রুণা বন্দ্যোপাধ্যায় ও প্রণব কুমার দে
লেখক / সংকলক : iPatrika Crawler
অব্যক্ত
উৎস সন্ধানে
রুণা বন্দ্যোপাধ্যায় ও প্রণব কুমার দে
সন্ধানে। জগৎকে সর্ব দিশায় দেখতে পান যে বিজ্ঞানী, তাঁর খোঁজ সেই উৎসের, ঊর্ধমুখী উৎ-লোকের
বার্তাবাহক সেই উৎস, যেখানে উত্থিত বস্তু বা বিষয় তার
প্রথম স্বরূপ পায়। মানুষের
সমস্ত সৃজনই তো উৎ-লোকে উত্তরণ, সমস্ত উচ্চারণই
উৎ-ক্রিয়া,
যা ওপরদিকে ওঠে। এই স্বরূপের সন্ধানেই পাহাড়ু প্রণব কুমার
দে এবার চলেছেন নদী নিয়ে তাঁর নিজস্ব
জার্নির লক্ষ্যে, মনের উদ্লোকে থাকা বিশেষ দিশায় চলেছেন এক স্রষ্টা; সৃষ্টিলোকে নির্মিত
হচ্ছে আলোকচিত্র, মনের মণিকোঠার সেই জানালা (‘entrance of knowledge’ দিয়ে আসা আলোয়
রচিত হচ্ছে বিষয়বস্তুর জনন সংবাদ, যে জানান দেয় তার স্বরূপ। এই চিত্র বহিরাবয়ব অবলোকনের
কথা বলে না, বলে আলোকনের কথা, বস্তুর ওপর অর্জিত জ্ঞানের আলো ফেলে তার অন্তর্নিহিত
ক্রিয়ার দর্শন। এ শুধু চোখের চেখে দেখা দর্শন নয়, দর্শন
করে স্রষ্টার অক্ষি, যে দ্রষ্টাকে ব্যাপ্ত করে, দর্শনেন্দ্রিয়কে বহির্জগতে
প্রসারিত করে। শুধু বিজ্ঞানীই নয় অভিজ্ঞতা বহনকারী
কব্যবাহক কবিও নদীর ঘরে ফেরার কথা বলেন, “সব পাখি ঘরে আসে— সব নদী— ফুরায় এ-জীবনের
সব লেনদেন;/থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন”। কবির এ নয়ন কেবলমাত্র বস্তুজগৎকে মানসলোকে আ-নয়ন করে না, বস্তুর
চয়নেচ্ছায় পরতে পরতে মিশিয়ে দেয় দ্রষ্টা সত্তার কল্পনা ও ভালোবাসা, জীবন সম্পর্কে
তাঁর মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গি। যেকোনো বস্তু থেকে বিচ্ছুরিত আলোকশক্তি সর্বদিগগামী।
বস্তুর এই নিজেকে দেখানোর সতত চেষ্টা, দৃষ্ট হবার আশাই তাকে দৃশ্য করে তোলে।
কিন্তু দৃশ্য থাকলেই তা দৃষ্ট হয়ে ওঠে না। মাঝখানে থাকে সেই দ্রষ্টা, সেই স্রষ্টা,
যাঁর দৃষ্টিশক্তি দ্রষ্টব্য বস্তুর এই সার্বিক বিচ্ছুরণের সমস্ত কিরণরেখাগুলো
ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখে, চোখ ফেরায় প্রতিটি দিকের অন্তে, দিগন্ত জুড়ে গড়ে তোলে তার
দিকচক্র। প্রণবের এই নদীকেন্দ্রিক জার্নিতে তাঁর প্রসারিত
চেতনায় নির্ণীত দিকজ্ঞানে নদীসত্তার সার্বিক আলোকবিচ্ছুরণ বর্ত্তিকার আলোর মতো তাঁর
দ্রষ্টা সত্তার মানসলোকে টঙ্কারিত হয়েছে, অভিজ্ঞতার জ্ঞানালোকে আলোকিত করেছেন নদীর
অন্তরমহল। তাঁর মননশীল সত্তার ভাবনা, অভিরুচি, ইচ্ছা ও কল্পনার রঙে রেখায় রসে নদীর
মূর্তরূপ অরূপ হয়ে ধরা দিয়েছে অপরূপে─
It’s
dark,
the
world of unknown.
It’s
blank,
the
world of silence.
Its
form is emanating from
the
heart of formless,
resting
within bound
to
soar into boundless.
