মল্লিকা ব্যানার্জী ও দেবাশিস ব্যানার্জী



লাদাখ সফর












[[For Photo Album , Click Here : https://photos.app.goo.gl/UDYM5fjgqRs6Cv4B8 ]]




সেই বিয়ের বছর থেকেই আমরা কাশ্মীর ঘুরতে যাবার প্ল্যান করছি অথচ কোনো না কোনো কারনে যাওয়া তা রদ হয়ে গ্যাছে। দেবাশীষ অবশ্য অফিসের কাজের অছিলায় কাশ্মীর এবং সংলগ্ন লাদাখ দুটোই ঘুরে এসেছিল! সঙ্গে নিয়ে এসেছিল অনেক ছবি, গল্প আর স্মৃতি। ছবিগুলোতে যা সবথেকে চোখ টেনেছিল তা ছিল অসম্ভব নীল আকাশ। দেবাশীষ তখন বলেছিল তোমাকেও নিশ্চয় একবার ঘুরিয়ে নিয়ে আসবো। আমি অবশ্য প্রস্তাবটা শোনার পর থেকে একটু দোলাচলে ছিলাম কারন পাহাড়ে আমার খুব ভয়, কি জানি কেন? যাই হোক, দেবাশীষের প্রথমবার লাদাখ যাবার ঠিক দশ বছর পর আমাদের দুজনের মনে হল - নাহ আর দেরি করা উচিত হবে না…বয়সও বেড়ে চলেছে, এর পর গেলে এঞ্জয় করতে পারা যাবে না। আমাদের দুজনের কাজকর্মের হিসেব কিতেব নিয়ে দেখা গ্যালো যে অগাস্ট মাসে কটা ছুটি পাওয়া যাচ্ছে, তার সঙ্গে শনি/রবিবার গুলো জুড়ে দিলে প্রায় দিন দশেক হাতে পাওয়া যাচ্ছে...তাই নিয়ে আমাদের লাদাখটা মোটামুটি আরাম করে ঘোরা হয়ে যাবে। অগত্যা ১৭ থেকে ২৭এ অগাস্ট অবধি আমরা স্থির করলাম লাদাখ ভ্রমণ করব।




[[For Photo Album , Click Here : https://photos.app.goo.gl/UDYM5fjgqRs6Cv4B8 ]]







আগের দিন রাত অবধি গোছগাছ করা চলল। যদিও নেট থেকে জানতে পারছিলাম ওখানে সে সময়ে একদমই ঠান্ডা নেই তবু সকলে ভয় দেখাল যে যদি একটুও বৃষ্টি পড়ে তাহলে হুট করে ঠান্ডা পড়ে যাবে। তাই আমাদের দুজনেরই শীতের জ্যাকেট দুটো নেওয়া হোল। এছাড়া টুপি, শাল, স্টোল ইত্যাদি সবই নেওয়া হল। পরদিন সকাল সাড়ে ছটার ফ্লাইট ছিল তাই ভোর সাড়ে তিনটেয় উঠে কল-ক্যাব বুক করে আমরা এয়ারপোর্ট রওনা দিলাম।









যথা সময়ে ফ্লাইট ছাড়ল, দিল্লির আকাশের তখন মুখ থম্থম করছে। এবারে দিল্লিতে ভালই বর্ষা হয়েছে। গত পুরো মাসটাই প্রায় দিল্লিতে রোদ ওঠেনি। মনের মধ্যে প্রায় একরকম ভয় নিয়েই ফ্লাইটে উঠেছিলাম যে লেহ তে গিয়ে যেন বৃষ্টি না পাই। কিন্তু আমাদের ভয় অমূলক। লেহ তে ফ্লাইট থামতে দেখলাম একদম ঝকঝকে মুখ নিয়ে আকাশ হাসছে যেন আমাদের আপ্যায়নে পুরোপুরি প্রস্তুত। 


