জেরের কথা

অজিত রায়





ব্যতিক্রমের অপরগাথা


প্রথিতযশা লেখক গল্পকার উপন্যাসিক কবি সম্পাদক( শহর) অজিত রায় এর সঙ্গে তাঁর মৃত্যুর মাসখানেক আগে কথা বলছিলাম দীপঙ্করকে নিয়ে একটি সংকলন বের করার প্রয়োজন বোধে। এককথায় রাজি হয়ে বললেন, নতুন করে এখন দীপঙ্করের উপর লিখতে গেলে যে নতুন ভাবচেতনা এবং ভাষা প্রয়োজন হবে তা সম্ভব নয়, কাজেই যে লেখাটি ওর বইয়ের জেরের কথায় আছে সেটাই কাজে লাগাবার অনুমতি দিলাম। আমরা কাজ শুরু করার আগেই অজিতদা বিদায় নিলেন। তাঁর কথা রাখার গুরু দায়িত্ব পালন করতেই হবে। তাই লেখাটি পুনরায় রাখা হলো। —--- প্রাণজি বসাক। সম্পাদক। 


দীপঙ্করের বিরাস‍াত : বাংলা কবিতার সাতটি দশক


আধুনিক বাংলা কবিতা প্রথম-প্রথম রেশ সহজ-সুগম ছিল, চল্লিশ আর পঞ্চাশের কবিরা এসে আঙুল ফাঁসিয়ে তার ন্যাড় আটকে দিয়েছেন। বিশ শতক আসার আগে ধাতব কলেজার কবিরা দুঃখবরণের তোয়াক্কা না করে বাঁকাস্রোতে খুব খেল দেখিয়েছেন। কিন্তু বিশ শতকের গোড়ার দিকে বাংলা সাহিত্যজগতে কিছু কিছু নতুন কুলক্ষণ পয়দা নেয়। এই নয়াল সেঞ্চুরিতে ঢুকে কবিরা দেখলেন কবিতা একটা চমৎকার জীবিকা হতে পারে। দুটো ডিকেড পেরোতে না পেরোতেই নানা খেপের বৃত্তি, খেতাব, পুরস্কার আর সরকারি ঝুনঝুনার ফাঁকতালে সাহিত্যক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের বেশুমার মনোপলি শুরু হয় আর শতকরা পঁচাত্তর জন কবি এক-একটা ঘয়েলায় ঢুকে হাঁটুজলে দমাদ্দম লাথ ছুঁড়ে খুব বুলবুল্লা তুলতে থাকেন। পাঠকদের পাঠদাঁড়াও পাকচক্রে পালটি খায় এবং পো-নিৎসে-আইনস্টাইন সমর্থিত সাইকলিক দস্তুর মেনে বাংলা কবিতার গাড্‌ঢাযাত্রা শুরু হয়ে যায়। ভাবা যাক, ততদিনে যখন পশ্চিমী বিশ্বে টোয়েনটিজ-এর পেঁয়াজি হব্যাশ ছাই হতে লেগেছে, অলডাস হাক্সলি-লিটন স্ট্রেচিদের স্যাটায়ার, লরেন্সের লিবিডো, ভার্জিনিয়া উলফের মাইক্রোমোনিয়াল সেন্টুজালের ওপর দিয়ে নীল-বরফের কাত্রাবয়ে যাচ্ছে, এমন দিনে, তিরিশের সেই গোড়ায় একদিকে 'পরিচয়' আর অন্যদিকে 'কবিতা' – এই দুই ক্যানেলকে দস্তবরদারি করে বাংলা ভাষার মেইন স্ট্রিমের খাঞ্জা খাঁ কবিরা পদ্যের ছ্যাকরা হেঁকে চলেছেন ‘যৌবনবিভঙ্গ মোর উচ্ছ্বসিয়া গাহে কার গান' জাতীয় লিরিক-স্রোতে। উঠতি রাগী বেপরোয়া কবিরা পাত্তাই পাচ্ছে না ‘বিচিত্রা”, ‘ধূমকেতু’ আর কোরা-আনকা ‘দেশ’-এর কাছে। রবীন্দ্রছুটার দাপট তখনও গ্রাস করে রেখেছে ছিয়াত্তর জন কবিকে। বাকি দু-ডজন ‘নতুন’ কিছু করার তাড়ায় ফাটা বাঁশের সোর্ড ভেঁজে চলেছেন হিটলারি কেতায় : ‘প্রেমের আবীরে নয় – কবিতা রাঙাব দিয়ে বিধবার সিঁদুর' (বিভূতি চৌধুরী) ইত্যাদি। কেউবা হাতপটকা ছুঁড়ছেন : ‘কবিতা হবে আগামী কালের সত্য, এ যুগের মিথ্যাচার নয়' (হরপ্রসাদ মিত্র) – এই পিটিশনে। তখন সুভাষ মুখুজ্জে, জগন্নাথ চক্রবর্তীরা লিখতে শুরু করেছন বটে, কিন্তু বড্ড কাঁচা, – 'তনুর তীরে দেখিছ নাকি কামনা মায়ামৃগ / কাজল চোখে দিতেছে হাতছানি, / ব্যাধের বাণ পিছুতে কাঁপে জানি ও মরমী গো / তাহারে লয়ে কাননে কানাকানি।' (সুভাষ ) ।


তিরিশের দশকে সবচেয়ে ধ্যানভঙ্গ-এন্ট্রি দিনেশ দাসের – ‘ধ্যানমৌন তপস্বীর তপোভঙ্গ হল আজ বহুদিন পর / বর্ষণের মত্ততায় রুদ্র সুরে আত্মভোলা জেগেছে শঙ্কর / দুরন্ত উল্লাসে যেন' – সাঁইত্রিশ সনে যাঁর ‘কাস্তে’ গনগনিয়ে দিয়েছিল বাংলার গন্ধবাহ। অবশ্য, বাংলা কবিতার তৃণপ্রতিম বাঁকবদলও ‘কাস্তে’ ঘটাতে পারেনি। নরেন মিত্তির, হরিনারান চাটুজ্জে, নারান গাঙ্গুলিরা হাফ ডিকেড ধরে 'কাব্যপ্রলাপ’ উগরে উগরে হাবজা কবিতার আলবাটি বানিয়ে ফেলেছিলেন। ‘পৃথিবী না প্রেতলোক মাঝে মাঝে হতেছে সন্দেহ' (অশোকবিজয় রাহা) – এমনতর মাচিশ-পংক্তি লিখনেঅলাদের দেখা মিলছে ক্বচিৎ । তরে মিলতে অবশ্যই লেগেছে। ‘ঘুঙুরের বোলে মদালস দিনগুলি / মিলনোন্মুখ কিশোরীর মত হল’ (কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়) ঐ সময়েই লেখা। বাংলা কবিতার আড়ায় একদিকে পদ্যপ্রলাপের বদমাংস জমে জমে একশা, ফের অন্যদিকে মেদ ঝরিয়ে, উপমা, প্রতীক, আঁশ ছাড়ানো শব্দবন্ধে নিপুণ নিটোল তন্বী করে তোলার তষ্টি-তদ্বির।