নদীর
এই অপরূপের সন্ধান আমাকে প্ররোচনা দিচ্ছে নদীর নির্ঝরধারায় মানুষের জীবনচর্চার সেই শেকড় সন্ধানে, যার অন্দরমহলে বাজছে বর্তমান যুগের সোশ্যাল রিয়েলিজমের স্বপ্ন।
খোঁজ করছি সেই স্বপ্নের আদিমতম বাস্তব রূপ, যে তার স্বরূপ দেখেছিল প্রাচীন ভারতের
যৌথসমাজে, যেখানে সাম্যবাদী পরিচালনায় অবচেতনভাবে কাজ করত মানুষের নিজস্ব
স্বাভাবিক বিশুদ্ধির নীতি, চিরন্তন মানবিক জীবননীতি, যা মানুষের স্বভাবের মধ্যেই
বিদ্যমান। নদীর এই চলমান ধারাই ধারণ করে সেই মানবসভ্যতা, যার সৃষ্টির মূলে জল, জট্ ক্রিয়ামূলে জাত জননকারী সত্তা, সেই
জন্যগণ যেখানে জট পাকিয়ে, সংহত হয়ে নিজেদের অস্তিত্ব প্রকাশ করে, যেখানে আদিম
যূথবদ্ধতার দ্যোতনা। তাই বুঝি জলের আরেক নাম জীবন, যৌথ জীবন ও যাপনের ভূতাত্ত্বিক উপাদান।
এমনকী মানুষ তার মৃত্যুর পরেও
পঞ্চভূতে তৈরি দেহের দহনশেষে অবশিষ্টাংশ নদীর বুকেই অর্পণ ক'রে নিজেকে লীন করে
দেয়। এই নদীকে কেন্দ্র করেই বানরের যূথচারিতা থেকে আদিম মানুষ যূথবদ্ধতায় উন্নীত
হয়েছিল। সেই যূথবদ্ধতা ছিল বর্তমানের বহুকাঙ্ক্ষিত উত্তর-অধুনান্তিকতার ঐক্যমূলক
সভ্যতার আদি স্বরূপ। ক্রমাগত বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে মানুষ গড়ে তুলেছিল আদিম
সাম্যবাদী সমাজ, যেখানে কোনো ঈশ্বর ছিল না, পুজো ছিল না, ছিল ঈশিত্বকে বরণ করে
নেওয়ার রেওয়াজ। বস্তু বা বিষয়ের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ এই ত্রিকাল দর্শন ক'রে নিজের
কাজে লাগাতে পারে, এমন যেকোনো উদ্ভাবক বা আবিষ্কারক, যাঁর বৈদিক নাম শিবসত্তা,
তিনিই ঈশিত্বের অধিকারী। এ হল জ্ঞান ও কর্মের যোগসাধন, থিয়োরি
ও প্র্যাকটিস যোগে উদ্ভাবন। তাত্ত্বিকভাবে কোনো সত্যে
পৌঁছে সত্যলাভই জ্ঞানযোগীর মোক্ষলাভ আর জ্ঞানযোগীর থেকে সত্যজ্ঞান আহরণ ক'রে কর্মে
প্রয়োগ ক'রে সেই কর্মফল লাভই কর্মযোগীর মোক্ষলাভ। জগতের সমস্ত সৃষ্টি একই সৃষ্টিধারার অজস্র আনন্দময় রূপ।
জ্ঞানযোগী মর্তচোখ দুটি বন্ধ করে জগতের অন্তরঙ্গ রূপটি দেখেন তৃতীয় নয়ন মেলে,
মানসলোকের স্বর্গে নির্মিত হয়
মানসচিত্র। কর্মযোগী তাঁর যান্ত্রিক দুটি মর্তচোখে জগতের বহিরঙ্গ দেখেন এই
মর্তলোকে। মানসলোকের স্বর্গে নির্মিত
মানসচিত্রে থাকে প্রাচ্য দর্শনের আঁজ্ঞা চক্র, যা আমাদের মনকে নির্দেশ দেয় বোধের
নতুনায়নে, পাশ্চাত্য দর্শনে ভিটগেনস্টাইনের ভাষায় spatial activity, দিশাগ্রস্ত পরিসরে সেই দর্শন ক্রিয়া, যা প্রসারিত চেতনায় পুরোনো
বিষয় বা বস্তুকে অন্যভাবে নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে, বৈজ্ঞানিক দর্শনের mental
lens, সেই উপনেত্র(spectacle) যা ঊর্ধলোকে উত্তরণের ইশারা দেয়, বৌদ্ধ জেন দর্শনের সেই
প্রজ্ঞা(wisdom), স্বজ্ঞালব্ধ জ্ঞানের আলোয় অন্বেষণ। জ্ঞানযোগীর মানসচিত্র যখন কর্মযোগীর
প্রয়োগে মর্ত্যলোকে নির্মাণ পায়, মানসলোকের সৃষ্টিধারা মর্ত্যলোকের নির্ঝরধারায় প্রবাহিত
হয়, মানুষের জগৎদর্শন সম্পর্ণতা পায়। তাই জ্ঞানের অভিযাত্রী প্রণব চলেছেন সেই নদীধারার
উৎস সন্ধানে, পায়ে তাঁর চলনমন্ত্র, চয়নেচ্ছু গামীর লালন পায় যে ক্রিয়া, সেই মানসিক
চয়নেচ্ছায় ও গ্রহণেচ্ছায় চরে বেড়ানো সত্তা। এই মানসিক চয়ন অভিজ্ঞতার ভাণ্ডারে ধারণ
করে বিষয়টিকে করে তোলেন বিশেষ, চারিয়ে দেন আপন আলোকচিত্রে। ফলত ক্যামেরার যান্ত্রিক
চোখের কর্মাবলী আপন অন্তরের জ্ঞানালোকে উদ্ভাসিত হয়ে রচনা করেছে নদীর নতুন পাঠ, যেখানে
জ্ঞানী ও কর্মীর মধ্যে বিভাজন নেই। একদিকে আত্মমগ্ন ব্রহ্মজ্ঞানী শিবসত্তা তার উদ্ভাবিত ব্রহ্মজ্ঞান(knowledge)
সার্বজনীন করার চেষ্টা করছে, অপরদিকে শিবপ্রেমী দক্ষসত্তা সেই ব্রহ্মজ্ঞান বিশেষভাবে
বহন করার স্পেশালাইজেশনের কাজ করছে। এই জ্ঞান ও কর্মের সম্পর্কায়ন
থাকে শিল্পীর সৃষ্টিতে। একদিকে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের উদ্দাম
উল্লাসে, আপন অনুভব, জ্ঞান, যুক্তি ও কল্পনার নতুনতর বৈচিত্র্যে শিল্পীর আত্মজ্ঞানের
বিকাশ আর অন্যদিকে পরিপার্শ্বের সতত পরিবর্তনশীল জগতের
সঙ্গে নিজস্ব অভিজ্ঞতার নিরন্তর মিথস্ক্রিয়ার প্রয়োগ তাঁর নির্মাণে। প্রণব তথাকথিত
ঈশ্বরবিশ্বাসী নন, বরং ব্যক্তিমানুষের চেতনায় যার বাস, সেই অন্তরতম সত্তার প্রকাশ তাঁর সৃষ্টিতে, তাঁর আলোকচিত্র খোঁজ করেছে সেই
বিশ্বজগৎ, সেই মানবাত্মা, যেখানে আপন আত্মার পূর্ণ বিকাশ, মানবাত্মার
পূর্ণস্বরূপের প্রকাশ─
I am not humble
but hum(a)ble my dear god
to negate your sniffing
dog-ma.