লেহ এর এয়ারপোর্ট টা এক্টু অন্য রকমের। এয়ারপোর্ট এর এডমিনিস্ট্রেশন ভারতীয় সেনার হাতে। এখানে আসার আগে জানতাম না যে এখানে জম্মু বা কাশ্মীর ছাড়া অন্য কোন প্রদেশের গাড়ি ভাড়া নিয়ে আসা যায় না। নিজের গাড়ি হলে সমস্যা নেই। এছাড়া কিছু কিছু জায়গা ঘোরার জন্য হয় আধার কার্ড নয় পাসপোর্ট সঙ্গে থাকা জরুরী। যাই হোক এয়ারপোর্ট এর প্রসঙ্গে ফিরে আসি। এয়ারপোর্ট টা খুবই ছোটো। এয়ারক্রাফট থেকে নেমে যখন বাসে ওঠার অপেক্ষা করছি তখনই কেমন যেন মনে হচ্ছে মাথাটা টাল খাচ্ছে। রানওয়ে থেকে লাউঞ্জ বাসে করে পৌঁছতে ঠিক দেড় মিনিট সময় লাগল। লাউঞ্জে পৌঁছে দেখি ক্রমাগত উদঘোষণা হচ্ছে যে যারা নতুন লেহ তে এসেছেন ভৌগোলিক উচ্চতার জন্য তাদের কি কি অসুবিধে হতে পারে, কি তার লক্ষণ আর তার জন্য কি কি করণীয়। আমার ওই একটু মাথা টলছিল আর একটু কেমন কনফিউশন মত হচ্ছিল। পরে জানলাম সেটাও নাকি অল্টিটিউড সিকনেস মানে ভৌগোলিক উচ্চতা জনিত অসুবিধে।







[[For Photo Album , Click Here : https://photos.app.goo.gl/UDYM5fjgqRs6Cv4B8 ]]




আমাদের লেহ তে ঘোরার জন্য গাড়ি এবং অন্যান্য ব্যাবস্থা সমস্ত দেবাশীষই দিল্লি থেকে ঠিক করে গিয়েছিল। অগত্যা একটু পরেই ড্রাইভারের ফোন এল যে সে বাইরে অপেক্ষা করছে, সেই সঙ্গে গাড়ির নাম্বারটা জানিয়ে দিল। গাড়িতে বসার পর একটু স্বস্তি পেলাম আর তখন চার পাশ সম্বন্ধে একটু অবহিত হলাম। আহা কি অপুর্ব নীল আকাশ আর তাতে নির্ভার সাদা মেঘ কি সুন্দর নীলের শোভা বাড়াচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে আমার আমার বাবা আর দেবাশীষের ওর মায়ের কথা মনে পড়ে গ্যালো। দুজনেই ওদের জন্য একটু ভিডিও রেকর্ড করে নিলুম…স্মার্ট ফোনের এটাই তো সুবিধে।


অল্প সময়েই আমরা আমাদের হোটেল – থ্রি রোজ-এ পৌঁছে গেলাম। হোটেল টা ছোট্ট, সুন্দর, ছিমছাম ।