তারপর বোমারু বিমান আর মন্বন্তরের দিনগুলো এসে গেল — ১৯৩৯-৪৫ – একটু বাদেই দাঙ্গা। কবিতাও ঢুকে পড়ল কাশিদাপাঠের মজলিশে। হুঁচোট খেল ক্রিয়েশান, খানিক বাট লেগে গেল কবিতার ছ্যাকরাযাত্রায়। বীরু চাটুজ্জেদের খুনে-খরশান চাকু খুব চমকাতে লেগেছে, দিনেশ দাসের মুঠোয় ক্রান্তির ফিনকি। এহেন অপদিনে অসীম রায়, পরে যিনি ধুরন্ধর ঔপন্যাসিক হবেন, রবীন্দ্রনাথকে লেখা গান্ধীবাবার একটি চিঠির প্যারোডি বানাতে গিয়ে বাংলা কবিতার ভিরি আর্জিটাই গোটাগুটি বয়ান করে দিলেন : ... কোটি কোটি প্রাণে আজ কি অশান্ত মত্ত ব্যাকুলতা, / আজ তারা চাহে শুধু অন্ননাম্নী একটি কবিতা।’ আর, কী আশ্চর্য, এর পরপরই বাংলা ভাষায় দুজন আদিম দেবতা সত্যিসত্যি ‘অন্ন-নাম্নী’ কবিতা নিয়ে চলে এলেন। তাঁদের একজন অমিয় চক্রবর্তী, অন্যজন জীবনানন্দ দাশ। দেশ যুদ্ধ দাঙ্গা মন্বন্তর এক লপ্তে ভ্যানিশ হয়ে কবিতায় এলো কবিতার নিকষ দ্যুতি। বিশেষত জীবনানন্দ, ঐ ছিল নোডাল পয়েন্ট; বাংলা কবিতায় যে একটা ভারি-ভরকম তত্তাপলট ঘটতে চলেছে – তার পাতবিন্দু। মৃত্যুর পরে নয়, এমনকী, তার আগেই জীবনানন্দকে চিহ্নিত করা হয়েছিল এইবলে যে, ‘আধুনিক বাংলা কাব্যে জীবনানন্দের দানই সবচেয়ে অসাধারণ ও কৌতূহলোদ্দীপক।' কী আশ্চর্য, একজন হেরো, পরাক্ত পুরুষের ত্রাস- নির্বাপিত নিষ্প্রাণ ও নিস্তেজ জ্বালা, তথা একাকীত্ব ও নভাক যামিনীর প্রতি মর্মান্তিক স্যারেন্ডার থেকে নতুন ফুয়েল পেয়েছে নির্বাপিতপ্রায় বাংলা কবিতার দীপশিখা। এ ভারি অদ্ভুত, বড়ই শ্রদ্ধার। হিমশীতল অবসাদ আর তুষাগ্নি বিষাদ থেকে জীবনের নতুন ফিটাস।


দেশভাগ হলো, অর্থাৎ 'স্বাধীনতা'। বাংলা কবিতার উত্তরণের চাকা আরেক দফা গাড়ায় পড়ল। সিংহভাগ কবি মেতে উঠলেন ‘শহীদপ্রণাম' আর 'নয়া শপথ' গোছের টাইমপাশে। অল্প আগের বতা নিয়ে সমালোচক অরুণকুমার সরকারের মন্তব্য ছিল : '১৯৪১-৪৫-এ বাংলা ভাষায় যতগুলি কবিতা লেখবার চেষ্টা হয়েছে তার মধ্যে শতকরা সতেরোটি পদ্যই, যদি-না আরো বেশি, আজ ধূলিমলিন সংবাদপত্রের তুল্যমূল্য।' অরুণবাবু মোটে সতেরো পারসেন্ট আর ১৯৪৫-এ কেন সীমা টানলেন বোঝা মুশকিল। এ- কথা স্বচ্ছন্দে প্রযোজ্য ছিল স্বাধীনোত্তর কালের কবিতা সম্পর্কেও। এমনকী, পঞ্চাশের বেশির ভাগ কবিতা দেখলেও এ-দৈন্য আরও বিকট হয়ে ওঠে। অবশ্য পঞ্চাশ বিষয়ে আরও 'কথা' আছে।


পঞ্চাশে বাংলা কবিতায় লেগেছে হালকা চালের রোমান্টিক সুর – ‘এখন এসেছে ধান কুড়াবার ধুম / সোনা ফলা মাঠে আমাদের অধিকার' (রাম বসু)। "খুব সুন্দর, না? / এই যে বিকেল, সূর্যের হাতে প্রসাধিতা লাল / বর্ণা'। (বটকৃষ্ণ দে) তখন নতুন কবি মাত্রেই রোমান্টিক আর তাতে কড়ারি তামা- তুলসী নিয়ে উঠে আসছে একটি নাম – দেবদাস পাঠক : 'এখানে মিঠেল হাওয়া, সমুদ্র না জানি কতদূর, / সন্ধ্যায় কার্জন পার্কে শুনি তবু সমুদ্রের সুর। পুরনো নামী কবিদের মধ্যে অজিত দত্ত, প্রমথনাথ বিশী, বনফুল আর খুব করে দাপাতে লেগেছেন প্রেমেন্দ্র মিত্র। জীবনানন্দ বাদে অচিন্ত্যকুমার, শামসুর রাহমান, বিরাম মুখোপাধ্যায়, গোবিন্দ চক্রবর্তী, দিনেশ দাসদেরও খুব বোলবালা। ওদিক থেকে আবার স্তবকান্তরে ছন্দান্তর ঘটিয়ে কবিতায় বিরল ছোঁক এনে দিয়েছেন নীরেন চক্কোত্তি। চলছে পঞ্চাশের খেলা, দেখতে দেখতে কল্যাণ সেনগুপ্ত, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তরাও নেমে পড়লেন আসরে : এ পথের বাঁকে দাঁড়ালে কখনো একদিন যেত শোনা “একটি নদীর মন-কেড়ে নেওয়া সুর, / মনে হতো বাজে সেতারের মতো। তবু কেউ জানতো না / নদীর মোহানা অনেক দূর।' (অলোকরঞ্জন) ..... এধার ওধার থেকে রটানো হতে লাগল যে সুদিন ফিরে আসছে বাংলা কবিতার। যুদ্ধ-দাঙ্গা-দেশভাগ-রিফিউজির সমস্যা কাটিয়ে কবিতার স্বাস্থ্যে বাপস্ আসছে নতুন দ্যুতি।


আসল ঘটনা ছিল বিলকুল উলটো। আদতে, এই ছিল টার্নিং পয়েন্ট যেখান থেকে বাংলা কবিতা পাঠক হারাতে লেগেছিল। যুগপৎ সুদিন আর দুর্দিন – বিশ্বের আর কোনো ভাষার কাব্যজগতে এমনতর বিচিত্র ঘটনা সম্ভবত ঘটেনি। শঙ্খ-সুনীল-শক্তি-ফণীভূষণ আচার্যদের আসরে নামতে তখনও সামান্য লেট, এমন দিনে, ৫০-এর শুরুতেই বুদ্ধদেব বসু রটিয়ে দিয়েছেন : 'ছন্দ, মিল, স্তবকবিন্যাসের শৃঙ্খলা, এ-সব বন্ধনেই কবির মুক্তি।' র‍্যাশনাল এনজয়মেন্ট-এর নতুন খবর। পঞ্চাশের লক্ষ্মীঘরানার ফোকাসবাজ কবিরা সেটা গিলে ফেললেন। বিষয়ে ন্যাকাচিত্তির রোমান্টিকতা আর আঙ্গিকে রকমারি বেগুনপোড়া এনে তাঁরা ফাটিয়ে দিতে চাইলেন বাংলা বাজার। আলোক সরকার আঙ্গিক আর শব্দের বিন্যাস নিয়ে এত কসরৎ করেন যে প্রতিটি কবিতায় ক্র্যাকের দাগ দগদগে হয়ে দেখা দিতে থাকে। আর আনন্দ বাগচী রবীন্দ্র-গানের ফাটা রেকর্ডগুলো বাজিয়ে বাজিয়ে পাঠকের মূত্রপুটের দুব্বো ঘাষে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলেন। এসব করে পঞ্চাশের কবিরা ভাবলেন বাংলা কবিতায় ‘প্রগাঢ় প্রতীতির সুর' দেখা দিয়েছে আর স্পষ্ট হয়েছে তার এক্সপোজ-ভঙ্গী। কিন্তু এর অবশ্যম্ভাবী ফল হিশেবে দেখা দিল পাঠ্য- পাঠকের সেই জগদ্বল সমস্যা। সমস্যাটা যে ধাঁই ধাঁই হারে বাড়তে শুরু করেছিল সেটা ধরাও পড়ে যায় ‘আরও কবিতা পড়ুন' ফেস্টুন হাতে চৌরঙ্গীর পথচারীদের কাছে চল্লিশের কবিদের হাত-পাতা আখুটিতে। বিষয়ের গরিমা বাঁতায় ফুঁসে স্রেফ আঙ্গিকের দিকে মাত্রাতিরিক্ত ঝোঁকের ফল যে বাংলা কবিতার পক্ষে অশুভ হতে পারে তা যেন বুঝতে পেরেছিলেন কেউ কেউ। সময়টা ঠিক ৫০-এর মাঝামাঝি, বাংলা কবিতা তার সহজ-সুগম পথ ছেড়ে অচিরেই ন্যাকানাদা লিরিক আর আঙ্গিক সর্বস্ব শব্দচচ্চড়ি হয়ে উঠল।