I am-god to create
my own dogma
of my
spiritual feelings,
not spirit, not
ritual, but spi-ritual
to communicate
serially
from the
periphery of my I
to the center of
I (a)am
that not only grows on a tree
but also in our unity.
মানবসভ্যতার এই সার্বজনীন সৃষ্টিধারার শেকড় ছিল ভারতের সনাতন
যৌথসমাজে, যা বৈদিক যুগের বহুপূর্বেই গড়ে উঠেছিল। সে সমাজে কোনো পণ্য ছিল না,
বিনিময় ছিল না, ছিল ক্রমাগত উৎকর্ষ সাধনায় গড়ে তোলা সাম্যবাদ, যা পূর্ববিধান
স্বীকার করে, তার অক্ষমতাগুলো আপন স্বাধীন উদ্ভাবন দিয়ে সংশোধন করে এবং নতুন বিধান
গড়ে তোলে। এ কোনো আইন নয়, বরং আবেগের বন্ধনে নিজেদের বেঁধে রেখেছিল মানুষের আদিম পূর্বপুরুষ,
সেই এশিয় হোমিনিডের মানবসভ্যতা। গড়ে উঠেছিল প্রাচীন ভারতের সনাতন ধর্ম, যা বর্তমানের
তথাকথিত ধর্ম বা রিলিজিয়ান নয়, বরং আপন অস্তিত্বকে সম্ভব করে তোলা বা
ধরে রাখার জন্য করণীয় কার্য্যাবলী। অ্যাডভেঞ্চারিস্ট প্রণব তথাকথিত ধর্মবিশ্বাসী নন,
বরং সেই কর্মের ধর্মবিশ্বাসী, যেখানে আত্মানং বিদ্ধি’র মন্ত্র, সমাজের চোখ দিয়ে, মানুষে
মানুষে সম্পর্ক ও ভালোবাসা দিয়ে নিজেকে জানার মন্ত্রণা। সামাজিক, কাব্যিক সম্পর্কের
গ্রন্থিগুলো জুড়েই রচিত হয় সম্পর্কের জাল, যেখানে আবদ্ধ থাকে মানবসমাজ, পরিবার, গোষ্ঠী
বা সংগঠনের সদস্যরা, আর সেই জালে প্রবাহিত হয় পূর্বসূরিগণের অর্জিত জ্ঞানসম্পদ, শিল্পশৈলীর
সম্পদ। প্রণব, প্রকৃষ্ট নব যাতে, এ সেই সত্তা যে নেতি নেতি করে বদ্ধধারার না-করণ করে
মুক্তধারার হ্যাঁ-করণ করে, এ সেই শিল্পী যিনি বর্তমানের গ্রন্থিতে ধরা পূর্বসূরির অর্জনকে
নিয়ে যান এক নতুন উত্তর-গ্রন্থির জোড়ের গ্রন্ধনে। শিল্পের প্রচলিত সংজ্ঞাগুলো আপন সত্তার
বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাসে ভেঙে ফেলেন, যার তরঙ্গ সম্পর্কের জালে বাহিত হয়ে অন্যদেরও প্ররোচিত
করে, সীমা অতিক্রম করে উত্তীর্ণ হন অসীমে, সকলের সঙ্গে অবারিত যোগে, সার্বিকতায়।
এই
স্বভাবত বিকশিত ঐক্যমূলক সার্বিকতার বোধই পুরাণকথিত মহান বা মহ, প্রকৃতির প্রথম বিকাশ।
মহ একটা বোধ, ‘আমরা-সবাই’, কেন্দ্রিকরণ বিরোধী এক প্রক্রিয়া, decentering, যা মানবসমাজকে
‘আমরা-সবাই’ এই সার্বিকতা বোধে উন্নীত করে। এই মহ(moho)ই homo, যা থেকে
homo-sapiens, পরবর্তী বিবর্তনের ধারায় জন্ম দেয় মনুঃ ─ মন্-উঃ(man-uh><hu-man), যে তার স্বাভাবিক মানবিক
প্রবৃত্তিতে আমূল পরিবর্তনকারী মন’কে অস্তিত্বের পরিধির বাইরে উল্লম্ফনে প্ররোচনা দেয়।
সেই মানুষই তো human being হয়ে ওঠে। এই ‘হয়ে ওঠা’ই মনুঃর গোড়ার কথা, অনির্দিষ্ট মন
থেকে সুনির্দিষ্ট মনের হয়ে ওঠা, তারপর আবার নিজেকে নিজের ছাড়িয়ে যাওয়া, আপন কর্মে,
আপন শিল্পে, চিন্তায়, ভাবনায়, নদীর মতো কেবলই সমুদ্রপানে চলা, কেবলই সমুদ্র হতে থাকা─
Moho shifts I to
we
to give the
meaning to life
but Homo shifts man
to god
who reshapes our
dream with a deal
to place
the reality into imagination
not to flourish
the immortal being
but to perish his
mortal godness
in the name of
divinity.
Reality is what
we choose,
how we measure it
to achieve our
own divinity
in our process of
becoming.