হোটেলে বেশ সুন্দর একটা ঘর পেলাম। সাধারণত আজকাল প্রাকৃতিক বৈশিষ্টের ভ্রমন কেন্দ্র গুলোতে হোটেলের ঘর গুলোর একটা দেয়ালে শুধু কাঁচের জানলা দেওয়া থাকে যাতে বাইরের মনোরম প্রকৃতি কে ঘরে বসেই উপভোগ করা যায়, এই ঘরটাতেও সেরকম ব্যাবস্থাই ছিল। জানলার পাশেই দুটো চেয়ার আর চায়ের টেবিল, উদ্দেশ্য, চা খাও আর বাইরের বরফে ঢাকা পাহাড়ে রোদের খেলা উপভোগ কর। তা সে  দিন টা সারাদিন তাই করার কথা, তাই লক্ষ্মী ছেলের মত দেবাশীষ তাই করল; আমার অবশ্য এটাই করা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। আসলে লেহ তে ঘোরার প্রথম নিয়মই হল একটা গোটা দিন শুধু শুয়ে কাটানো আর এই ভৌগোলিক উচ্চতার জন্য আবোহাওয়াতে যে কম অক্সিজেনের মাত্রা সেটার সঙ্গে শরীরে খাপ খাইয়ে নেওয়া। আমাদের দুই ভাই বোনেরই অল্প বিস্তর হাঁপানির সমস্যা আছে তাই ভাই বলে দিয়েছিল দিদি তুই একদিন নয় দুদিন শুয়ে বসে কাটালে, পরে খুব ভালো এঞ্জয় করতে পারবি। এই বয়সে ছোট ভাই-এর দিদির প্রতি দরদ টের পেলে এখনো চোখের কোন চিকচিক করে ওঠে বটে কিন্তু টিকিটী তো বরের পায়ের বুড়ো আঙ্গুলের সঙ্গে বাঁধা, অগত্যা কর্তার ইচ্ছাতেই যে চলব সে কথা আর ভাই কে বললাম না। প্রথম দিন রাতের দিকে গিয়ে মাথা টলটল করা বন্ধ হয়ে গেল কিন্তু হাল্কা করে হাঁপানির সমস্যা শুরু হয়ে গেল। তবে তার জন্য ইনহেলার নিয়ে গিয়েছিলাম তাই সেরকম সমস্যা হলনা। অল্টিটিউড সিকনেসের জন্য ডায়ামক্স বলে একটা ওষুধ আছে ওটাও রোজই খেতে হয়েছে যার জন্য মোটামুটি সব ঠীক ছিল।






[[For Photo Album , Click Here : https://photos.app.goo.gl/UDYM5fjgqRs6Cv4B8 ]]







পরদিন সকাল থেকে ঘোরাঘুরির প্ল্যান ছিল। সকালে উঠে দেবাশীষ একটা বড় ফ্লাস্ক ভর্তি করে ফুটন্ত গরম জল আনিয়ে নিল। তাইতে বাড়ি থেকে নিয়ে যাওয়া দারচিনি দেওয়া দার্জিলিং চা পাতা দিয়ে চা করে, সামনের পাহাড়ের চুড়োয় রোদের রঙ লাল থেকে, কমলা থেকে হলুদ হয়ে ওঠা দেখতে দেখতে আয়েস করে দু জনে দু কাপ করে চা খাওয়া হলো। এরপর গরম জলে স্নান সেরে আমরা হোটেলের খাবার ঘরে প্রাতঃরাশ সারতে গেলাম। পাঁচ তারা হোটেলের কিছু কিছু ব্যাবস্থা আজকাল তিনতারা হোটেল গুলোতেও পাওয়া যায়, যেমন ধরুন কোথাও সকালের প্রাতঃরাশ, কোথাও ঘরে ইলেক্ট্রিক কেটল ইত্যাদি! এখানে ঘরে ইলেক্ট্রিক কেটল দেওয়া ছিল না কিন্তু ঘার ভাড়ায় প্রাতঃরাশ এবং রাতের খাওয়া ধরা ছিল। তবে হ্যাঁ খাবারে পদ গুলোতে তেমন রকমারি কিছু ছিলনা। সকালে আলুর পরোটা, চিঁড়ের পোলাও, পাউরুটির টোস্ট আর কর্নফ্লেক্স দুধ, আবার রাতের খাবারে রাজমা, বা ছোলা, পনীরের তরকারী, একটা পাঁচ মিশেলী তরকারি আর রুটি বা ভাত। এখানে একটা কথা জানলাম যে লাদাখ পুরোপুরি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বি বলে সব জায়গায় আমিষ রান্না পাওয়া যায় না। এখানেও আমিষ কমই ছিল একটা পদ একটু দূরে ব্রাত্যের মত সরিয়ে রাখা থাকত, হয় ডিমের ডালনা নয় মুরগীর ঝোল। এখানে আরো একটা জিনিস নজরে এল...সেটা হোলো হোটেলের কর্মচারীরা কেউ লাদাখী নয় বরং সুদুর উত্তরপ্রদেশ থেকে এসেছে, যার ফলে রান্নাবান্না সবই উত্তর ভারতীয়, একটা পদও লাদাখী শৈলীর নয়। ফলে বেড়াতে আসা লোকগুলোর খাওয়া দাওয়া বা ভাষার দিক দিয়ে কোনো অসুবিধেই হয়না। পুরো লাদাখেই ব্যাবস্থাটা এমনই তাই লাদাখী রান্নার আস্বাদ আমরা একেবারেই কোথাও পেলামনা। 









