ফরাসি অনুরাগী রবীন্দ্রনাথ। একটা ছোট্ট প্রয়াস!

শম্পা ব্যানার্জী



বুঁ জুর আ তুস। ভুজ আলে বিঁয়া?

ফরাসিতে জিজ্ঞেস করছি, কেমন আছেন সবাই। কিন্তু কেন?  তাহলে বলি গল্পটা। পিছিয়ে যাচ্ছি বেশ কয়েকটা বছর। 


সালটা ছিল 2014, অক্টোবর মাস লক্ষীপূজোর ঠিক দু'দিন আগে, আমি দাড়িয়ে আছি পন্ডিচেরীর সমুদ্র সৈকতে, বীচ অফিসের ঠিক সামনে। তখন বিকেল পাঁচটা হবে, সাথে আমার আজীবন আশ্রমিক কাকু, তিনি  পন্ডিচেরী আশ্রমের একজন সাধক। বিগত তিরিশ বছর ধরে, ওঁর ঠিকানা আশ্রম। উথাল-পাতাল সমুদ্রের ঢেউ, আদিগন্ত সমুদ্র, ঢেউয়ের গর্জন, হালকা ঝোড়ো হাওয়া, সব মিলেমিশে কেমন যেন এক মন কেমন করা পরিবেশ।

হঠাৎ দূরে চোখে পড়লো সমুদ্রের মাঝে খানিকটা ভাঙা জেটির অংশ। মনেহয়, সবটুকু নিয়েও হার মেনেছে সমুদ্র। তাই ওই জেটির ভগ্নাবশেষ আজও দৃশ্যমান। আমি জিজ্ঞেস করলাম, আমার কাকুকে ওই আধভাঙ্গা জেটির সম্পর্কে। উত্তরে, আমায় উনি যা বললেন, তা শুনে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। আনন্দে দু'চোখ ভরে গেলো জলে। শুনলাম, 1928 সালের 29শে মে  কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এসেছিলেন পন্ডিচেরীতে।  ওই জেটিতেই জাহাজ থেকে অবতরণ করেন তিনি। কয়েক ঘন্টার সাক্ষাৎ ছিল ঋষি শ্রী অরবিন্দের সাথে। বন্ধ দরজার আড়ালে দু' জনের মাঝে কী কথোপকথন হয়েছিল, তা আজও অজানা। তবে, এটা জানা গেছে সেই সময় কবি খুব অসুস্থ ছিলেন। বার্ধক্য গ্রাস করেছিল তাঁকে। তাই তাঁকে  জাহাজ থেকে নামানো খুব দুষ্কর হয়ে পড়েছিল। তখন একটা কাঠের ব্যারেল কেটে দড়ি লাগিয়ে তার মাঝে একটা কাঠের টুলে, কবিকে বসিয়ে অনেকটা দোলনার মতো করে  ক্রেনে করে, নামানো হয়েছিল জাহাজ থেকে। ভারতের অন্যতম ফরাসি উপনিবেশ পন্ডিচেরী সাক্ষী হয়েছিল সেইদিন এই বিরল ঘটনার।

এরইমাঝে, কাকু বলে বসলেন,"ফরাসি ভাষা শেখ। দেখবে, জানতে পারবে ফরাসি সংস্কৃতির ওপর কবির কত অনুরাগ ছিল।"

ফিরে এলাম দিল্লি। খোঁজ খবর নিয়ে ভর্তি হয়ে গেলাম অলিয়ন্স 

ফ্র ঁনসে তে। 

শুরু হলো ফরাসি ভাষা শেখা। দেখতে, দেখতে এক নয়, দুই নয়, তিন তিনটে বছর কেটে গেলো। এভাষা সহজ নয়, এ ভাষা ব্যাকরণ বহুল। উচ্চারণে চাই শুদ্ধতা। আর চাই অপরিসীম ধৈর্য্য। যতদিন এগিয়েছে, অন্ধকার কেটেছে একটু একটু করে, নতুন কোনো আলোর আবেশ আমার মনকে আরও আগ্রহী করেছে।

আজ একটু একটু করে বোঝার ক্ষমতা হয়েছে। আমি পড়ছি, "রবীন্দ্রনাথ অন ফ্রন্সে" যার বাংলা করলে দাড়ায় "ফরাসিতে রবীন্দ্রনাথ।" যা কিনা একদিনের কাজ নয়, তবু কবির জন্মদিনে, কবিকে প্রণাম জানানোর জন্য রইল ,আমার একটা ছোট্ট প্রয়াশ।