ভারতীয়
নদীর উৎস সন্ধানে থাকে ভারতীয় ঋর্ষির মানসলোকের খোঁজ, কীভাবে মানসলোকের জ্ঞানতত্ত্ব
মর্তলোকে মানস সরোবরের ভূতত্ব হয়ে উঠল, কীভাবে জগতের সৃষ্টিসূত্রে গ্রন্থিত হয়েছিল
মানুষের সামাজিক চলনমন্ত্র, যার গুঞ্জন ওঠে চলমান নদীপ্রবাহে। এই নদীসত্তায় আমাদের বিশ্বজগৎ ও চলমান
জীবনপ্রবাহের সত্তাকে যেমন আবিষ্কার করেছিলেন
পাশ্চাত্যের গ্রীক দার্শনিক হেরাক্লিটাস তাঁর Universal flux এর সূ্ত্রে, “On those stepping into rivers staying the same other and
other waters flow” ঠিক তেমনি প্রাচ্যের ঋষি জন্ম, গমন ও উৎলম্ফন এই তিনটি বৈশিষ্ট্যযুক্ত
সত্তায় দেখতে পেয়েছিলেন জগৎসংসারের সমস্ত মানুষ, সমাজ, প্রকৃতি, বিশ্বের সমস্ত বস্তুকে;
এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে দেখেছিলেন নদ-নদীসমূহের ঘনজাল হিসেবে, যেখানে বর্তমানের বৈজ্ঞানিক
দর্শন, হকিং এর 'স্ট্রিং থিয়োরি'র দ্যোতনা। আর সেই বিশ্বব্যাপী জালের ভেতর নিরন্তর
প্রবাহিত হচ্ছে মানুষের চিন্তাধারা ও কর্ম্মধারা, আমাদের জ্ঞান ও চেতনার প্রবাহ। সেই
জ্ঞানজাত অভিজ্ঞতাপ্রবাহ যেমন নদ শব্দে চিহ্নিত, তেমনি কর্মজাত সম্পদ ও পণ্যের প্রবাহই
নদীর ধারা। বিভিন্ন সামাজিক সক্রিয় অথচ অদৃশ্য ধারাগুলোকে সাধারণ মানুষের কাছে দৃশ্য
করে তোলার জন্য তাদের সমধর্মী ও সমস্বভাবী দৃশ্যমান জলধারাগুলোর একই নামকরণ করেছিলেন
ভারতীয় ঋষি। এভাবেই গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, শতদ্রু, নর্মদা ইত্যাদি সমস্ত নদনদীর ইতিহাসই
বহন করছে আদিম মানবজাতির অগ্রগতির কাহিনি। আমাদের
পুরাণকাহিনি বলে, আদিম সাম্যবাদী সমাজের মহত্তত্ত্বই মানবসমাজের উদ্ভব, শৈশব ও
ক্রমবিকাশের তত্ত্ব। মহ-র আধার মহা সেই সত্তা, যে তার সর্বোচ্চ রূপে উত্তীর্ণ,
নিজের সীমা ভেঙে সমাজের সকল সদস্য, গাছপালা, পশুপাখি, আকাশ, বাতাস, নদী, সমুদ্র
সকলের সঙ্গে অবারিত যোগ যার, সেইই মহৎ।
আর এই মহৎ রূপটি স্থির না হয়ে অন হয়ে থাকলে
জন্ম হয় মহান। এই মহান দ্বারা জাত সমাজব্যবস্থা বা সমাজবৃক্ষ(দারু) মহান-জ-দারু নগরসভ্যতাই
সিন্ধুসভ্যতা, যার সাক্ষ্য বহন করছে মহেঞ্জদারো হরপ্পার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন,
যা আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০০ বছর আগের ভারতীয় উপমহাদেশের নগরসভ্যতা। সেই আদি
মহান সমাজেই জ্ঞানের মর্যাদা প্রতিষ্ঠার দাবিতে একদিন জ্ঞানী ও কর্মীর বিভাজন শুরু
হল, সৃষ্টি হল জ্ঞানজীবী ও শ্রমজীবী। একদিকে যখন সমাজ-সংহতির ক্ষেত্রে
শিবতার(inventor) নীতি অনুসরণ ক’রে যৌথসমাজ চলছে, অন্যদিকে তখন দক্ষতার(expert) নীতি
অনুসরণ করে উৎপাদন কর্মযজ্ঞ শুরু হয়ে গেছে। এক একটি দক্ষগোষ্ঠীর কিছু কিছু উৎপন্ন উদ্বৃত্ত
হয়ে যাচ্ছে অথচ বিনিময় প্রথার প্রচলন নেই সমাজে। এমতাবস্থায় দক্ষযজ্ঞের মহাসংগ্রাম,
যা প্রাচীন নগরসভ্যতা ধ্বংসের মূলকারণ হয়ে উঠেছিল। দক্ষযজ্ঞের পর আবিষ্কৃত ব্রহ্মজ্ঞানের বাহক বা বেদবাহক দক্ষসত্তার
সুপ্রিমেসি সনাতন যুগ পেরিয়ে বৈদিক সমাজের সূত্রপাত করল। শুরু হল মানসিক শ্রমোৎপন্ন
জ্ঞানসম্পদ এবং দৈহিক শ্রমোৎপন্ন পণ্যসম্পদের ধারা, যে ধারা থেকে লোকে নিজের প্রয়োজনীয়
বিষয়বস্তু তুলে নিচ্ছে এবং আপন উৎপাদিত বিষয়বস্তু সেই ধারায় ত্যাগ করছে। এই সক্রিয়