[[For Photo Album , Click Here : https://photos.app.goo.gl/UDYM5fjgqRs6Cv4B8 ]]




ফিরে আসি দ্বিতীয় দিনের কথায়। ব্রেকফাস্ট সেরে আমরা গাড়িতে উঠে পড়লাম। সে দিন সারাদিন লেহ শহরেই ঘোরার কথা। প্রথমেই গেলাম শান্তি স্তুপে। এটা চান্সপা নামের একটা পাহাড়ের চুড়োয় ১৯৯১ সালে জাপানী বৌদ্ধ ভিক্ষু গ্যোমো নাকামুরা এবং পীস প্যাগোডা নামে এক সংগঠনের তৈরী একটা বৌদ্ধ স্তুপ। ১১৮৪১ ফীট উচ্চতায় তৈরী এই স্তুপে বুদ্ধের এক বিশাল সোনালী মুর্তি আছে এছাড়া আছে অসীম শান্তি। চারপাশটা অদ্ভুত রিক্ততা মাখা সৌন্দর্য। রিক্ত, কেন না লাদাখের পাহাড়ে সবুজের একটুও ছোঁয়া নেই। শান্তি স্তুপের সৌকর্‍্য ছাড়া এ জায়গার অন্যতম আকর্ষণ হল পাহাড়ের ওপর থেকে নীচে পুরো লেহ শহরটা দেখতে পাওয়া আর চারপাশের প্যানোরামিক দৃশ্য। এখানে চুপ করে খানিকক্ষণ বসে রওনা দিলাম আমাদের পরের দ্রষ্টব্যের দিকে। এবার যাব লেহ প্যালেস।






[[For Photo Album , Click Here : https://photos.app.goo.gl/UDYM5fjgqRs6Cv4B8 ]]




লেহ শহরের সব দিক দিয়ে লেহ প্যালেস টা দেখা যায়। মেটে রঙের প্রাসাদটি বাইরে দেখে দেখতে খুব একটা আকর্ষনীয় লাগছিল না। তবে লাদাখ পর্বতমালার গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়ানো ইমারতটি ৯ তলার একটী প্রাসাদ। আমার না একটা ব্যাপারে বেশ একটু আপত্তি হচ্ছিল। একে তো ভাই পাহাড় চুড়োয় বাড়ি কিন্তু লোকেদের তাতেও শান্তি নেই প্রত্যেকটা ইমারতে এতোগুলো করে সিঁড়ি কি করতেই হবে? কেনো রে বাবা! অশান্তি! তার ওঁপর আবার নয় তলা, বোঝ! প্রথম তলাটা উঠতেই হাঁপিয়ে গেলাম! দেবাশীষের অবশ্য সেই মুহুর্তে বয়স সাতাশ। টপ টপ করে সিঁড়ি গুলো লাফিয়ে উঠে গেল। আমি করুণ মুখে চাতালে বসে পাহাড় দেখতে লাগলাম। অদ্ভুত আবোহাওয়া। হাওয়াটা হিমেল, বেশ ঠান্ডা অথচ রোদ্দুরে গা পুড়ে যাচ্ছে। বসে বসে প্রাসাদটা সম্বন্ধে একটু পড়ে নিলাম সেটা আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করি। প্রাসাদটি তিব্বতের পোটালা প্রাসাদের আদলে তৈরী। ন’তলা প্রাসাদের নীচের তলা গুলো চাকর-বাকর, আস্তাবল, ভাঁড়ার ঘর ইত্যাদি কাজে ব্যাবহার করা হত। ওপরের তলা গুলোতে রাজপরিবারের লোকজনদের থাকার ব্যাবস্থা ছিল। প্রাসাদটি তৈরী করেন ১৬ই শতাব্দীর রাজা শেঙ্গে নামগেয়াল। ১৯ শতাব্দীর পুর্বার্ধে ডোগরা রাজা মহারাজ গুলাব সিং এর সেনাপতি জোরাবর সিং নামগেয়াল বংশের রাজাকে উৎখাত করে সেখানে ডোগরা শাসন জারী করেন। সাম্প্রতিক প্রাসাদটিতে আর্কিওলজিকাল সার্ভের তত্ত্বাবধানে সারাইএর কাজ চলছে। আমরা যে টুকু দেখতে পেলাম সে হল রাজপরিবারের সদস্যদের পুজো করার জন্য বিশেষ ভাবে তৈরি গোম্পা। আর আছে একটি মিউজিয়াম। সেখানে বিভিন্ন ধরনের অলঙ্কার, রাজ পরিবারের পরিধান, আর কিছু থাঙ্কা প্রাচীন পেন্টিং আছে যাতে লাদাখের রত্ন পাহাড়ের পাথর গুঁড়ো দিয়ে তৈরী করা রঙ ব্যাবহার করা হয়েছে। 


