জয়ন্তী অধিকারী
জয়ন্তী অধিকারী
লেখক / সংকলক : Web Admin
একটি সাইকেল ও দেহলিজ
জয়ন্তী অধিকারী
১
“ডরাইলেই ডর,ফাইল দিয়া (লাফিয়ে)পড়লে আর কিয়ের ডর-”
ছোটবেলায় এই আপ্তবাক্যটি আমাদের খুব কাছের মানুষ নারায়ণকাকার মুখে প্রায়ই শুনতাম। বিশাল ভুঁড়ির ওপর ধবধবে সাদা পৈতেগাছাটি তুরতুর করে নাচছে,কোন অজ্ঞাত কারণে যতক্ষণ বাড়িতে আছেন ততক্ষণ কাঁধে লালনীল গামছা,চশমার আড়ালে বড় বড় চোখ দুটি সর্বদাই যেন কোন বেজায় মজার কথা শুনে জ্বলজ্বল করছে,যেকোন কঠিন জিনিস অবিশ্বাস্য কম সময়ে জোগাড় করতে সিদ্ধহস্ত, যেমন ছাদনাতলার কলাগাছ,কলকাতায় বসে ঢাকার বাখরখানি পরোটা,বড়বাজারের কোন দুর্গম গলির গলি,তস্য তস্য গলিপথ বেয়ে আশ্চর্য আয়ুর্বেদিক ওষুধ,যা কিনা বছরে একবারই তৈরি হয়,ইত্যাদি,ইত্যাদি। এই কাকু যে আমাদের রক্তসম্পর্কের কেউ নন,সেই জ্ঞানটি আমাকে প্রথম দেয় আমার এক ক্লাসবন্ধু-"তুই কী ন্যাকা রে!নারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায় তো ব্রাহ্মণ নাম,তোরা তো দাশগুপ্ত ,ইনি তোর নিজের কাকু হবেন কেমন করে?”
ব্রাহ্মণ বৈদ্যের ব্যাপারটা অবশ্য ভাল বুঝিনি,এসব জটিল সমীকরণ বোঝার আশা রাখিনা -স্বয়ং গুরুদেব বলে গেছেন,সমস্ত কে বুঝেছে কখন!
নারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায় আমাদের সব ভাইবোনদের কাকা ছিলেন,আমৃত্যু। তাঁর মত চমৎকার, সহৃদয়,খোলামনের মানুষ অতি বিরল।
কিন্তু এই সামান্য রচনাটি ঠিক কাকুকে নিয়ে নয়,সুযোগ পেলে তাঁর স্মৃতিচারণ অন্যত্র করার চেষ্টা করব। এই লেখাটি হল কুমুদির(যে নামে বর্ত্তমান লেখিকাকে দিল্লির অনেকে চেনেন)সাইকেল চড়ার সকরুণ ইতিহাস।
আজকের প্রবীণা ,নব্বই কেজি ওজনের যতখানি লম্বা ততখানি চওড়া ,রাশভারী বৈজ্ঞানিক কুমুদি তখন নবম শ্রেণী,কুমুদি তখন বেথুন স্কুলপোশাক। সাদা ফ্রক, লাল বেল্ট ও ব্যাজ পরিহিতা এক শীর্ণকায়া কিশোরী মাত্র। কুমুদি এবং আরও কয়েকজন সাইকেল শিখত স্কুলের মাঠে। এর জন্য স্কুলসময়ের একঘন্টা আগে যেতে হত। স্কুলের পাঁচ ছটি সাইকেল ছিল,পকেটে থেকে থেকে পাঁপড় হয়ে যাওয়া পিটি ম্যামের অনুমোদন পত্র দেখালে সাইকেলের ভারপ্রাপ্ত ভূষণদা কুটিল ও সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে মেয়েদের দেখত,তারপর একে৪৭ বা তার চেয়েও মারাত্মক কোন অস্ত্র বের করে দিচ্ছে এমন ভঙ্গীতে,ভীষণ গম্ভীর মুখে গুণেগেঁথে একেকটি সাইকেল বের করে দিত।
পাঠক/পাঠিকা,বিবেচনা করেন,অতি মূল্যবান একটি ঘন্টা সাইকেল শেখার জন্য বরাদ্দ-যার জন্য কোন রকমে, মায়ের বকুনিসহ সেদ্দভাত নাকেমুখে গুঁজে বাসের ভিড় ঠেলে আসতে হয়েচে,তার দশটি মিনিট ভূষণদা এইভাবে খরচা করে দিত,কিছু বলতে গেলেই বলত "পচ্ছন্দঅ না হইলে চড়িবে না,অতঅ বাক্য কিসের?"