ফলে, অনিবার্য ভাবেই ষাটে ঘটল সর্বস্তরিক তোড়ফোড়। ষাট, কেবলমাত্র একটি সময়চিহ্ন নয়, সময়ের গতরে যাট ছিল একটি পিরেনিয়্যাল আঁচড়, এক প্রবল ঘূর্ণাবর্স্ক – সত্তরে এসে যার পরিক্রমা সমিল হয়। বাংলা কবিতাধারায়, বিশেষত পঞ্চাশের ন্যাকাচিত্ত লিরিকবাজি আর কলাকৈবল্যবাদের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড অনাস্থা আর বিরক্তি গনগনে অমর্ষ হয়ে আছড়ে পড়েছিল ষাট-সত্তরের ঐ হাঙ্গামার দিনে, যখন প্রকাশ্য ডে-লাইটে ফুটপাথের হাড়িকাঠে গলা-ফাঁসানো পঞ্চাশিয়া কবিতার হালাল প্রত্যক্ষ করেছে কলকাতা। ন্যাকানাদা ধুতি-কবিদের ফুল-দুব্বো-ধুনো কালচারের বিরুদ্ধে আধপেটা ছোটলোক ভবঘুরে গাঁজাখোর চরসখোর তাড়িখোর রেণ্ডিবাজ কবিদের তীব্র সাবঅলটার্ন আর ডায়াসপোরিক কাউন্টার কালচার চাক্ষুষ করেছে দিনদাহাড়ে ব্যাংক-রবারির ফিল্মী কারকিতে। ছোটলোকদের ঐ ধরদবোচা অ্যাকশানে গাঁড় ফেটে গিয়েছিল প্রতিষ্ঠানের ধামাধরা ক্লীন সেভড পাউডার-পমেটমপ্রিয় পঞ্চাশের কবিদের। তাঁদের ভয়-পাওয়া কাউন্টার-অ্যাটাক দানা পেয়েছিল এইভাবে যে, 'আত্ম অস্তিত্বের গূঢ়মূল আবিষ্কার, মৃত্যুর বোধ, অসুন্দর শয়তান আর পাপের ধ্যান একদল কবিকে একটি বিচ্ছিন্ন কুঠুরির মধ্যে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে' (শঙ্খ ঘোষ)। এবং, বুদ্ধদেবের হিক্কে-তোলা বোদলেয়রী বাতাবরনকে উচ্ছ্বাসভরে স্বাগত জানানো হয়েছিল। এতে- করে পঞ্চাশের ল্যাসল্যাসানি ধরা তো পড়েই যায়, চল্লিশের কন্ডোমফোলা ফক্কাবাজিও ফাঁস হয়ে যায় এক লপ্তে।


আশি : দীপঙ্করের চারপাশ

আশির দশকের সূচনালগ্ন মামুলি ‘সন্ধিক্ষণ' ছিল না। এর আগে পর্যন্ত বাঙালির সমাজ ও জীবন সংক্রান্ত ভাবনাগুলো যে খাতে বয়ে আসছিল, – সেখানে সারা ভারতভূম জুড়ে পলিটিকাল ডামাডোল ও বিচ্ছিন্নতাবাদী হুড়দঙের মাঝে, বঙ্গ কালচারের পীঠস্থানে হটাহট বাম রাজনীতির শুরুয়াৎ এবং তজ্জনিত বহুবিধ উলটফের, ১৯১৭ থেকে দেখে আসা কমিউনিস্ট ক্রান্তির স্বপ্ন গর্বচভে এসে চুরমার, টিভির আগের প্রজন্ম ও পরের প্রজন্ম— বিজ্ঞাপনের ভাষায় ‘জেনারেশন নেক্সট’, এবং তথ্যপ্রযুক্তি তথা সাইবার বিস্ফোরণে মূল্যবোধের বিশ্বায়ন ঘটে যাওয়া – এসবের সম্মিলিত এফেক্ট হিন্দী ফিল্মের প্যারালাল আর মশলাদার ফিল্মের ক্র্যাকের মতো একটা মোটা দাগ খিঁচে দিয়েছিল আশির দশকে। আশি আর

তার পরের বাংলা কবিতার চিড় ফাড় করতে হলে এই প্রেক্ষিতটাকে আলচা-চোখে নজর রাখতে হবে। যদিও কলকাতা কেন্দ্রিকতার বহুধ্বংসী সমস্যাটা থেকে মুক্ত থাকতে হবে তারও আগে।


আশির দশকের লেখাপত্রে এমন কিছু পর্যায় আছে যার দরুন চলে আসা এঁদো কাব্যযাত্রার সাপেক্ষে কেউ কেউ সিদ্ধি পেয়ে গেছেন। এই মুহূর্তে চটসে যাঁদের নাম মনে পড়ছে, এবং কবি ও সুললিত গদ্যের প্রবন্ধকার স্বপন রায়ের ভাষায় যাঁরা “বিগত দিনে বিদ্যুৎপ্রভ আকাশিয়ানা থেকে নতুন চেতনায়, দ্যুতিময় নীলাভে যেতে চেয়েছেন এবং অংশত সফলও হয়েছেন, তাঁরা অলোক বিশ্বাস, জহর সেনমজুমদার, ধীমান চক্রবর্তী, নাসের হোসেন, নীলাঞ্জন মুখোপাধ্যায়, প্রণব পাল, মল্লিকা সেনগুপ্ত, রঞ্জন মৈত্র, রাহুল পুরকায়স্থ, শুভঙ্কর দাশ, শ্রীধর মুখোপাধ্যায়, স্বপন রায় ইত্যাদি। এঁদের ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্যকে দশকের নিজস্ব হিসেরেও দেখা যেতে পারে। কারণ আশির দশকের কবিতার সমস্ত পেরেকচিহ্ন ধারণ করে রয়েছে মূলত এঁদেরই জীবনরোধ, মেধা, পাঠ, দার্শনিক অবস্থান, প্রজ্ঞা এবং প্রতিভা। অধুনান্তিক লিরিকহীনতার মধ্যে লিরিকতার 'নতুন চেতনা এবং পুরনো শব্দের মেলবন্ধনে এঁদের লেখাপত্র হয়ে উঠেছে বাংলা কবিতায় এক নতুন ধারা।

নতুন ‘ধারা’, কিন্তু নতুন একটা ‘অধ্যায়' গড়ে তুলতে পারেনি মুষ্টিমেয় এই ডজনের কবিতাচর্চা। যেখানে শব্দ দিয়ে কবিতা তৈরি হয়, তাই নতুন চেতনার জন্য নতুন শব্দেরও প্রয়োজন। পুরানো শব্দের অপরীক্ষিত ব্যঞ্জনা দিয়েও নতুন কিছু তৈরি করা যায়, কবি বারীন ঘোষাল যাকে বলেছেন শব্দের ‘অসম্ভব ব্যবহার; – কবি যখন প্রচলিত রীতি, ছন্দ-প্রকরণ এবং শব্দ শরব্যতায় শৃঙ্খলিত বা আন-ইজি বোধ করেন, তখনই নতুনের জন্য এই যাচনা জন্মায়, নতুন কবিতার জন্ম হয়। কিন্তু আশির সিংহভাগ বা সংখ্যাগরিষ্ঠ কবিদের লেখাপত্রে এই 'নতুন'-এর খাস নমুনা নেই। এঁদের কারণেই এখন বাংলা কবিতার পাঠক আরও কমে গিয়েছে। পাঠকরা মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছেন ঐ সিংহভাগ কবির কবিতা থেকে, যেখানে নিরূপিত ছন্দে ঝকাস্-ঝকাস্ অন্ত্যমিল দিয়ে মধ্যবিত্ত ভাব-ভালবাসা-রাজনীতি-সমস্যা-রোমান্স-স্থূল আবেগের কথা বলা হচ্ছে। কখনো সামান্য সূক্ষ্মভাবে, কখনো একেবারেই গভীরতাহীন ‘স্মার্টনেস' সহ। আর, দোষের দায়ভারটা অযথা লেপটে যাচ্ছে আশির দশকের সমস্ত কবির সঙ্গে। মানে, আহত হবার মতো যেটা, — ষাটের তিনুকমিজাজ শক্তমুঠোর কবিরা বাংলা কবিতায় ফর্ম আর কনটেন্টে যেসব ফেরাফিরি আর তরমিম আনলেন, মাঝের একটা দশক সাবাড় হতে না হতেই ফের পেটআঁটা কনস্টিপেশান ।