এসব দেখে এবার ফেরার পালা। বেলা খুব বেশী হয়নি কিন্তু এতো সিঁড়ি চড়ে নেমে আমি বেশ একটু ক্লান্ত দেবাশীষ কিন্তু একদম ফিট। ক্যামেরা নিয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। গাড়িতে বসলাম পরের দ্রষ্টব্যের দিকে যাব বলে। এবার যাব লেহ শহরের মধ্যে একটা প্রাচীন গোম্পা - শঙ্কর গোম্পা। অলিগলির মধ্যে দিয়ে এসে আমরা শঙ্কর গোম্পার সামনে দাঁড়ালুম। কিন্তু ভেতরে ঢুকে দেখলাম কোনো এক কারনে সেদিন গোম্পা বাইরের দর্শনার্থীদের জন্য বন্ধ। কি আর করা, বেরিয়ে এলাম! কিন্তু আমাদের ড্রাইভার টা আমাদের একটা মজার জিনিসের হদিস দিয়ে দিল। পাশেই একটা বাড়ি দেখিয়ে বলল এটা একটা প্রাইভেট মিউজিয়াম দেখে আসুন ভাল লাগবে। মিউজিয়ামটার নাম ‘রক অ্যান্ড মিনারাল মিউজিয়াম”। আমাদের কাছে ব্যাপারটা অভিনব মনে হল! খুব সাধারন একটা বাড়ি, সেটা কিনা একটা মিউজিয়াম! কিসের মিউজিয়াম! গেলাম। বাড়িটা সত্যিই একটা মধ্যবিত্ত পরিবারের বাড়ি মনে হল। কারুর সাড়া শব্দ পাওয়া যাচ্ছিল না, অথচ আমরা গিয়ে দাঁড়াতেই একটি মেয়ে ভেতর থেকে বেরিয়ে এল। টিকিট দিল মাথা পিছু পঞ্চাশ টাকা করে আর আমাদের মিউজিয়ামে ঢুকিয়ে দিয়ে চলে গেল। আমরা দুজনেই বেশ অবাক হলাম। যার বাড়ি তিনি নিজে সমস্ত কিছু সংগ্রহ করেছেন। মিউজিয়াম টা হল লেহ তে যে বিভিন্ন পাথরের পাহাড় পাওয়া যায় তার বিস্তীর্ণ বিবরণ ও পাথরের সংগ্রহ। দেখে ও পড়ে বুঝতে পারলাম লেহ এর পাহাড় গুলোতে কেন কোনো সবুজের ছোঁয়া নেই। আসলে মূল পাথরের পাহাড়ের ওপর মাটির কোনো আস্তরন নেই। খোলা আকাশের তলায় পাহাড়ের ওপর তীব্র হাওয়ার জন্য মাটি টেকেনা। আর শীতে তার ওপর বরফ পড়লে তাতে যেটুকু মাটির আস্তরণ পড়ে গরম কালে সূর্যের তাপে সেই বরফ গলা জলের তোড়ে ধুয়ে যায় সমস্ত মাটির আস্তরণ। তাই পাহাড় গুলো আবার হয়ে ওঠে নিরাবরণ, নিরাভরণ। কত রঙের পাথরের পাহাড়! নীল, সবুজ, লাল, হলুদ আর তাদের বিভিন্ন শেড। নীলা, পান্না, গোমেদ, রুবি, কোয়ার্টস, অভ্র, পোখরাজ আরো কত কি! সেই রত্নপাথরের সম্বন্ধে বিশদ তথ্য, পাথর সমেত ওই মিউজিয়ামে রাখা আছে। এছাড়া আরও একটা মজার জিনিস রাখা আছে, তা হল একটা ফসিল হয়ে যাওয়া ডাইনোসরাসের ডিম। ট্যাক্টোনিক প্লেট সরে যাবার ফলে হিমালয়ের আবির্ভাবে সে সময়কার ওই অঞ্চলে বসবাসকারী জন্তু জানোয়ারদের