বাকি পঞ্চাশ মিনিটকে চড়িয়েদের সংখ্যা ইনটু একবার স্কুলমাঠকে পাক দেওয়ার সময় দিয়ে ভাগ করে দেখা গেছিল ,একেকজন মোটামুটি পৌনে পাঁচবার (৪.৭৫ টাইমস) পাক খেতে পারবে। কিন্তু এই হিসেব সিনিয়র দিদিরা মানত না,তারা ভাল চালাত,তাই তীরবেগে সাইকেল নিয়ে যেন উড়ে যেত,আটদশ পাক খেয়ে নামত। এদের চড়া শেষ হলে নাইনটেনদের পালা আসত,যাদের মধ্যে ছিল নতুন চড়িয়ে কুমুদি। এখন কুমুদির ছিল দুটি মারাত্মক অসুবিধে,যা অনেক বিগিনারদেরই থাকে।
এক নম্বর হল,কুমুদি তখন সাইকেল নিয়ে বাঁদিকে ঘুরতে পারত না। বাঁদিকে যেতে হলে,ডানদিকে গিয়ে গিয়ে নানা ঘুরপথে আসতে হত। আর,দ্বিতীয় সমস্যা টি হল, সেই বয়েসে একটু বেঁটে হওয়ায় সাইকেলের প্যাডল অব্দি পা পৌঁছালেও, সাইকেলের সিটে বসা অবস্থায় মাটিতে পা যেত না। তাই সাইকেল হঠাৎ থামাতে হলে শুধু ব্রেক টিপলে কাজ হত না, কুমুদি আশপাশে দাঁড়ানো কোন মেয়ের কাঁধে একটু ভর দিয়ে, খুচুত করে ছোট্ট লাফ মেরে নীচে নেমে সাইকেল থামিয়ে ফেলত ।
দ্বিতীয় সমস্যাটি দূর করবার জন্য কুমুদি চেষ্টা করে যাচ্ছিল,তবে কোন অসুবিধা ছিল না -একবার সাইকেলে উঠে পড়তে পারলেই বাঁই বাঁই ছুটে যাওয়া,পায়ের নীচে অবাধ গতি আর কানের পর্দায় শনশন হাওয়া কাটা,আহা সেই কিশোরীবেলার আনন্দ উড়ান!!! কুমুদির মত আরো অনেকেই ছিল,দেখেশুনে ভূষণদা যা বলত তার মর্মার্থ হল,এরা সব রাণী দুর্গাবতীর মত,একবার উঠে পড়লেই পায়ের তলায় দুনিয়া। দুর্গাবতী সাইকেলে উঠতে বা চালাতে পারতেন কিনা,এসব কূট প্রশ্ন কেউ করত না।
কিন্তু,জীবনে কোন সুখই দীর্ঘস্থায়ী হয় না,সামান্য সাইকেল চড়া-সেও কুমুদির কপালে সইল না।
সেদিন ব্রতচারী আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা গুরুসদয় দত্তর জন্মদিন উপলক্ষে সমবেত প্রার্থনার সময় কুমুদি ও আরো কয়েকজনের প্রবন্ধ পাঠ করার কথা ছিল। সেই নেটবিহীন সময়ে কুমুদি তার লেখায় খুব বেশি তথ্য জোগাড় করতে পারেনি,সাইকেল চালাতে চালাতে সেটাই ভাবছিল ।এমন সময় দেখা গেল ক্লাস মনিটর সুমিতা ছুটতে ছুটতে আসছে,"সাইকেল ছা আ আ ড়, যূথিকাদি কলিং।"
কুমুদি তাড়াতাড়ি তার বাহন সহ ভূষণদার ঘরের সামনে চলে এল,বাঁদিকে যেতে হবে,হাতে সময় কম, ঘুরে আসা সম্ভব নয়।একটু আগেই নেমে পড়ে সাইকেল ঠেলে ঠেলে নিয়ে যাব,ভাবতে ভাবতেই কুমুদি ব্রেক মেরে হাত বাড়িয়ে যে কাঁধটি পেল , চেপে ধরল।
কিন্তু এর পরে যা ঘটল,তা ভয়ংকর দুঃস্বপ্নেও ভাবা যায় না।
এক সেকেন্ডেরো কম সময়ে কুমুদি আবিষ্কার করল সেই কাঁধটি সাদা ইউনিফর্ম পরা নয় মোটেই,বরং গোলাপী সিল্কের ব্লাউজশোভিত আর দুধে আলতা রঙের। ।সাইকেল চড়িয়েদের নামিয়ে দিয়েই মেয়েরা যেমন সরে যায় টুক করে,কাঁধের মালকিন তেমনটি পারলেন না, কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে কুমুদি ধরেই রইল আর টের পেল কোন অদ্ভুত কৌশলে সে বেশ নরম ,অসাধারণ বিদেশী সুরভিমাখা,সিল্কের শাড়ী পরা একটা কিছুর ওপর পড়েছে,আর সেই জিনিসটাও সাইকেল ও তার চড়িয়েকে নিয়ে সবশুদ্ধু ধীরে ধীরে মাটিতে বসে যাচ্ছে।