অথচ অদৃশ্য সামাজিক মহাধারাকে বৈদিক সাহিত্য নাম দিয়েছিল নদ; ন দান করে যে, দেশ-কাল-পাত্র থেকে
কোনো বিষয় বা বস্তু ত্যক্ত হয়ে হয়ে সৃষ্ট ধারা। নদ এর আধার নদী। বৈদিক ব্যবস্থার স্বর্ণযুগে,
মানবসমাজের আদিমতম রাষ্ট্র পৃথিবী, যা ছিল রাজা পৃথুর শাসনাধীন যৌথ সমাজব্যবস্থার এলাকা,
সেই পৃথুর রাজত্বকালে জ্ঞানসম্পদের বিভিন্ন ধারা, সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান, অর্থনীতি,
সংস্কৃতি, ঐতিহ্য সমস্ত ধারাই নদীর মতো প্রবল রূপে কখনো সরল কখনো বক্রপথে, বাধাবিপত্তি
ভেদ করে, নানা শাখা উপশাখা নিয়ে প্রবাহিত হতে শুরু করলে তার নাম দেওয়া হয়েছিল ব্রহ্মপুত্র
নদ ও সিন্ধু নদ। এই পৃথিবীর অধিবাসীদের অদৃশ্য মানসলোক বা মানস-সরোবর থেকে জাত বেদজীবীদের
জ্ঞানসম্পদ বা ব্রহ্মজ্ঞানের ধারাই দৃশ্যলোকে ব্রহ্মপুত্র ধারা।
ব্রহ্মপুত্র হল কোনোপ্রকার
বিনিময় না নিয়ে জ্ঞান-দেওয়ার ধারা, আর সিন্ধু হল কিছু বিনিময় নিয়ে জ্ঞান-দেওয়ার ধারা,
যা ধনসম্পদের ধারার বাহক। সূত্রপাত হল বৈদিক সমাজতান্ত্রিক শ্রেণীর সঙ্গে ধনতান্ত্রিক
শ্রেণীর বিরোধ। আর সেই বিরোধে যে বেদজীবীরা যৌথসমাজ থেকে বিতাড়িত হয়ে বেদে নামে বিভিন্ন
জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে, তাদেরই একটা অংশ সিন্ধুর উপনদী শতদ্রু ও বিপাশার মধ্যবর্তী দোয়াব
অঞ্চল, বর্তমান জলন্ধরে বসতি গড়ে তোলে। পরবর্তীকালে ধনসম্পদের এই সিন্ধুধারার সমগোত্রীয়
পণ্যজীবী-সমর্থক অজস্র ছোট ছোট (শত-দ্রু) প্রতিষ্ঠানের সূত্রপাত হয়েছিল, সেগুলোই শতদ্রু,
আর যে ধারা এই সিন্ধুধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল সেইই বি-পাশা। তারপর ভারতসমাজে
উৎপন্ন যখন পণ্যে রূপান্তরিত হয়ে পণ্যপ্রবাহের সম্ভাবনা দেখা দিল, তখন কল্যাণকামী সামাজিক
মানুষের শুভবুদ্ধি, সেই শিবসত্তা, সমাজে বাণিজ্যিক পণ্যস্রোত প্রচলনের সমস্ত ঝঞ্ঝাট,
জটিলতা আপন জটাজুটে ধারণ করেছিল। উৎপাদনের উপায় বা ভগ যার রথ সেই ভগীরথ, যার মার্কসীয়
নাম means of production, শিবের জটা থেকে গঙ্গাকে মর্ত্যে নামিয়ে আনে। ভগীরথ থেকে জাত
ভাগীরথী সেই মনুষ্যসৃষ্ট কৃত্রিম প্রবাহ, জগদীশচন্দ্র বসুর সেই “মহাদেবের জটা হইতে”
বের করে আনা পণ্যপ্রবাহের বাস্তব ধারা। মানসিক জগতের এই ভগীরথই সেই স্রষ্টা সত্তা,
সেই শিল্পী সত্তা, যিনি আপন সাধনায় ভাবনার স্বর্গ থেকে মানসিক জট ছাড়িয়ে বাস্তব জগতে
গঙ্গার নির্ঝরধারার মতই নতুন চিন্তাধারা প্রতিষ্ঠা করেন। ভ্রমণপিয়াসী
প্রণবের আলোকচিত্রও এভাবেই দর্শকের মানসভ্রমণের নতুন পথনির্মাণ করে। কবিতার শব্দজাত সঙ্গীত যেমন পাঠককে উসকে দেয় শব্দের সুরে অনুরণিত
হতে, তেমনি প্রণবের আলোকচিত্র দর্শকের নিষ্ক্রিয়তা মুছে
তার নিজস্ব ফ্যান্টাসিকে প্ররোচিত করে, উসকে দেয় নতুন নির্মাণে।
কবির সঙ্গে পাঠকের, ফটোগ্রাফারের সঙ্গে দর্শকের এই
রেসন্যান্সই সৌন্দর্য্য, একমাত্র সত্য, অনন্ত আনন্দের স্রষ্টা। দর্শকের ভাবনা, অভিক্ষেপ ও অন্তর্মুখ
তীব্রতর করে তোলার এ এক নতুন পদ্ধতি। গঙ্গাধারার মতোই এই
জ্ঞানধারার দ্যোতনা শিল্পীর কর্মকে সমৃদ্ধ করে, জ্ঞানধারা ও কর্মধারা পরস্পরকে
সমৃদ্ধ করতে করতে অবিরাম এগিয়ে চলে─
Knowledge is not
only
to know ledge like expert
but also to go beyond like inventor.
Knowledge is to stand on edge
not to dream but to
set sail
into the black hole
of unknown.