অবস্থিতির প্রমাণ স্বরুপ লেহ তে প্রচুর পরিমানে ফসিল পাওয়া যায়। ডাইনোসরাসের ডিম ছাড়াও অনেক শামুক এবং অন্যান্য জীবের ফসিল এই মিউজিউয়ামটিতে রাখা আছে । একটা খুবই ছোটো ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় তৈরী সামান্য এক আধটা টুরিস্টের টিকিটের ওপর নির্ভর করে একটা মিউজিয়াম চালাবার কথা যে কেউ ভাবতে পারে সেটাই আমার খুব ইন্সপায়ারিং লাগলো। এছাড়া লেহ সম্বন্ধে যা সব তথ্য জানলাম পরে ঘোরার সময়ে বুঝতে খুব সুবিধে হচ্ছিল। কিছু কিছু সময়ে আবার আপসোসও হচ্ছিল যে এই তথ্যগুলো যদি সঙ্গে করে নিয়ে আসতাম তাহলে মিলিয়ে মিলিয়ে পাথর গুলো আরো ভালো করে চিনে নিতে পারতাম। আপনাদের সবাইকেই বলব যদি লেহ তে যান এই মিউজিয়ামটা নিশ্চয়ই দেখে আসবেন। যাই হোক এবার বেরিয়ে দেখলাম বেশ খিদে পেয়ে গেছে। ঠিক করলাম মার্কেট থেকেই খেয়ে যাব। দেখে দেখে একটা ফাঁকা দোকানে বসলাম কিন্তু এখানে একটা ভালো সুারপ্রাইজ পেলাম। ওই রেস্টুরেন্টে আরো দুজন বসে ছিলেন। দেখি তারা বাঙালি। ব্যাস আমাদের আর পায় কে? এরকম একটা জায়গায় বাংলা বলার সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে আমাদের তো খুব মজা। এই দু জন মা ও মেয়ে লেহ ঘুরতে এসেছেন দেখে আমার তো ফিমেল ইগো দারুন ভাবে বুস্ট হল। মা-মেয়ের মিষ্টি সম্পর্ক্টা দেখেও খুব ভালো লাগল। মা একজন ডাক্তার এবং মেয়ে ডাক্তারি পড়ছে। খুব প্রানবন্ত খোলামেলা মানুষ। খাবার কথা ভুলে গিয়ে আমরা চুটিয়ে গল্প করছি এমন সময়ে আরেকটা চমক। ওয়েটার এসে পরিষ্কার বাংলায় জিজ্ঞেস করল কি খাবেন!আমরা দুজন দারুন উত্তেজিত হয়ে পড়লাম এই কোইন্সিডেন্সে! চিরকাল দিল্লিতে থেকে আমার যে এত মনে মনে বাঙালি প্রীতি আছে তা টের পেয়ে আমিও বেশ অবাকই হলাম। ওয়েটারটি দার্জিলিং এর ছেলে! তারও দুজন বাঙালি খদ্দের পেয়ে খুব মজা লাগছিল।  নিছক বাঙালি বলে বোধ হয় না, মানুষ দুটির সঙ্গে কথা বলে কেমন মনে হল কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমরা একটু একই ধরনের মানসিকতা রাখি তাই বোধ হয় একটু বেশীই ভালো লেগে যাচ্ছিল। যাই হোক খাওয়া দাওয়া সেরে বিদায় জানিয়ে আমরা যে যার হোটেলের দিকে পা বাড়ালাম! সে দিন আমি আর বের হইনি। তবে দেবাশিস বিকেলে বেরিয়ে লেহ এর রাজার পুরনো গোম্পা দেখতে গিয়েছিল।