সকলের নিশ্বাসের শব্দ অব্দি যেন শোনা যাচ্ছে,এত ভয়ঙ্কর নীরবতা।
প্রাণপণে সাহস সঞ্চয় করে একটা চোখ সামান্য ফাঁক করে যা দেখা গেল,তাতে মনে হল বাকী জীবনটা চক্ষু বুজে কাটাতে পারলেই ভাল।
ধরাশায়ী প্রিন্সিপাল ম্যাডামের কোলের কাছে কুমুদি তার সাধের সাইকেল নিয়ে পা ছড়িয়ে বসে আছে ,সেই ম্যাডাম যাঁর গাড়ী বিবেকানন্দ রোডে পড়লেই সারা স্কুলে,( টিচার্স রুম সহ ) পিনড্রপ সায়লেন্স নেমে আসে,যাঁর মুখের দিকে তাকানোর হিম্মত এই স্কুলে আঙুলে গোনা কয়েকটি মেয়ের হয়েছে,যাঁর চটির বা গলার আওয়াজ পেলে বেথুন স্কুলের মেয়েরা তো বটেই , পাশের স্কটিশ কলেজিয়েট স্কুলের ছেলেরা পর্যন্ত শান্ত হয়ে যায়।
অনন্তকাল পর,মানে তাই মনে হয়েছিল,ভূষণদার গগনভেদী হাহাকার শোনা
গেল -”সত্যনাশ হই গিলা রে এ এ।” কয়েকজন মেয়ে ছুটে এসে সাইকেল তুলে দিল,তারপর ভূপতিত ম্যাডামকে সভয়ে দূর থেকে দেখে নিয়ে অন্য টীচারদের ডাকতে গেল। তাঁরা তো পড়িমড়ি করে স্মেলিংসল্ট,লাল ওষুধ,হাতপাখা ,তোয়ালেরুমাল যে যা হাতের কাছে পেলেন ,নিয়ে দৌড়ে এলেন।
যদিও নিজেই উঠে বসেছিলেন,তাও সকলে মিলে আস্তে আস্তে ধরেটরে ম্যাডামকে দাঁড় করিয়ে দিলেন আর মেডিকেল রুমে নিয়ে চললেন।
মাটিতে বসে কুমুদির ততক্ষণে এইগুলো ভাবা হয়ে গেছে-
১। স্কুল থেকে নির্ঘাত তাড়িয়ে দেবে,কৃষ্ণনগর স্কুলে থাকলেই হতো,কলকাতায় এসে দেখচি হায়ার সেকেন্ডারীও পাস করা হোলো না,
২।বরানগরে হাম্বুপিসীমার বাড়ি,কাছেই রামকৃষ্ণ মিশন,
৩।ব্যারাকপুরে ছোটমাসী থাকে,মাদার টেরেসাকে ভালভাবে চেনে -এই দুটো জায়্গায় গেলে একটা গতি হবেই,কিন্তু অংক বইএর মলাটে লুকনো পাঁচ টাকা দিয়ে কি যাওয়ার ভাড়া হবে?
৪। প্রিন্সিপ্যাল ম্যামের কি উচিত হল এইসময় মাঠে দাঁইড়ে থাকা?
চারদিকে জড়ো হওয়া মেয়েরা এইরকম সব উপদেশ দিতে লাগল,যার যা মনে এল -
-বাড়ি চলে যা,
-কান্না জুড়ে দে,
-আর কোনদিন সাইকেল চালাব না-লেখ দুশোবার,
-কান ধরে দাঁড়িয়ে থাক প্রেয়ার হলের বা ক্লাস সিক্সের সামনে।
তখনই মনে পড়ল,
"ডরাইলেই ডর,ফাইল দিলে আর কিসের ডর?"
যেন কিছুই হয়নি এমনভাবে উঠে পড়ে কুমুদি প্রেয়ার হলে গেল,সেই লেখাটি পড়ল,সব ক্লাস করল।
ছুটির আগে প্রিন্সিপাল ডেকে পাঠালেন,ঘরে ঢুকেই কুমুদি মাথা নিচু করল
"এক্সট্রিমলি সরি ম্যাম -"
ম্যাম শান্ত স্বরে বললেন,"কেন? তুমি কি ইচ্ছে করে আমায় ফেলে দিয়েছ? যে অপরাধ স্বেচ্ছায় করোনি তার জন্য ক্ষমা চাইবে না।আমার কিছু হয় নি,তোমাকে এটা বলতেই ডাকলাম।"
কিন্তু ক্ষতি যা হবার তা হল,ভূষণদা সব সাইকেল তালাবন্দী করে রেখে দিল,হাজার অনুরোধেও খুলে দিল না। নাকি আমাদের জন্য ওর চাকরি চলে যাবে,বাড়িতে মানি অর্ডার পাঠাবে কেমন করে?
