূর!  তা প্রায় ১০ কিলোমিটার হবে।  অটোতে অনেক চার্জ করতে পারে ভেবে শেয়ারড টোটো  নিলাম গোধুলিয়া থেকে। শহর ছাড়িয়ে আমরা ক্রমশ এগিয়ে যেতে থাকলাম। ্টোটো পাণ্ডে পুর অবধি গেল সেখান থেকে আমাদের অন্য অটো ধড়তে হবে। আর আমাকে আশ্চর্য করে দিয়ে টোটোওয়ালা পার হেড মাত্র ২০ টাকা চার্জ করল। সেখান থেকে আমরা অটো নিয়ে সারনাথ এলাম। অটোওয়ালাও পার হেড মাত্র ১৫ টাকা চার্জ করল।দশ কিলোমিটার পার হেড মাত্র ৩৫ টাকা লাগল। বাহ বেশ! নর্থ ইন্ডিয়া আমার সব যায়গা ঘোরা শেষ কিন্তু এই যাত্রাতে খুব আনন্দ হচ্ছে। প্রথমেই সারনাথ ডিয়ার পার্কে গিয়ে ঢুকলাম ১০ টাকা জনে এন্ট্রি টিকেট কেটে। কিছু জংলী হার্ব ছাড়া গাছপালা তেমন নেই। এখানে সেখানে যাত্রীদের ছাড়াও জোড়ে জোড়ে লাভার্স বসে আছে। জুতে কয়েকটা বিলুপ্ত প্রজাতির পাখী দেখলাম। ব্লেক বাগ হরিণ দেখলাম এই প্রথম। কি জানি আগে ও দেখেছি কোথাও হয়তো কিন্তু এবার বিশেষ মনোযোগ দিয়ে দেখলাম কারণ  অভিনেতা সলোমন  নাকি এই বিলুপ্ত প্রায় হরিণকে গুলি করার অপরাধে ফেঁসে গেছেন। কি জানি কতোটা সত্যি। তাই প্রজাতিটাকে ভাল ভাবে দেখলাম। এছাড়া ও চিতল হরিণ, কুমীর, ঘড়িয়াল, কচ্ছপ, পেলিকান, লগলগ, লোহা সারস , জাঙ্ঘিল সারস,  সাদা সারস দেখলাম। অন্য পাশের পুকুর টাতে বেশ কয়েকটা সাদা রাজ হাঁস দেখলাম। ভাল লাগল তবে দৃষ্টি আকর্ষণ করার মতো তেমন কিছু নেই। এক চক্কর মেরে বেড়িয়ে এলাম। তবে বুদ্ধ মন্দিরটি খুব সুন্দর। যদিও ভেতরে ঢুকিনি। বাইরের স্থাপত্য দেখবার মতো ।অপূর্ব! এখানেও বহু পুরাতন বট বৃক্ষ দেখলাম। বটঝুড়ি গুলি প্রায় মাটি ছুঁই ছুঁই করছে।  যদিও এদেরকে ট্রিমিং করে রাখা হয়। ঝুড়ি গুলির নীচে ও বেশ কয়েকটা ফটো তুললাম। এই মন্দিরের পাশেই দিগম্বর জৈন মন্দিরটা ও ঘুরে এলাম। দিগম্বর জৈন মন্দিরের গেটটা ভাল লাগল। দুদিকে দুটো অশোক স্থম্ভ।সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে দেখা গেল হাতের বাঁ পাশে জৈন মন্দির আর সামনে কাঁটা তারের ওপারে বিশাল  সারনাথের অশোক স্তম্ভ বা ধামেক স্তূপ । এটি ২০ মিটার উঁচু। বৌদ্ধ ধর্মে স্তূপ গৌতম বুদ্ধের দেহ তাঁর বাণী এবং তাঁর আত্মাকে প্রতিনিধিত্ব করে বলে জানি।  ঐখানে স্তূপ সামনা সামনি দেখার জন্যে আমাদের এই মন্দির থেকে বেড়িয়ে পাশের কাউন্টার থেকে স্তূপ দেখার জন্যে পনেরো টাকা প্রতি ব্যক্তি আর মিউজিয়াম দেখার জন্যে পাঁচ টাকা প্রতি ব্যক্তি টিকিট নিতে হল। বিশাল স্তূপটার সামনে গিয়ে কেমন নস্টালজিক ফীল হলো।সারনাথের এই ধর্মরাজিক স্তূপটার আস্তরণের অভ্যন্তরে যে কেন্দ্রীয় স্তূপটি রয়েছে তা মূলত অশোক নির্মিত সহস্র স্তূপের মধ্যে অন্যতম। ইট দিয়ে নির্মিত হয়েছিল এই স্তূপ। যা এখন ও গৌরবের সাথে বিদ্যমান। বুদ্ধদেব এখানে তার পাঁচ শিস্যকে নিয়ে ধর্মচক্রাপ্রবর্তনার আরম্ভ করেন। পিলারের একদিকে ব্রামহি আর একদিকে পালি ভাষায় বুদ্ধের বানী খোদিত করা। এটি ১১৯৪ কুতুবউদ্দিন আইবকের হাতে ধ্বংস হলে ও নিজ গরিমায়  এখন ও দাঁড়িয়ে আছে। এর উপরের অশোক চক্রটি সিংহ মূর্তির সাথে মিউজিয়ামে রাখা আছে।  আশে পাশে ছোট ছোট স্তূপ গুলি ছড়িয়ে আছে। সেগুলির উপর বসা বা পা রাখা বাড়ন। আগে ঘাসে এগুলি আবৃত ছিল। এখন সিমেন্ট করে দেওয়াতে সুন্দর হেঁটে হেঁটে পরিক্রমা করা যায়। সারনাথের স্থাপত্য আমাকে খুব আকৃষ্ট করেছে। সারনাথে মূলত তিন ধরণের স্তূপ দেখা যায়। ১. চৌখণ্ডী স্তূপ ,২. ধর্মেখ স্তূপ ,৩. ধর্মরাজিকা স্তূপ।পায়ে পায়ে দেখে নেওয়া যায় সারনাথের দর্শনীয় যায়গাগুলি।  এরপর আমরা মিউজিয়ামে গেলাম। সেখানে ঢোকার আগে পার্স মোবাইল সব সিকুউরিটির কাউন্টারে জমা দিয়ে দিতে হল। রাত্রিবেলা গঙ্গাতে নৌকো বিহার করলাম । আরতির কিছুটা দেখলাম তারপর নৌকো থেকে ঘাটে নামলাম। সেখানে অনেক অনেক ধাপ সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে ধারাহারা মসজিদে গেলাম। মসজিদের পাশে একটা ছোট কোয়ার্টারে একজন লোক থাকে দেখাশোনা করার জন্যে মসজিদের ভেতরে ঢুকবার অনুমতি নেই। কাজেই বাইরের ধাঁচটাই দেখার সুযোগ হল। প্রবেশ মুখে অনেকগুলি মৌচাক। বোঝায় যাচ্ছে কতোটুকু দেখাশোনা হয় এই ঐতিহাসিক মসজিদটির। একপাশে একটি পারিজাত গাছ সেটার কতকগুলি পাতা ছিঁড়ে নিয়ে নিলাম। জলে সিদ্ধ করে এর রস খেতে হবে আজকে। যা ধকল গেছে সারাদিন। শরীরের সব ব্যথা নাকি গায়েব হয়ে যাবে চৌকিদার লোকটা তাই বললে।