এটা ঠেকনো দেওয়া একরকম অসম্ভবও ছিল। আজ বিশ্বায়ত মিডিয়ার সর্বগ্রাস আর দিনমানের স্পিড আমাদের বাধ্য করছে জীবনের তাবৎকিছুকে খবর-চলাকালীন তলায় বহমান হেডলাইন স্ট্রিপের মতো করে দেখতে। জাগতিক সমস্ত কর্মকাণ্ড থেকে মেন্টালি বিচ্ছিন্ন হয়ে গভীর কোনো কিছুতেই ইনভলভড হওয়া পুরোপুরি বানচাল হয়ে গ্যাছে। এরই অনিবার্য পরিণাম আজকের বাংলা কবিতার অনগিনৎ উপস্থিতি, যা শতাধিক টিভি-চ্যানেল তথা সহস্রাধিক মোবাইল টোনের ট্যাঁ-ট্যার মাফিক থ্রি হানড্রেড সিক্সটি ফাইভ মিলিয়ন ওয়েব সাইট ন্যাভিগেশানের আরূঢ় প্লুরালিজমের আড়ালে শব্দের ওপর শব্দ চড়িয়ে শব্দের ক্রসব্রিড ঘটিয়ে একেবারে স্টিল প্রিভেইলিং কন্ডিশানে পয়দা পাচ্ছে এক-একটি ন্যাকান্যাতা কন্ডোম- পিচ্ছিল ঘোমটানো ঘরানার মাদি কবিতা। শাসনতন্ত্রের দমনকেতার সঙ্গে কো-অর্ডিনেট করে সাহিত্যের গিনাচুনা মধ্যবিত্ত প্রতিষ্ঠানগুলো গাঁ-গঞ্জ, জিলা-মহকুমা আর শহুরে ইউনিভার্সিটি থেকে তাজা-তরকা ব্রিলিয়ান্ট ছেলেমেয়েদের ধরে ধরে কবিতা ছাপানোর নামে ভ্যাসেক্টমি করে ছেড়ে দিচ্ছে বাজারে। তারা এখন স্রেফ শব্দ খায়, শব্দ হাগে, শব্দের চিনেপটকার পোঙায় ধূপকাঠি ধরে শব্দ সেলিব্রেট করে। এদের যে-কোন একটি চার ফর্মার কবিতার বই বিশ মিনিটের মাথায় হাত থেকে খসে রদ্দির বীনে সর্বদার নিমিত্ত থির হয়ে যায়।


পদচিহ্ন : স্রোতের বাইরে দীপঙ্কর

আশির দশকওয়ারি ট্রেন্ডটাকে একাই পুরো গুবলেট করে দিয়েছেন দীপঙ্কর দত্ত। কিন্তু আপদের কথা হলো, কী গদ্যে, কী পদ্যে, – গোড়া থেকেই বাঙালির পাঠদাঁড়া এমন গেঁতো আর এঁদো যে ব্যতিক্রম'কে কবুল করতে বেজায় তরাস। রীতিবিরুদ্ধ কিছু দেখলেই আতঙ্ক, এই বুঝি আমার শাক- চাপা ভেটকি ঘুল্টে দিল। কোনরকম পরীক্ষার মগজমারিতে বাঙালি নেই, টেবিল সাজানো জং-ধরা মডেলগুলো নিয়েই তাঁরা অনন্যচিত্ত। দীঘা, বকখালি কি পুরী, এবং হাতব্যাগে রেক্ত থাকলে বড়জোর গোয়া। নতুন সমুদ্র আবিষ্কারই হয়ে ওঠে না কারণ পাঁজার তলায় বালুচর খোয়ানোর ভয়। নির্জন শৈলশিরায় সবুজ দেখতে না পেয়ে যেভাবে বিচি নেয়ে ওঠে ঘামে, অবিকল তাই, বাঙালির সমুদ্রপাড়ি আর হয়ে ওঠে না।

ফলত এঁরা, এই বাঙালি পাঠকরা দীপঙ্কর দত্তকে চেনেন না।


দিল্লিতে দীর্ঘ যাপন, কিন্তু নিশিকড় নন। বরিশালের গবরু জওয়ান। বয়স বিয়াল্লিশ। গঠিলা গড়ন, চোখভর্তি মাচিশ। কব্জি ডুবিয়ে খেতে ভালোবাসেন। নেহাৎ ভদ্রলোকের মতই খিস্তিখাস্তা। শঠ-জোচ্চোর- দাদালদের সঙ্গে ওঠাবসা কিন্তু নিজে হান্ড্রেড পার্সেন্ট সৎ। শেয়ার মার্কেটের টেকনিক্যাল অ্যানালিস্ট। সামাজিক জীবনে মিসআন্ডারস্টুড, পারিবারিক জীবনে অসুখী, প্রেমহীন জীবন। থোবড়ায় শাস্ত্রবিরোধী সিম্পটম একটিও নেই যদিও অসম্ভব আড্ডাখ্যাপা, দারুবাজ আর গলা-খোলা কবিতার পাগলামিতে গোষ্ঠী চেতনার ছাপ পুরো বজনিশ। স্বশিক্ষিত, মেধাস্পৃহ, নিয়ত পরীক্ষার্থী, লড়াকু মেজাজ আর উত্তরমডার্ন মননের এই প্রবল অনুশাসনহীন কবি যিনি স্বীয় স্থা-বিরোধী কথাবার্তা, যেগুলি কখনও রাগী, কখনও জেদি, কখনও তির্যক, কখনও চিত্রল, বক্র ও বিধ্বংসী অথচ আশ্চর্য্য বিহারে গঠনমূলক একমাত্রিক ব্যঞ্জনা থেকে যা প্রায়শ হয়ে ওঠে বহুমাত্রিক ও দ্যুতিময়, – এমন একজন বিন্দাস কবিকে, এঁরা, এই বাঙালি পাঠকরা চেনেন না।


চেনবার কথাও নয়। কারণ কোনো থাম বা স্ট্যাচু নেই দীপঙ্করের। লেখা শুরু দশ বছর বয়স থেকে অথচ যাঁর ঊনত্রিশ বছর বয়সে বেরুনো প্রথম কাব্যগ্রন্থে কবিতার সংখ্যা একুনে ১০, দ্বিতীয় গ্রন্থে ৭, বছর পিছু চব্বিশ কি ছত্রিশটি নির্মাণ বড়জোর; জিরো আওয়ার', 'অ্যাসাইলাম', 'দিল্লি হাটার্স', 'শহর’ ‘কবিতা ক্যাম্পাস’ আর ‘গ্রাফিত্তি' বাদে ৭ নম্বর কাগজটি খুঁজে পাননি লেখার জন্য, সংখ্যায় এতই অল্প, বাছবিচারে এ-পরিমাণ খুঁতখুঁতে। কলকাতা বা শহরতলীর সিংহভাগ বাঙালি কবি যখন নিত্যি সন্ধ্যায় নন্দন-অ্যাকাডেমির ঘাসে গাঁড় ভিজিয়ে বছরব্যাপী মুনিয়া-চড়ুই-ফাকতার মাফিক শব্দসোদনে মেতে থাকেন, তখন ইনি, এই দীপঙ্কর দত্ত, শিলীন্ধ্রের মাফিক স্বীয় সংক্ষিপ্ত সৃষ্টি-ঋতুটির নিমিত্ত দর্ভটে এন্তেজার করেন। সম্ভবত এই ধাতের কবিদের দিকে ইশারা করেই একদা সুভাষ মুখুজ্জের স্যালুট ছিল এই ভাষায় – ‘এমন মানুষ পাওয়া শক্ত / লেখা রাজ্য ছুঁড়ে / এই নিচ্ছেন কলম এবং / এই ফেলছেন ছুঁড়ে।'