মানবসভ্যতার
ক্রমবিকাশ একদিকে যেমন তার জীবনীশক্তিকে উদ্বৃত্ত করেছে, তেমনি বৃদ্ধি করেছে তার আত্মনিয়ন্ত্রণ
ক্ষমতা, আর তারই সঙ্গে বেড়েছে তার মনের ক্ষুধা। এই ক্ষুধানিবৃত্তির জন্যই সে জগতের
সঙ্গে কর্মে লিপ্ত হয়, যেগুলো সবই ক্রীড়াবাচক, কারণ সেখানে উদ্ভাবন নেই অথচ উদ্বৃত্ত
তেজ বা জীবনীশক্তির লয় হয় আর অভিজ্ঞতার আবর্তন হয়, যা তাকে একদিকে তার পরবর্তী কর্মে
দক্ষ করে তোলে, অপরদিকে মনের তৃপ্তিসাধন ক’রে তাকে পরবর্তী অস্তিত্বে উত্তীর্ণ করে
দেয়। প্রকৃতপক্ষে দেহমনের এই তৃপ্তিসাধনের জন্য, আপন আনন্দের জন্যই মানুষের সমস্ত কার্য্যাবলী।
অভিজ্ঞতার এই আবর্তনই নৃ-মিতি আর যাতে নৃ-মিতি সীমায়িত তাই নর্ম(norm), নর্ম দান করে
যে, সে নর্মদা, মানুষের অভিজ্ঞতামথিত জাগতিক ও সামাজিক নর্ম বা নিয়মাবলী, সেখানে যেমন
আছে বিশ্বজগতের মূলনীতি, মহাজাগতিক সৃষ্টি ও বিলুপ্তির কসমিক সাইকেলের রহস্য, তেমনি
আছে জাগতিক জন্মমৃত্যুর অনন্ত চক্র, যা আমাদের পরমাপ্রকৃতির এক অনমনীয়
নিয়ম, এক সর্বজনীন দর্শন। এই জাগতিক ও মানসিক নিয়মাবলী বা সূত্রসমূহই
জগতের মূল জ্ঞানধারা, যা কালের অগ্রগতির সঙ্গে তাল রেখে নিজেকে বদলায়, পুরোনো জলধারার
বিশ্বাসের স্থান দখল করে নতুন ধারার আশ্বাস। মানুষের সমস্ত পুরোনো জ্ঞানের বিচার-বিবেচনা
ও সমস্ত নতুন জ্ঞানের অর্জন ঘটে অনুভবের মাধ্যমে। শিল্পীর মননবৃত্তিতে মন অন থাকে,
সক্রিয় থাকে, তাই কবিতার কাব্যরস বা চিত্রের চিত্ররস অনুভব করতে গিয়ে পরিবর্তনশীল
বিশ্বে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নতুনায়নের প্রয়োজনও অনুভব করতে পারেন। গম্ ক্রিয়ামূলে জাত গঙ্গার গতিশীলতা সেই নতুন হয়ে ওঠার কথাই
বলে, যাওয়ার দিকেই যাচ্ছে যে, পায়ে যার নিত্য চলার দ্যোতনা। তাই বুঝি চলার মন্ত্রে
উৎসারিত সত্তার প্রাণবন্ত প্রবাহ ডানা মেলেছিল কবির ‘বলাকা’য়─ “হে বিরাট নদী/…চলেছ যে নিরুদ্দেশ,
সেই চলা তোমার রাগিণী─/শব্দহীন
সুর/অন্তহীন দূর”। জলধারার এই রাগিনী যেমন শিল্পীর চেনাবৃত্তের বাইরে অচিনের খোঁজ করে,
তেমনি জলের সমোচ্চশীলতার গুণ তাকে নিয়ে যায় সাম্যবাদী ধর্মে। জলের
এই জ-জাত জননক্রিয়ায় অস্তিত্ব থেকে বহির্গত আত্মস্বরূপ জলের মতো সর্বদিশায়
ছড়িয়ে পড়ে, আপন উদ্লোকের না-করণ ক'রে নিজেকে প্রসারিত করে, নতুন
রূপে উত্তীর্ণ করে। এ সেই সত্তা যে পারিপার্শ্বিকের সঙ্গে সামঞ্জস্য সাধন করতে
গিয়ে আপন শ্রেষ্ঠত্ব কমিয়ে নিতে দ্বিধা করে না। সত্তার সেই চেষ্টাই সুন্দরের মূল,
সাম্যের ধর্ম,
সত্তার নিজস্ব পুরুষ-প্রকৃতি রূপ, অদ্বৈত স্বরূপ।
সেই স্বরূপেই শিল্পী বাজে, স্রষ্টা সৃষ্টি করে, দ্রষ্টা দেখে, প্রসারিত চেতনায় পেরিয়ে
যায় তার কণামূলক অবয়ব, স্পর্শ করে তরঙ্গমূলক মন, আর তাকেই ধারণ করে তার সংগীতে, তার
কবিতায়, তার আলোকচিত্রে। এই শিল্পীসত্তাই খোঁজ করে সেই আনন্দ, সত্য যেখানে শিবস্বরূপ, আর
তার উদ্ভাবক সত্তা সৃজনের আনন্দে কল্পলোকের রঙে রেখায় চেতনার প্রসারণে তাকে নতুন করে
তোলে, যা তার আপন সত্তার আনন্দময় প্রকাশ, সেই অদ্বৈত সত্তা,
শান্তম্ শিবম্ সুন্দরম্─
Beauty negates
ascension
but
affirms expansion with water logic.
Truth denies
permanency
but admits
freedom of activity.
Rhythm rising
from your
confluence of
beauty and truth
the everchanging
flux that
never alows to step twice
into the same rever.
But I play my
sonata of love
to surrender my
freedom
to your beauty of
quantum unity.