"কী জমকালো শহর!"-- কিশোর রবীন্দ্রনাথ প্রথম প্যারিস শহর দেখে উচ্ছাস প্রকাশ করেছিলেন, এভাবে। ১৮৭৮ সালে ১৭ বছর  বয়সে শিক্ষার্থ্যে ইংল্যান্ড যাবার পথে একদিনের জন্য ছিলেন প্যারিসে। কবির ভাষায়,"ইতালি থেকে ফ্রান্স পর্যন্ত সমস্ত রাস্তা - নির্ঝর নদী, পর্বত, গ্রাম, হ্রদ দেখতে দেখতে আমরা পথের কষ্ট ভুলে গিয়েছিলেম। সেই অভ্রভেদী প্রাসাদের অরণ্যের মধ্যে গিয়ে পড়লে অভিভূত হয়ে যেতে হয়। স্মরণস্তম্ভ, বাগান, প্রাসাদ, পাথরে বাঁধানো রাস্তা, গাড়ি, ঘোড়া, জন-কোলাহল প্রভৃতি দেখে অবাক হয়ে যেতে হয়।"

এরপরে, জীবনের নানা সময়ে বেশ কয়েকবার, কবি প্যারিসে গিয়েছেন। সৌন্দর্যের পূজারী কবি পায়ে হেঁটে সেই শহরের সৌন্দর্য্যকে   উপভোগ করেছেন। এমনকি তাঁর প্রথম প্যারিস ভ্রমণের একশো কুড়ি বছর পর একটি রাস্তার নাম, "রু্্য টেগর" দিয়ে তাঁকে সম্মানিত করেছিল ফরাসি দেশ। ফরাসিতে "রু্্য" এর অর্থ রাস্তা।

শুধু শিল্প অনুরাগ নয়, মননের পরিমণ্ডলে ফরাসি সংস্কৃতির প্রতি গভীর অনুরাগ ছিল কবির। তাই জীবনের বিভিন্ন পর্বে, ফরাসি ভাষা শেখার চেষ্টা করেছেন তিনি। ভিক্টর হুগোর "লে কোনতেমপ্লাসিও" অর্থাৎ  the action of looking thoughtfully at something for a long time ---এর কবিতা অনুবাদ প্রসঙ্গে তাঁর ফরাসি চর্চার বিষয়টি জানা যায়।

রবীন্দ্রনাথ ছিলেন জীবনকবি। জীবনের দর্শন তাঁর কাছে ছিল সম্পূর্ণ অন্যরকম। তিনি জীবনকে উপলব্ধি করতে ভালোবাসতেন অনুভূতি দিয়ে। তাই তাঁর লেখনী এতো জীবন্ত, এতো হৃদয়ছোঁয়া। অন্ততঃ আমার তো তাই মনে হয়। তাই ব্যাকরণ অবলম্বনে ভাষা শিক্ষা ছিল তাঁর স্বভাব বিরুদ্ধ। এক জায়গায় বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র কে যে চিঠি লিখেছিলেন, তাতে চুপচাপ বসে একখানা ফরাসি ব্যাকরণ ওল্টানোর খবর ছিল। তিনি ১৯০১ সালের ৯ই অক্টোবর তাঁর বন্ধু প্রিয়নাথ কে লিখেছিলেন যে," ব্যাকরণ ঘেঁটে ফরাসি শেখা আমার কম্ম নয়। একটা বই দিয়ো, আমার লাইব্রেরীতে , যে যে ফরাসি গ্রন্থের তর্জমা আছে তারই কোনো একটার অরিজিনাল পেলে সুবিধা হয়।"সেই একই বছরে কবির দুটো প্রিয় বই,"ল ক্রেম ড সিলভেসত্রে" এবং "নো রিলাসিও" বই দুটো তাঁকে পাঠাতে তাঁর বন্ধুকে অনুরোধ করেছিলেন।

রবীন্দ্রনাথ প্যারিসে আসার আগেই ভারতে পরিচয় হয়েছিল আঁত্রে ও সুজান কাপওরলে নামে দু'বোনের সাথে। প্রাচ্যবিদ সিলভাঁ লেখির ছাত্রী সুজান আসতেন রবীন্দ্রনাথের কবিতার অনুবাদ করতে। কবি, মুখে মুখে ইংরেজীতে বলতেন আর সুজান ফরাসিতে লিখে নিতেন। বড় বোন  আঁন্দ্রে এ সময়ে কবির ছবিও এঁকেছিলেন। কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথের লেখা থেকে জানা যায় যে, ছোটো বোনের চেয়ে বড় বোনকেই কবি বেশি পছন্দ করতেন।