আশির কবি ও কবিতা বিষয়ে এতদিনে নিযুত সংলাপ শেষ হয়ে গেছে। তবু দীপঙ্করের কবিতা বিষয়ে বলার লোক জোটেনি। ক্বচিৎ মলয় রায়চৌধুরী, কখনো-বা বারীন ঘোষাল, – ব্যাস্, আর কেউ সামান্যতম আকলনের সাহস পাননি দীপঙ্করকে নিয়ে। রিভিউ করতে দিলেই বহু গাঙশালিকের পাইন ফেটে রক্ত বেরিয়ে গ্যাছে।


আশির ঐ প্রাগুক্ত দু-সাইডের ইউনিটারি আর লিনিয়ার কবিদের চুল, নখ, দাঁত, হাড়গোড় আর গুয়ের বু বাঁচিয়ে দীপঙ্করের কবিতার মূর্তিতত্ত্ব, প্রাণীতত্ত্ব ও দর্শনতত্ত্ব একজাই আলাদা হয়ে গ্যাছে। এটা যে শুধুমাত্র দীর্ঘ দিল্লিবাস, বা বাঙালির কলকাত্তাই কলা-পীঠস্থানের লিকুইডেশানে অংশভাক না হওয়ার দরুন, এমন নয়। আসলে বাংলা ভাষার বেশির ভাগ কবির এক-স্থিতি, এক-ছবি, এক-দরদ, এক-মোহব্বতের সঙ্গে দীপঙ্করের কোনো সরোকার নেই। দীপঙ্করের কবিতার উৎস হলো তাঁর নিজস্ব অহংভূমি। কবির এই অহং-এ জড়াচ্ছে মেধা আর শ্রম। অহংকে যা স্টিয়ার করছে, তা ঐশীপ্রেরণা। এই প্রেরণা বা ইমপালস্-এর কারণেই কবিতা কখনো কখনো ‘অসীম-নিরালা’-গোছের এমন এক অদৃশ্য লেভেলে চলে যায়, যেখানে বুদ্ধি অগম্য, হুঁশ লোপাট এবং যুক্তি স্থবির হয়ে পড়ে। এই যে লোকজগত থেকে অলীক স্ফিয়ারে চলে যাওয়া, বস্তু থেকে অসীমে, শব্দফেরে এটিই হয়ত অতিচেতনা। ইয়ু কথিত ‘আনকনশাস ডেপথ্’ থেকে এই অতিচেতনার বিস্ফার। বিষয়হীনতাকে, শূন্যতাকে শব্দে ভরার এই কসরৎ, এই বুঝি দীপঙ্কর। এই যে বিষয়হীনতা, বরং একের পর এক ফ্ল্যাশ নিয়ে একটা সেমিওটিক ফ্লাক্স তৈরি করা, এটা বাংলা কবিতার চালু অনুশাসনের একদম বিপরীত। এটাই দীপঙ্করকে অন্য অনেকের চেয়ে আলাদা করে দিয়েছে।


শিলার-এর ‘নাঈভ' শব্দটির সঙ্গে আজকের দিনে আমাদের ফারাক ঘটেছে। অধিকিন্তু হার্ট অব দ্য পোয়েট্রি বলতে অর্বাচীন মাতব্বররা যেটা বোঝাতে চেয়েছেন, তা হলো বুদ্ধি । শূন্যতাকে শব্দে ভরাট করার যে শ্রম ও মেধা, – বুদ্ধি'র সাজশ বিনা তার খোলতাই সম্ভব ছিল না। এবং, বুদ্ধির শ্রেষ্ঠ ফল ব'লে অন্যদিক থেকে বুদ্ধির অগম্যও বটে, যা নিছক যুক্তিহীন ও যুক্তিবিরোধী; নিক্তি বা মিটারে যার মাপজোক চলে না, যাকে কেবলি ধ্যান করা যায় – আক্ষরিক ও ব্যাকরণিক অর্থে আজকের দিনেও কোনো-কোনো কবির কিছু-কিছু কবিতা অন্তত এসব তত্ত্বের কাছাকাছি যায়। কবি দীপঙ্কর দত্ত সেই বিরলতমদের একজন।


পাথরগুলি জড় করে আগুন দিয়েছি। প্লেইসটোসিন ফঅনার শেষ ঘোড়ার লিঙ্গ থেকে পাংচারড পূর্ব- পাউচ এক হলদে ঈষৎ ভোর এলো ধওলাধরের বুনো চিয়ারসকিউরো প্রম্পটে। সিলিং থেকে নাবিয়ে আর্শাইলের লাশ এখন দোল খাচ্ছে গেরোবন্দ পাইনের নেটনী হ্যামকে। ওয়েটার, হেয়, হেয় য়ু, কফির কাপটা একটা প্লেট চাপা দাও। নাজমাবানো, ইক নথনী গার্ল নেক্সটডোর লুক আইটেম সি নশেলী তার মিডনুন খররাটা সিয়ো যাচ্ছেন মসিয়ে। গোর্কি ওঠো, ক্যানভাসমুখী এক এসক্যালেটরের হামা ঢেউয়ানি বইছে ফারের লীফী আউটফিটে।


নথভাঙা-পাঠ যাকে বলে, মানে প্রাথমিক পাঠে শব্দের বিবিধ ভারতীয় শরব্যতা ও তার ডায়াসপোরিক পরিপাটি দেখে বিলক্ষণ ধাধস লাগে, বুনন ও বলনকেতায় তাক লাগে, শ্রদ্ধা ডন মারে কবির বিদ্যাবত্তার কাছে, আর সারাক্ষণই পাঠকের মনে কী-যেন কী-যেন একটা ব্যাপার বেজায় ধাঁইপাক খায়। মনে হয়, সবই তো ঠিক আছে ভায়া, সবই ভালো, কিন্তু কবিতা কোথায়? এ তো শব্দের জগা, শব্দের জগঝম্প, কবিতা কোথায়? আসলে এটাও ঘটছে পাঠকের ঐ দুর্মর পাঠদাঁড়ার কারণে। দীপঙ্করের ঐ তথাকথিত ডায়াসপোরিক বা বিবিধ-ভারতীয় শব্দাবলীর দরুন, নিস্বনিত শব্দবুনন থেকে ‘কবিতা’কে আবিষ্কার করতে সময় লেগে যাচ্ছে পাঠকের –


লাইলাহাইল্লিল্লাহ

হজরৎ বীর কী সলতনৎ কো সলাম

বী আজম জের জাল মসল কর তেরী জঞ্জীর সে কওন কওন চলে

মোর এক রেতের ভাতার যখন রেতকাবারি কোতলায় লুঙি বান্দে উয়া বৈঠা মোতে যোগিনী চৌষটের দুই হাজার আটচল্লিশ ঝিলিক এটুলি দাঁত তারে ছ্যাকে ধরে। কালীর ঝুমরার তালে চাঁদের এই কুহৈল খিলখিল শ্যাওড়ার জোনাক মিনসা তারার থান ওই মাতঙ্গীর রেতকালের ডিগা নাটকাপাস পেরোয়ে যেওনি এ জোনাক ভিরমি হেমেন ঠাকুরতারও ছেলো .......