কিন্তু মানুষের এই অখণ্ড দর্শনের জীবনবোধ আধুনিক সভ্যতার অগ্রগতির
চাকায় ক্রমাগত খণ্ডবোধের দিকে ধাবমান। একজনের অভাব অন্যের উদ্বৃত্ত দিয়ে পুরণের জন্য
একদিন শুরু হয়েছিল পণ বা চুক্তি রেখে উদ্বৃত্ত উৎপাদন বা পণ্য বিনিময় প্রথা। কিন্তু
এই উৎপন্ন বস্তু ‘স্বাধীন’ হতে পারে না, যতক্ষণ না যৌথসমাজের নিয়মের নিগড় থেকে মুক্তিলাভ
ক’রে তা পণ্য বা কমোডিটিতে পরিণত হচ্ছে। তাই বৈদিকযুগের দক্ষসমাজে শুরু হল স্বাধীন
উৎপন্নের ধারা বা পণ্যধারা। এই সামাজিক পণ্যধারাই জাগতিক গঙ্গাধারার স্বরূপ, যেখানে
মানুষ হাটে বাজারে, গঙ্গাতীর্থে পণ্য বেচে তার কর্মফলরূপ পুণ্য ওরফে অর্থ অর্জন করে।
এই গঙ্গাধারায় স্নান করে ঘরে পণ্য জমে পতিত হওয়ার হাত থেকে মুক্তি পেত বলেই মানুষ এই
নদীকে পতিতপাবনী নামে চিহ্নিত করে। এভাবেই সেই বৈদিকযুগ থেকে ক্রমে জনমানসে দর্শনের বদল ঘটল, শুরু
হল অখণ্ড আধ্যাত্মিকতা থেকে খন্ডদর্শনের প্রাদুর্ভাব, যার প্রভাবে বর্তমান শিল্পজগতেও
এই অর্জিত অর্থই হয়ে উঠেছে অনর্থ। মানসগতি(মানে) ও দৈহিকগতি(অর্থ) দুটোই অর্থকরী বস্তু জনন করে, যার পেছনে আমাদের চেষ্টা কাজ করে, তাই
তারা অর্জিত বস্তু।
কিন্তু পণ্যবিনিময় প্রথা শুরু হ’লে মানবেতিহাসে
প্রথম শুরু হল বিভাজন। মার্কস যথার্থই বলেছিলেন, পণ্য উৎপন্ন হয়েই তার মালিকের খোঁজ
করে আপন গৌরবের মূল্য নির্ধারণে─ “Could commodities themselves speak, they would say: Our use value may
be a thing that interests men…Their owner must, therefore, lend them his
tongue”. পণ্যবিনিময় প্রথায় একটি শব্দে অনেকগুলো বস্তুকে বোঝালে সেই বহুরৈখিক ভাষায়
আর যাই হোক পণ্য বিনিময় চলে না। সুতরাং শুরু হল একই কর্মের পুনরাবৃত্তি, যেখানে বহুরৈখিক
শব্দের যেকোনো একটিমাত্র গুণকে বারংবার উল্লেখ করে একরৈখিকতায় অধঃপতন, সমস্ত শব্দার্থ
ক্রমে লোগোসেন্ট্রিক ‘মানে’তে পরিণত হতে থাকল। জন্ম হল বদ্ধ(close-ended) মানসিকতা,
বৈধতার সীমা নির্ধারণ ক’রে মানবসমাজে সেই সর্বপ্রথম মানুষে মানুষে ভেদের সূত্রপাত।
তথাকথিত সভ্যতার অগ্রগতি মানসিক ও দৈহিক এই দুই অর্জনের ভেতর সেতুকে ভেঙে দিয়ে ‘মানে’র
ভেতর ‘অর্থ’কে পুরে দিল। ফলত শিল্পের অর্থ(মানে) পাওয়া গেলে হাতে অর্থ(টাকা) পাওয়াও
সম্ভব, এই মূলমন্ত্রে দীক্ষা নিল শিল্পকলার প্রতিষ্ঠান─
Progress
needs production
but
production needs meaning.
Meaning
earns money
but money needs owner
to
achieve its face value.
Value
merges with meaning
by
authority to enjoy the progress.
Progress
needs production…
Cycle continues
but there is a crack
to be found by you.
বাংলাভাষার
মহান দার্শনিক কলিম খান বলেন, মানুষে মানুষে এই বিভাজন ও বিধিনিষেধ সমাজে কৃষ্ণ ও গৌরী
সত্তার জন্ম দিল। এই অনন্ত অজ্ঞাত জ্ঞানজগতের যেটুকু জ্ঞানসম্পদ ও ধনসম্পদ আবিষ্কৃত হয়ে সমাজে স্বীকৃতি
পেয়েছে, সে গৌরী সত্তা বা preconcept, আর তার বাইরে সবটুকুই কৃষ্ণ সত্তা বা wild
concept. আর এই গৌরী ও কৃষ্ণ সত্তার মধ্যবর্তী শ্যাম সত্তাই আমাদের সমান্তরাল সাহিত্য
বা শিল্পধারা, যা আবিষ্কৃত হয়েছে কিন্তু সমগ্র মানবসমাজে আত্মস্থ হয়নি, স্বীকৃত হয়নি।
সমাজে প্রচলিত ধারা পূর্ববিধান বা সমাজস্বীকৃত নর্ম বা নিয়ম
মেনে চলে। কিন্তু পূর্ববিধান, পূর্বের 'ন্যায়', তাই নতুন তার কাছে অ-ন্যায়, অসত্য, অনৈতিক। এই পূর্ববিধান মেনে চলা সভ্যতায় একদিকে শিল্পবিপ্লবের
মন্ত্রে জাগতিক নদনদীর মুক্তধারাকে গতিরোধকারী বাঁধ দিয়ে বেঁধে প্রকৃতির ওপর মানুষ
আপন নিয়ন্ত্রণ জারি করল, তেমনি আধুনিকতার মন্ত্রে জ্ঞানধারা নিয়ন্ত্রণে শিল্পকলা, সাহিত্য
সর্বক্ষেত্রে নৈতিকতার বাঁধ নির্মাণ শুরু হল। কিন্তু প্রতিষ্ঠানের বেঁধে দেওয়া নৈতিকতা
শিল্পীর উদ্ভাবনের বিরোধী, কারণ যেকোনো উদ্ভাবনই সমাজস্বীকৃত নৈতিকবোধ পেরিয়ে শিল্পীর
নিজস্ব নৈতিকতায় ভাস্বর হয়ে ওঠে। এই আধুনিক সভ্যতার অগ্রগতি একদিকে যতই তার জ্ঞানসম্পদকে
নৈতিকতার বেড়াজালে বন্দী করতে চায়, অপরদিকে তার মুক্তির দাবীও ততই বেড়ে ওঠে। তাই বুঝি
নর্মদা বাঁচাও আন্দোলনে নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গের সুর উঠেছে, “কেন রে বিধাতা পাষাণ হেন,/চারিদিকে
তার বাঁধন কেন?/ভাঙ্ রে হৃদয় ভাঙ্ রে বাঁধন,/সাধ্ রে আজিকে প্রাণের সাধন”─
Borders are there to cross
because
the individual I-am
listen
to his inner silence
that
leads to break the barrier.