শুধু তাই নয় "গীতাঞ্জলি"র ফরাসি অনুবাদের অনুমতি নেন, তরুণ কবি সাঁ জন পার্স।

১৯৩০ সালে কবির চিত্র প্রদর্শনী হয় প্যারিসে।  যাঁর তত্ত্বাবধানে এই প্রদর্শনীর আয়োজন হয়েছিল। সেই  প্রদর্শনীর উদ্যোক্তা ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোকে কবি বলেছিলেন,"তুলি দিয়ে আমি ছবি আঁকব না। যে কলম দিয়ে কথার কাব্য লিখি, সেই কলমে রং এবং রেখার কাব্য লিখতে পারি কিনা, তারই একটা পরীক্ষা চালাতে চাই।" কী ভয়ানক স্বগোতোক্তি! আর এমনটা তাঁকেই মানায়। এ ইতিহাস সুদীর্ঘ, তথ্যবহুল আর কয়েক পাতার লেখায় তাকে সীমাবদ্ধ রাখা সম্ভব নয়। বাঙালির কাছে রবীন্দ্রনাথ মানে একটা যুগ। যার অতীত আছে, আছে বর্তমান, আছে ভবিষ্যত যা  চিরকালীন, নদীর স্রোতের মতোই আবহমান।


কবির অনেক উদ্ধৃতি ফরাসিতে অনুবাদিত হয়েছে। সেখানে, লেখা আছে ফরাসিতে, "তুত লে সিতাসিওঁ ড রবীন্দ্রনাথ টেগর, সে মাইয়ার পনসে।" যার বাংলা তর্জমা করলে দাড়ায়,---" রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সমস্ত বাণী বা উক্তিই হল শ্রেষ্ঠতম।" আমি আমার মতো করে  তাঁর কিছু উদ্ধৃতিকে ফরাসি থেকে আবারও বাংলায়  তর্জমা করলাম।  

যেমন, এক জায়গায় কবি বলেছেন ভালোবাসার কথা, " লামুর সে লা জোয়া কি এ আ লোরিজিন দ তুৎ ক্রিয়েশিও।" যার বাংলা তর্জমা করলে দাড়ায়, "ভালোবাসা মানে জয়ের আনন্দ, যার মাঝে লুকিয়ে আছে সমগ্র সৃষ্টির উৎস।"

আবার আরেক জায়গায় কবি বলেছেন, " লা রিভিয়ার নতন্দ্রেরা জামে লা ম্যার, সি লে ব্যারোজ দ লা কনথ্রেনিও" অর্থাৎ নদী কখনওই সমুদ্রের কাছে যেতোনা, যদি না নদীর দু'পাশে কিনারা থাকতো।

 আরও একজাগায় কবি বলছেন, "লিউসিওঁ  সল্ এতেসে, লা ভ্যারিটে এ তুজুর ডিফিসিল" অর্থাৎ কল্পনা সত্যি খুব সহজ, কিন্ত বাস্তব সর্বদাই কঠিন।

আরও একটি উদ্ধৃতি তুলে ধরছি যা আমার মনকে খুবই ছুঁয়ে গেছে, "অ কইও সে পেটাল, ভু ন সেজিসেপা লা বোটে দ লা ফ্লর" অর্থাৎ পাপড়ি ছিঁড়ে ফুলের সৌন্দর্য্যকে কখনওই ছোঁয়া যায় না।


কিন্তু সবশেষে,  কবি প্রসঙ্গে আমার নিজের কিছু অনুভূতির কথা ফরাসিতে বলতে চাই। ফরাসিতে যদি কেউ আমার খুব আপন বা কাছের মানুষ হয় তাকে "ভু" না বলে "তু" বা ফরাসি উচ্চারণে "চু" বলে। রবীন্দ্রনাথ আমার একান্ত আপন, আমার মনের কথা তথা আমার হৃদয়ের গান। তাই তাঁকে নিয়ে যখন কবিতা লিখছি ফরাসিতে তখন আমি তাঁকে "তু" বা "চু" সম্বোধন করলাম। কারণ, এক্ষেত্রে সে সম্বোধন অনেক আন্তরিক।

কঁ জ মা লাভে লা মাতা

জ ভুদরে তা দির "জ'তেম।

কঁ জ ভে উ লি লা নুই

জ ভুদরে তা দির "জ'তেম।

জ'তেম তুজুর।

তু এ মা ভি।।


বাংলায় এর তর্জমা হলো, 

প্রতিদিন সকালে যখন, আমি  ঘুম থেকে উঠি, 

আমি তোমায় বলতে ভালোবাসি,"আমি তোমায় ভালোবাসি।"

রোজ রাতে শোবার আগে, আমি তোমায় বলি,

"আমি তোমায় ভালোবাসি।"

ভালোবাসি তোমায় সদা, সর্বদা।

তুমিই আমার জীবন।"

সেত লা ভি মসিউর। এই তো জীবন স্যার। 

হে কবি তোমায় প্রণাম।।