আগেই কবুল করেছি কবিতা হচ্ছে কবির অহং-এর মৌল স্বরূপ। এবং এ কথা আজকের দিনে খুব ধূম্রবুদ্ধি পাঠকের কাছেও ক্লিয়ার যে, কবিতা প্রথমে নিমজ্জিত বা অদৃশ্য অবয়বে গড়ে ওঠে এবং অস্পষ্ট বা ধূসর হলেও কবি সেটা আগেভাগে দেখতে পান। কবি স্বীয় মগজ, বুদ্ধি, মেধা, পড়াশোনা, নিজের পরিপাশ এবং তাৎকালিক মনঃস্থিতির মধ্য দিয়ে তাঁর নিজের মতো করেই সেটা দেখতে পান। ভাবনার স্তরে কবি-দৃষ্ট কবিতাটি ক্রমশ দানা পাকায় এবং শিল্পকণাগুলি ক্রমে রূপ পেতে থাকে। কবি যেহেতু সৃষ্টিশীল এবং মননসম্পন্ন, ফলে কবিতা গড়ে ওঠার পাতবিন্দু বা নোডাল পয়েন্টগুলিকে তিনি এনজয় করেন। এই মস্তিটুকু না থাকলে মালপানি-হীন এমন ব্যাপারকে রেওয়াজ করার পাগলামি মানুষ করত না। এরপর আসে থট-প্রসেস, যখন কবির ভেতরের শাদা কাগজে কবিতাটি লেখা হতে থাকে। সর্বশেষে কবিতাটি আমাদের দিনানুদিনের কাগজে ফুটে উঠলে পাঠকের এক্তিয়ার পর্বটির শুরু হয়ে যায় ।


সুতরাং দেখা যাচ্ছে আমাদের টেবিলে দৃশ্যমান কবিতাটির আগে মূল কবিতার বেশির ভাগ স্তরগুলি বিবিধ প্রক্রিয়ায় কবির অভ্যন্তরে আগেই ভাঙাগড়া হয়ে গেছে। টেবিলে পড়ে থাকা দীপঙ্করের কবিতা প্রাথমিক দৃশ্যে আমাদের কাছে এমন যে বেপোর্ট লাগছে, তার মূল কারণই হলো দীপঙ্করের অভ্যন্তরে ঐ ভাঙাগড়ার প্রসেস। তার থট প্রসেস। তার সঙ্গে জুড়েছে দীপঙ্করের ব্যতিক্রমী ও একক শব্দ-শৌখিনতা শব্দের লুকোচুরি ও ধরাবাঁধার খেলা, dandyism, যা একান্তরূপেই তাঁর স্ব-তন্ত্র, আপন তথা গোটাগুটি অ-স্বাভাবিক। এ সময়ের বেশির ভাগ কবি যেখানে ‘সেন্টিমেন্টাল', দীপঙ্কর সেখানে আশ্চর্য-হারে ‘নাঈভ’। শিলার কথিত ‘নাঈভ' শব্দটি একা দীপঙ্করের জন্যই ফিরে এলো। এ কবি খোদ নিজেই ‘প্রকৃতি’। প্রকৃতির জন্য এঁর কোনো ছটপটানি নেই। কবিতা বানাবার বিধিবিধান এঁর নিজস্ব, টেবিলে প'ড়ে-থাকা কোনো মডেল বা কলপুর্জা ইনি তোলেন না। কোনো রকম গতানুগতের মধ্যে না গিয়েও দীপঙ্করের মধ্যে নিজস্ব নিয়মের যে দার্ঢ্য, বুদ্ধি প্রকৌশল তথা পরিমিতি জ্ঞান বিদ্য রয়েছে, তা তাঁর কবিতার একাধিক পাঠের জন্য আমাদেরকে খেঁচ মারে। বুদ্ধিযুক্ত আর ব্যতিক্রমী শব্দ-দুটো আমরা ইস্তেমালই করব না, যদি না দীপঙ্করের মতো আরেকজন কবিকে আমরা পাই, ‘নাঈভ' কবিকে, যিনি নিজস্ব অন্তস্তলের নিয়মে ক্লাসিকমুখী অথচ বাইরে-বাইরে ভীষণ তোড়ফোড়িয়া।


এ-বাদে আমরা মলয় রায়চৌধুরীর এই মন্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করতে পারি যে, দীপঙ্করের ‘আমি’ লোকটা ফিক্সড নয়, – ফ্লোটিং। আগ্নেয় বসন্তের জাগলার কবিতার নামটা এদিক থেকে জুৎসই। আইডেন্টিটির জাগলিং। ‘আমি’কে দীপঙ্কর বলছেন ভোজবাজিকর। কবিদের দ্বারা এতকাল লালিত-পালিত 'আমি'কে তিনি এক ধাক্কায় গদি থেকে ফেলে দিয়েছেন। আত্মবিলুপ্তির এই সচেতনতা তাঁর অন্যান্য বিস্ময়জ্ঞাপক বৈশিষ্ট্যগুলির চেয়েও বেশি বিস্ময়কর। আলোচকরা যখন লস অফ সেলফ্ আর এলিয়েনেশন নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছিলেন দীপঙ্কর সে-সময়ে আইডেন্টিটি-হীনতাকে প্রোজেক্ট করলেন, এটা সত্যিই কমেনডেবল। এই সাবজেকটিভিটির কারণেই তাঁর কবিতায় এসেছে আংগিক-হীনতার মহোল্লাস। মলয়ের মতে, কাউন্টার ব্লো পুস্তিকায় বেশ ভালোভাবে ডেভেলাপ করেছে ব্যাপারটা।


দীপঙ্করকে ‘ডায়াসপোরিক' বলা হচ্ছে মূল বঙ্গভূম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে দীর্ঘদিন লাগাতার দিল্লিতে বসবাস করছেন সে-কারণেই কেবল নয়। ডায়াসপোরিক মানুষের জীবনধারা ও মতিগতির বহু অলিগলি- সুড় ! দীপঙ্করের মনোজীবনের মধ্যে ধাবাড় মেরে আছে বলেই। জেনেশুনেই হোকবা অজান্তে, ডায়াসপোরার ব্যাপারসমূহ দীপঙ্করের কবিতাকে অন্য মাত্রা দিয়ে ফেলেছে, যা আশির দশকের অন্য কোনো মেজর কবির লেখায় একদমই আসেনি। মলয় সম্ভবত এই দিকটা খেয়াল করেই বলেছেন, দীপঙ্করের লেখন- কাঠামো, ক্ষমতার সনাতন অনুশাসনের বিরুদ্ধে অন্তর্ঘাত করেছে। তাঁর প্যারডি, ট্র্যাভিসটি, আয়রনিগুলোও সুপার্ব। যেমন রবিকে করেছেন রভি, ব্রাহ্মণকে ব্রাহমন, মা-বোনকে মা-বহ্যান। কিংবা বোলবুলাবা, সুতরাং কালো, বিকার্ড, সলতনা, হারামি কারতুত, তেলকা আস্বাদ ইত্যাদি। অলংকার চন্দ্রিকা গ্রন্থে আয়রনিকে বলা হয়েছে বক্রাঘাত। দীপঙ্কর যেটা করেছেন তা কেবল বক্রাঘাত নয়। তারমধ্যে অনেক মজা, খেলাও থাকছে। থাকছে মাজাকি, অ্যাবসার্ডিটি, অসম্বদ্ধতা, অসংলগ্নতা। দীপঙ্কর কাউকে পাত্তা দিতে বা প্লিজড করতে লেখেন না। যেমন ইচ্ছে লেখেন। খুবই ডেলিবারেট মনে হয়। বাংলা থেকে দূরে থাকার দরুন স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর বর্ণসংকর প্রক্রিয়ায় gener হয়ে যায় বহুআঁশলা, চপলমতি।

ডায়াসপোরিক কবি-লেখকদের চর্চার বেলায় একটা কথা মানতেই হবে – হয় নিজের অভিজ্ঞতায় নয় অভিজ্ঞদের গল্প শুনে, এঁরা বাঙ্গা সহ গোটা ভারতবর্ষকে অনেক বেশি চেনেন; এঁদের যে ভূগোল ও নৃতত্ত্বের জ্ঞান এবং অনিবার্য ভাবে এঁদের রচনাকর্মে জবরদস্ত মোহর দেখা যায় যার, তা বছরঘুরুনি কলকাতার চুনোপুটি মার্কোপোলোদের চেয়ে ঢের বেশি দুরুস্ত। ফলত এসব ডায়াসপোরিক কবি-লেখকদের শব্দের বাচ্চাদানিও তুলনামূলক ভাবে যথেষ্ট ফাঁপানো, অর্থাৎ ভরাট। দীপঙ্করের কবিতা পেলেই আমরা যে তৃপ্তিহীন ভাবে লাইনের পর লাইন ধড় ধড়িয়ে নেমে যেতে থাকি, তার কলল কারণই হলো ঐ অসীমায়িত ও বিবিধ-ভারতীয় শব্দের ঝুরি, – বুঝি গ্লিম্পসেজ অব ভারতবর্ষ :