Boundaries
are there to blur
because
the finite I-am
longing for the infinite.
মনুষ্যসৃষ্ট
কর্তৃত্বে আর অত্যাচারে নদীখাতের অস্তিত্ব যখন বিলুপ্ত হয়ে আসে, নদী যেমন বাঁক নেয়
অন্যখাতে, ঠিক তেমনি শিল্পপ্রতিষ্ঠান যখন সক্রিয়তা হারিয়ে স্থবির হয়ে ওঠে, গতানুগতিকতার
একঘেয়েমিতে তিক্তবিরক্ত হয়ে ওঠে, তখন শিল্পীও প্রচলিতের কলুষ ত্যাগ করেন, স্বীকৃত পূর্বধারণা থেকে বাঁক নেন নতুনের খোঁজে,
যুক্তিশৃঙ্খল ভেঙে হেঁটে যান বিযুক্তির পথে, নদীর মতোই
নিজের বেগে নিজের পথ সৃষ্টি করেন, এ কূল ভেঙে ও কূল গড়ে্ন। নদীর চিরকালীন বহমানতা
একান্ত রূপকতায় অধিকার করে শিল্পীর মানসলোক, ধারাবাহিক
বৈচিত্র্যের মধ্যে দিয়া আপনাকে নিঃশেষে উৎসর্গ করেন আপন
কাব্যস্রোতের আবর্তে, আলোকচিত্রের মুহূর্তজাত সংকেতকে তার জাগতিক দেশ-কালের সীমা
ছাড়িয়ে ব্যাপ্ত করেন অসীমে, সমাজের বেঁধে দেওয়া সামাজিক, পারিবারিক ও ব্যক্তিগত
সম্পর্কগুলোর বাইরে বেরোতে চান, নিয়মভাঙা নৈতিকতায় জ্ঞাতর সীমানা পেরিয়ে অজ্ঞাতের খোঁজ করেন, অতিবাস্তবের অজানা মাত্রায় বাস্তবের রহস্য উন্মোচন করতে
সন্ধান করেন সেই নতুন সেই বিকল্পধারা, যা প্রবাহিত ধারার নতুনায়ন করে─
Norms act with
morality
but morality
resists invention.
Invention replaces norm
with paranorm
but paranorm rejects
inaction.
Inaction resists
negation
but negation
leads to possibilities.
Possibilities
open up alternative action
but action
achieves experience.
Experience
engenders knowledge
but knowledge
becomes intelligence
from the faculty
of reason.
but reason can’t conceive
reality.
Reality needs
imagination
but imagination
engenders conflict.
Conflict creates
difference
but difference triggers authority to apply norms.
Norms act
with morality…
Cycle continues
but there is a crack to be found by you.
গ্রন্থসূত্র :
1. প্রবন্ধ “অব্যক্ত”- জগদীশ চন্দ্র বসু, wikipedia
2. কাব্যগ্রন্থ “বনলতা সেন”(১৯৪২)- জীবনানন্দ দাস, জীবনানন্দ দাসের কাব্যসমগ্র,
ভারবি, ২০০৪, পৃ:১৮৫
3. Ludwig Wittgenstein, Philosophical Investigations, 1958. Tr. by G.
E. M. Anscombe, ed. G. E. M. Anscombe, R. Rhees, G. H. Von Wright. Oxford:
Basil Blackwell Ltd.
4. কবিতা “চঞ্চলা”, কাব্যগ্রন্থ বলাকা (১৯১৪), কবিতা-“নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ”,
কাব্যগ্রন্থ- প্রভাতসংগীত(1884), রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সঞ্চয়িতা, বিশ্বভারতী, ২০০৪, যথাক্রমে
পৃ:৫৪৫ পৃ:৩৮
5. Stanford Encyclopedia of Philosophy, https://plato.stanford.edu/entries/heraclitus
6. Capital by Karl Marx, Vol-1, Part-I: Commodities and Money, source: www.marxists.org/archive/marx/works/1867
7. কলিম খান ও রবি চক্রবর্তী, বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক
শব্দার্থের অভিধান, ভাষাবিন্যাস, ২০০৯. এই লেখায় ব্যবহৃত সমস্ত শব্দার্থগুলোর শেকড়ে
আছে এই বইটির প্ররোচনা, যার জন্য আমার বিশেষ কৃতজ্ঞতা।