[[For Photo Album , Click Here : https://photos.app.goo.gl/UDYM5fjgqRs6Cv4B8 ]]







তৃতীয় দিন সকালে আমরা তৈরী হলাম লেহ শহরের বাইরে লাদাখের বাকি দ্রষ্টব্যের দিকে পাড়ি দেবার জন্য। লাদ্দাখের কিছু অঞ্চল যেমন তুরতুক আর সুমোরিরিতে প্রবেশের জন্য আলাদা করে অনুমতি পত্র নিতে লাগে কারন, এর একটা হল পাকিস্তানের দিকের ভারত অন্যটা চীনের দিকের সীমান্ত। তো লেহ থেকে বেরোবার সময়ে এই অনুমতি পত্র গুলো নিয়ে, আর একটা অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে আমরা পাড়ি দিলাম একটা জাইলো গাড়িতে। গাড়ির ড্রাইভার একটা বাচ্ছা ছেলে, বাইশ তেইশ বছর বয়স হবে কিন্তু খুব ধৈর্য আর ক্রমশ বুঝেছিলাম খুবই পাকা ড্রাইভার। আমরা প্রথমেই এগোলাম খারদুংলা পাসের দিকে। তিব্বতী ভাষায় ‘লা’ কথাটার মানেই পাস। কিন্তু সাধারন লোকেরা সেটা বোঝে না, সকলেই খারদুংলা পাসই বলে। লাদ্দাখে বা সমগ্র ভারতেও এরকম একটা ধারনা আছে যে এখানেই পৃথিবীর সর্বোচ্চ মোটোরেবল রাস্তা আছে। কিন্তু পরে খোঁজ করে জানতে পারলাম যে ভারতের উত্তরাখন্ডের মানা গ্রামে রাস্তার উচ্চতা এর চেয়েও বেশী এমন কি লাদ্দাখেই নাথুলা পাসের উচ্চতা খারদুংলার চেয়ে বেশী এবং সেখানেও মোটোরেবল রাস্তা আছে। যাই হোক লেহ থেকে মাত্র ৪০ কিমি দূরে খারদুংলা পাসে যখন গিয়ে পৌঁছলাম তখন রোদ্দুরের তেজে চোখ খুলে তাকানো যাচ্ছেনা। চার পাশে বরফে ঢাকা পাহাড় থেকেও সূর্যের আলোর তেজ ঠিকরে উঠছে। সে এক অদ্ভুত অনুভুতি! চিরকাল সমতলে কাটানো মানুষ আমি কোনো জায়গা যে শুধু বরফে ঢাকা পাহাড় হতে পারে তা শুধু সিনেমা বা টিভির পর্দাতেই দেখেছি। বেশ কিছু অল্প বয়সী অ্যাডভেঞ্চার বিলাসী ছেলেমেয়ে মোটোর বাইকে চড়ে বেড়াতে এসেছে। তথাকথিত সর্বোচ্চ মোটোরেবল রাস্তায় বাইক চালিয়ে অন্যতম পাহাড়ের চুড়োয় পৌঁছে তাদের কী সে দাপাদাপি। এদিকে প্রচন্ড রোদ্দুরে যেমন চামড়া পুড়ে যাবার অনুভুতি হচ্ছে অন্যদিকে তেমনি ঠান্ডা বরফ ছোঁয়া হাওয়া হাড় হিম করে দিচ্ছে। এই অবস্থায় দেখলাম সেখানে ভারতীয় সেনার লোকেরাই টুরিস্টদের জায়গাটা সম্বন্ধে যাবতীয় তথ্য জানাচ্ছে। তাদেরই তত্ত্বাবধানে একটা মেডিকাল সেন্টারও আছে যেখানে টূরিস্টদের কম অক্সিজেনের জন্য শারীরিক অসুবিধে হলে পরিচর্‍্যা করার ব্যবস্থা আছে। যাই হোক আমরা দুজনে সকলের মতই ওখানে