দরঅসল ধাউরের চোপায়ই বল

চুন্নীমাগীগুলানরে বাসে লামাও

টেপাবি চেন্নাবি দশটাকা

এঃ ধমতল্পা এঃ হাওড়া হাওড়া হাওড়া হাড়কাটা গিজগিজা কাক

অভাবটা ভাতের

মা নাই মালসায় কেউচ্ছার ছিলুবিলু কে খায় কার হিম্মৎ সাপ ছাড়া

রানীরে কইলাম ওয়া আমি দুয়ার প্যাটের শত্তুর

জলে নাম নাম চোখে কাজল দিসনি

এক ছোঁক ফোড়নের কাশি লহমা দুই কি তিন

ধুয়ার গুলগুল্লা ম্যাঘ বরিষে দ্যাখ একচল্লিশ বছর -


ক্বচিৎ মনে হতে পারে দীপঙ্করের কবিতা শব্দের অহেতুক আড়ম্বর ঝাড়, কবির কথ্য যেন অযথা মার খেয়ে যাচ্ছে শব্দের ঝালাপালায়। এ-আরোপ কিছুটা বনিয়াদ-যুক্ত হলেও পিরামিডের তুলনা মনে এলে সব মাফ-সাফ হয়ে যায়। আসলে হচ্ছে শব্দের বন্ধুরতা, সেটা আছে বলেই দীপঙ্করের কবিতা কোথাও বোর বা ক্লান্ত করে না। লং রুটের ট্রেনে বসে বাইরেটা যদি বৈচিত্রে ভরা না দেখি, মনে হয় ঘুমোই, ক্লান্তি আসে মনে। দীপঙ্করের কবিতায় সেটা আসে না। জিরোতে দ্যায় না। শব্দবুনন ও তার বয়নকেতা দেখে প্রতীতি জাগে। এক হাংরি বাদে, বাংলা কবিতার সংস্কার বা গতানুগতের কাছে দীপঙ্করের প্রত্যক্ষ ঋণ অতি অল্প, এবং সবচেয়ে স্পষ্ট তথা অকৃত্রিম ভাবে যার প্রতি তিনি অধমর্ণ, তা হলো খোদ দীপঙ্করের জটিল অন্তস্তল।


আরও এক যে-গুণে দীপঙ্করের কবিতা আমাদের খিঁচে রাখে তার নাম ‘গতি’।


আর শেলকাল ফাইভ হান্ড্রেড এম. জি. দিনে একটা করে যেমন চলছে চলবে। ভাঙা স্পোকগুলোর একটা এম. আর. আই. করিয়ে কালকের মধ্যে আমাকে জানান। জাভা শেকার পরতো ফ্যা ফ্যা ঘুরতো! কলিমের শেডে একদিন রাত্রে দ্যাখা, স্ট্যান্ড ছিলো, বললাম এসো আমার একটা পেজ প্রায় বছর ঘুরতে চলল আংখ্যাচড়া এক বাঞ্চোৎ অ্যাডভান্স নিয়ে আজ আসবো কাল আসবো – আমি চাই তোমার হেপাজৎ, সেই শুরু আর আজ যারাই সাইটে আসছে হাওয়াইয়ান স্পিরুলিনা, শার্ক কার্টিলেজ, জিনসেং, কলোরেলা আর কামাল কা হুইট গ্লাস  – কী রিপারকাশন ! আপনি উঠুন বরং পরের জনকে পাঁচ মিনিট পরে আসতে বলে দিয়ে যান।


কবিতা চলেছে, আমরাও ভেসে চলেছি অনুকূল তালে, কবিতা মধ্যেমধ্যে যতি খাচ্ছে, ছন্দে থামছে অথচ পাঠকের হেলদোলের বিরাম নেই। এছাড়া, দীপঙ্করের কবিতা গোড়া থেকেই পোস্ট-জেনেরিক । শুরু-মাঝ-শেষ-বলেও কিছু থাকে না। এই কালখণ্ডের আরও কেউ কেউ সচেষ্টভাবে এটা করেন হয়ত, কিন্তু এ-বিষয়ে দীপঙ্করের ম্যানিফেস্টো একেবারে আলাদা। মলয় রায়চৌধুরীর মতে, বাংলা কবিতার ইতিহাসে দীপঙ্কর এদিক থেকে পথিকৃৎ। এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, – এই আদি-মধ্য-অন্ত না-থাকাটা। এই খাসিয়ৎ তাঁর কবিতায় উত্তর-ঔপনিবেশিক ফ্র্যাগমেন্টারিনেস আনতে পেরেছে, যে-ব্যাপারটা একসময় ভারতবর্ষের লোকসাহিত্যে, পুরাণে ছিল। হাজার বছরের পুরনো ব্যাপার অথচ এটা আমাদের বোর করে না। তার প্রধান কারণই হলো, এর দরুন দীপঙ্করের পাঠকৃতি ফ্লোটিং সিগনিফায়ার ইন্ট্রোডিউস করেছে। আগের প্রজন্মের কবিরা তাঁদের রচনায় একটা ক্ষমতাকেন্দ্র রাখতেন, মানে, আধিপত্যবাদকে তাঁরা স্বীকৃতি দিতেন, দীপঙ্কর তা থেকে সম্পূর্ণত বেরিয়ে এসেছেন। তাঁর কবিতার স্পিড অত্বর ও সমলয়যুক্ত; যেন কবিতা শুরু হবার আগেই কবি জানেন তাঁর গন্তব্যস্থলটি কোথায়, এ বড় তাজ্জবকর ব্যাপার, গন্তব্যে পৌঁছনোর আগে অব্দি কবিতার নাও কোথাও তনিকমাত্র ঠেকে যায় না, আর ঘাটে ভিড়তেই, ভেড়া- মাত্র দড়িদড়ার তৃণমাত্র হল্লাগুল্লা না বাধিয়ে কুলীন বাড়ির বধূর মতো শালীনভাবে থেমে যায়। বড় অদ্ভুত !


সম্ভবত,বাংলা ভাষায় পাওয়ারপোয়েট্রি লেখার দায়িত্বটিও প্রথম গ’ছেছেন দীপঙ্কর দত্ত। তিনি চেয়েছেন র‍্যাম্পের বিড়ালীদের বর্ণাঢ্য আউটফিট ও লিঙ্গেরীয় ক্রিয়েশানে যৎকিঞ্চিৎ ডেপথ্ ঢুকে মালগুলো ইউসার- ফ্রেন্ডলি হোক। পাঠকের মেধায়, মজ্জায়, সংস্কারে, পাঠদাঁড়ায় খানিক হিট করুক। প্লেটো সেই কোন্ কাকভোরেই শিল্পে ইমেজ-ডিপেন্ড্যান্সের এই দিকটা পয়েন্ট-আউট করে গেছেন। যাঁরা নিজেদের অ্যাবসার্ড, অ্যাবস্ট্রাক্ট লেখাপত্র নিয়ে ওমর জাহির করে তাঁদের জন্য দীপঙ্করের কোনো ছাড় নেই। তাঁর সাফ কথা হলো : অ্যাবস্ট্রাক্ট এক্সপ্রেশনিস্ট পেইন্টার জ্যাকসন পোলক ও আর্শাইল গোর্কির ছবির হার্ড-হিটিং ইফেক্টস্ আপনাদের নদী, পাহাড়, পাকদণ্ডী, জঙ্গল, পাখি, উচ্চিংড়ে, রেস্ট হাউজ, সানথালি নওকরানি, ক্যাম্পফায়ার, হ্যাশিস ও মালপাত্রের ইনানো-বিনানো ভার্বাটিম ইম্প্রেশনিজমের কাব্যভাবনাকে গুবলেট করে না; এবং আপনারা এই নিসর্গকে ধরতে চাইছেন ক্ল্যাসিকাল জিওমেট্রির লাইন, প্লেন, অ্যাংগল, স্ফিয়ার ও কোণ-এ। যা একান্তই রিপ্রেজেন্ট করে রিয়্যালিটির পাওয়ারফুল অ্যাবস্ট্রাকশন। কেননা মেঘ স্ফিয়ার নয়, পাহাড়রা শম্বুকাকৃতি নয়, আকাশের বিদ্যুৎ সরলরেখায় চমকায় না। অনাদিকাল থেকে পাখি-পড়ানো ঝিনুকে গেলানো শব্দের ঘিসাপিটা অর্থ ও আপনার কবিতার শব্দার্থের হরিহর আত্মা ক্রমাগত মেটান্যারেটিভসের জন্ম দিয়ে যাক সে কথা বলছি না। পতিত শব্দের উদ্ধার, শব্দ সৃজন, শব্দার্থ সৃজন, হাইব্রিডাইজেশন তথা একরৈখিক, যুক্তিগ্রাহ্য, আত্মজৈবনিক, ক্রোনোলজিক্যাল ন্যারেটিভের অবলুপ্তি এবং লেখক ও পাঠকের কনভেনশনাল, হায়ারার্কিয়্যাল রিলেশনশিপের পরিবর্তন শাসকশ্রেণীর এই দমন প্রক্রিয়াকে কাউন্টার করার এক অনন্যপায় প্রয়াস। যে কোনও ক্যাটেগরাইজেশনে গিয়ে না গিয়ে আপনার তসল্লি হয় হোক কিন্তু সিম্পটমগুলো নিঃসন্দেহে পোস্টমডার্নের। কিন্তু পাঠবস্তু যদি প্যাশনহীন হয়, প্যাশন ও চিন্তা উদ্রেককারী না হয় তো খ্যালা বেশি দূর এগোয় না। পাঠকবস্তুটিকে তখন খ্যামা দেওয়াটাই উচিত হয়ে দাঁড়ায়।’


তা, এই ব্যতিক্রমী কবির অনেক কথাই হলো। এবার পাঠকের পালা। যদিও এই বাবদ ধুয়ো ধরিয়ে দেওয়ার দায় মুখবন্ধ-লেখক এড়িয়ে যেতে পারে না। প্রশ্ন হলো : বাংলা সাহিত্যে প্রথা ভেঙে যেখানে কিছুই হতে চায় না, এবং বাঙালি পাঠকের পাঠাভ্যাস যেখানে এতখানি এঁদো যাঁরা প্রথাবিরুদ্ধ কিছু দেখলেই আঁতকে ওঠেন, সেখানে দীপঙ্করের এইসব তুককসরৎ কতখানি তাঁদের বাঁতে সইবে? অথবা,

যাঁরা মনে করেন ক্ষমতাকেন্দ্র প্রান্তকে বরদাস্ত করে না, নিজের ত্রিসীমানায় ঢুকতে দেয় না প্রান্তের লোকজনদের, অথবা আরও সরাসরি ভাবে যাঁদের খটকা লাগছে একজন ডায়াসপোরিক বঙ্গপুঙ্গব বাংলার মূল সাধনপীঠ থেকে দেড় হাজার মাইল দূরে বসে বাংলার জটধরা বস্তিলোমের ক'খানাই বা ছিঁড়তে পারবে, – তাঁদের তরে বলি, বিশ্বের সব ভাষাতেই নতুন ব্যাপার-স্যাপার গুলো এভাবেই একজন দিয়ে শুরু হয় এবং পরে যা সংখ্যায় বেড়ে গিয়ে ‘অনেক' হয়ে দাঁড়ায়। খোদ বাংলা কৃষ্টির পিলখানা, কলকাতায় বাঙালির সেই কঠিন-মূল্যের বাঙালিয়ানা' গুড়ের দরে বিক্রি হয়ে আজ কেবল ডায়াসপোরিকদের দাপাদাপি। কলকাতার অলিগলি রাস্তা রেলপার বাজারে আজ অবাঙালিদের বেশুমার দাপট। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রে ডায়াসপোরিকদের এলাকাদখল নতুন কিছু নয়। অতিপ্রাচীন আদি-অস্ত্রালদের সময় থেকে দ্রাবিড়, নর্ডিক, আলপিয় যে পারস্পরিক গলাবাজির রাজনীতি-প্রসূত আজকের বাংলা, তা আসলে অজস্র ডায়াসপোরিক হামলারই প্রতিফল। ১১ শতকের মাঝামাঝি পারিবারিক কলহের দরুন পালবংশ দুর্বল হয়ে পড়লে সুদূর কর্ণাটক থেকে এসে সেনবংশীয় অবাঙালি ক্ষত্রিয় ব্রাহ্মণরা বাঙলার মসনদ হাতিয়ে নেয়, সেটিই ছিল এ-ভূখণ্ডে একটি বড়সড় ডায়াসপোরিক হামলা। ১২০৪ খৃস্টাব্দে বখতিয়ার খিলজির আচমকা নদীয়া লুণ্ঠন ডায়াসপোরিক হাইব্রিডিটির সবচেয়ে তীব্র ঝাঁকুনি। আবার, ১৬৯৮-এর বর্ষায় ইংরেজরা মাত্র ১৬ হাজার টাকায় বাঙালি শেঠ বসাকদের ব্যবসাঘাঁটি কলকাতা, সুতানুটি আর গোবিন্দপুর গঞ্জের জমিদারি কিনে নিয়ে তাদের দুর্গ এবং শক্তিকেন্দ্র স্থাপনের পর ক্রমে ক্রমে সমগ্র বাঙলা-দখল করল, সেটা আরও-একটি বড় ঝঙ্কা। তারপর, ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন গুরুবার নদীয়া জেলার পলাশী গ্রামের আমবাগানের ধারে মাত্র ঘন্টা তিনেক সোর্ড খেলে তারা একই সঙ্গে ভেঙে দিয়েছিল বাঙলায় মুসলিম রাজত্বের বন্দে আর বাঙালির মসনদী গুমর। যদি ভাষার প্রসঙ্গে ফিরি, কাঁচড়াপাড়ার ঈশ্বর গুপ্ত, শৈশবে মায়ের দুধ আর যৌবনে স্ত্রীর বাঁট না পেয়ে যাঁর অন্তস্তল ধূসর হয়ে গিয়েছিল, গরিব প্রান্তিকের সেই বাছা যিনি ইংরিজি তো দূরস্থ ঠিকঠাক বাংলাও শেখার চান্স পাননি,— স্রেফ স্বীয় বুদ্ধিবলে এবং বাওয়ালি মেজাজের দরুন কলকাতার এলিট আর কৃষ্টিদেবতাদের ফলমণ্ডি তছনছ করে দিয়েছিলেন, তিনিই যে বাংলা ভাষায় প্রথম ডায়াসপোরিক লেখক কে আজ সেটা কবুল করবে?


কেউ যখন ভাষা দিয়ে ভাষার প্রথা বা সিস্টেম ভাঙতে নামেন, সর্বাগ্রে তাঁকে প্রথা বা শাসনগত ভাষাটির পালটা জবাবে নিজের 'নতুন' ভাষা তৈরি করতে হয়। ঈশ্বর গুপ্ত বা দীপঙ্কর দত্তরা শুরু থেকেই সজ্ঞানে যেটা করে থাকেন। আর, সেখানে কবিতা, অর্থাৎ চেতনা হল একটি মেধাসম্পন্ন আয়না। কে পরে টিঁকে থাকবেন, আর কে মাঝপথেই ধাবাড় মেরে যাবেন তার ফোরকাস্টিং নখদর্পণ। দীপঙ্কর দত্ত যদি ভেবে থাকেন এবং আশা করেন— যা তিনি লিখছেন, যেভাবে লিখছেন, অর্থাৎ তাঁর ভাষার নিজস্ব প্রস্তুতি, ধরতাই, যাবতীয় বিক্ষেপ, ভাবনার প্রতিটি প্যাঁচ এবং পটকে দেয়ার এনট্রপি একই ভাবে তা একদিন না একদিন অবশ্যই শিক্ষিত পাঠকের মগজে অভিঘাত দেবে, যা তাঁর অভিপ্রায়ের সমতুল, তাহলে তৃণমাত্র ভুল ভাবছেন না।