কিছু ছবি তুলে এগিয়ে পড়লাম। লেহ কে পেছনে ফেলে খারদুংলার পাশ দিয়ে ঠিক তার পেছনে গিয়ে পড়তেই দৃশ্যটা একটু পালটে গেল। ওদিকটা সূর্যের আলোয় সব কিছু যেমন চোখে খটখটে লাগছিল, পাহাড়টা বেড় দিয়ে পেছনে চলে আসতেই সূর্যের আলোটা এদিকটা নরম হয়ে গেল আর পাহাড়ের নিজস্ব রঙ গুলো ফুটে উঠল। এখান থেকে আমরা প্রায় ৬ ঘন্টা গাড়ীতে যাবার পর আমাদের গন্তব্যে পৌঁছবো। এখান থেকে আমাদের সঙ্গী হল লাদাখের অন্যতম নদী শ্যোক। শ্যোক নদীর উৎস হল সিয়াচীনের একটা অঙ্গ রীমো গ্লেসিয়ার। এখান থেকে বেরিয়ে নদীটা প্যাংগঙ্গ লেকের দিকে চলে যায় তারপর আবার অদ্ভুত ভাবে একটা বাঁক নিয়ে আগের চলন পথ ধরেই পাশাপাশি উলটো দিকে বয়ে যায়। খুবই অদ্ভুত! এই একই ভাবে সিয়াচীন গ্লেসিয়ারের আরেকটি নদী নুব্রাও নিজের চলন পথে দক্ষিন - পশ্চিম দিকে গিয়ে একটা বাঁক নিয়ে উত্তর-পুর্ব দিকে নিজের আগের খাতেরই পাশপাশি চলে। এটার কারন খুঁজে জানলাম নদীর বেসিনে এমন একটা খাঁজ আছে যার জন্য নদী টা নিজের খাতেরই উলটো দিকে বয়ে যায়। সমস্ত রাস্তাতে আমরা শ্যোক নদীকে পাশে পাশেই পেলাম। অবশেষে বিকেল পাঁচটা নাগাদ আমরা আমাদের গন্তব্য নুব্রা ভ্যালির ছোট্ট একটা গ্রামে পৌঁছলাম। গ্রামটা আমার চোখে তো যথেষ্ট বর্ধিষ্ণু, বেশীর ভাগ লোকই বড় বড় জমির মালিক আর সেই জমির ওপর টেন্ট লাগিয়ে ক্যাম্পিং এর ব্যাবস্থা করে ট্যুরিজ্‌ম এর ব্যাবসা চালাচ্ছে। এরকমই একটা ক্যাম্পে আমরা গিয়ে উঠলাম। গাড়ি থেকে নেমে চার পাশটা দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল। চার দিক দিয়ে পাহাড়ে ঘেরা এক টুকড়ো জমির ওপর আমাদের ক্যাম্প। তখন সূর্যাস্ত্যের সময়। পাহাড়ের পেছনে সূর্যাস্ত্যের রঙে চোবানো আকাশটা পাগোল করে দিলো। সামনে দেখলাম সার দিয়ে গোটা দশ বারোটা তাঁবু প্রায় সব কটাই সে মুহুর্তে খালি, তবে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম যে কিছুক্ষনের মধ্যেই একটা বড় পার্টি এসে পৌঁছবে। যাই হোক, নির্দিষ্ট টেন্টে ঢুকে জিনিস পত্র রেখে একটু সুস্থির হয়ে বসলাম। টেন্টের ভেতরে খুবই সুন্দর ব্যাবস্থা। খাট, বিছানা, সঙ্গে স্নানঘর সবই ছিমছাম। হাত মুখ ধুয়ে বাইরে বসে চা খেতে খেতে পাহাড়ের পেছনে অস্তগামী সূর্যকে সেদিনের মত বিদায় জানিয়ে রাতের তারাদের জন্য আসর পাতলাম।








[ক্রমশঃ]