কিছুতেই বোঝনো গেল না যে - ডরাইলেই ডর।
২
কুমুদি ফিসফিস করে "কাকু,কোন্নগরের বাড়িতে একটা পুরনো সাইকেল ছিল না?"
নারায়ণকাকু আরও নীচু স্বরে, সাংঘাতিক ষড়যন্ত্র করার ভঙ্গীতে বলেন" আসে তো অ্যাখনও,ক্যান,তুই চালাইতে শিখসস নাকি? চালাইবি গরমের ছুটিতে?"
কুমুদি একটু আশ্বস্ত হয়,"হ্যাঁ,পারি চালাতে,তবে খুব ভাল শিখিনি এখনো।অ কাকু,একটু আচার খাবে? সাইকেলটা কি একদম ঝুরঝুরে হয়ে গেছে নাকি গো? কোথায় আছে?"
"Zলপাইএর আচারটা আন দেহি। হ,সাইকেল আসে ভুটকির ঘরে (ভুটকি হল বাড়ির পোষা কিন্তু বিকট বন্যস্বভাবের ছাগল),কন্ডিশন দিব্য আসে,তরা কোন্নগর Zআওনের আগেই সারাইয়া সুরাইয়্যা,লিকটিক ঠিক করাইয়া রাখুম অনে। পুরান আমলের জিনিস,সহজে বইস্যা যায় না।"
“ভুটকির ঘরে?” ভয়ংকর বোদা গন্ধ মনে পড়ে কুমুদি একটু দমে যায়।
"আরে ,বে এ শ কইরা ধোয়াইয়া দিমু ত,গন্ধফন্ধ উইড়্যা zআইব গিয়া। এই গরমের ছুটিতে সাইকেলটা শিইখ্যা ফ্যালা দেহি। তর বাবামা দাদু এরা একটু আধটু চিল্লাচিল্লি করব,সে আমি ম্যানেজ করুম অনে।
আরে ডরাইলেই ডর!
কথা পাক্কা,এইবার তবে আচারটা---"
পাঠক পাঠিকাদের মধ্যে যাঁরা সাইকেল,স্কুটি,বাইক , চারচাকা বা অন্য কোন বাহন চালিয়েছেন ,তাঁরা জানবেন একটু শেখা বা বলা ভাল চালানোর স্বাদ পাওয়ার পর বাহনটি হস্তচ্যুত হলে কেমন অস্থির অস্থির লাগে,কোন কাজে মন বসে না।ভূষণদার অবিমৃষ্যকারিতার পর কুমুদিরও তাই হয়েছিল।রাস্তায় লোকে সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছে দেখলে প্রাণ হু হু করে উঠত,খবরের কাগজ দেয় যে ছেলেটা,ভোরবেলা একদিন তাকে ডেকেওছিল,"তোমার সাইকেলটা একটু ধার দেবে? "সে কিছু বলার আগেই মায়ের আবির্ভাব,"ছি ছি,ঐ ছেলেটার সঙ্গে কী কথা বলছ?" কানমলা,চড় ইত্যাদি ইত্যাদি। সে বড় রক্ষণশীল সময় ছিল।
কুমুদি অবশ্য দমে যাওয়ার পাত্রী নয়,ভাবতে ভাবতে মানসচক্ষে ভেসে উঠল তাদের কোন্নগর গ্রামের বাড়ির সাইকেলটির চেহারা। অন্যান্যবার গরমের ছুটিতে কুমুদি কোন্নগর যাওয়ার উৎসাহ পেত না,কিন্তু এবারের গল্প আলাদা।কুমুদি অগতির গতি নারায়ণকাকুকে ধরে পড়ল। তারপরেই এই বাক্যালাপ।
কোন্নগরে এসে কুমুদির মনে হল,আহা,স্বর্গ থেকে দেবতারা নেমে এসে ঘড়া ঘড়া মোহর রেখে গেলেও এত আনন্দ হত না। প্রায় চল্লিশ বছরের পুরনো সাইকেলটি সারিয়ে কাকু প্রায় নতুন করে ফেলেছেন,শুধু ক্যাটকেটে সবুজ রংটা না করালেই ভাল ছিল। গোপন চুক্তি অনুযায়ী জিমির ঘরের (কুকুরের ঘর) পেছনে,চালার নীচে দাঁড়িয়ে আছে পক্ষীরাজ।
কুমুদিরে আর পায় কেডা?
ভোরবেলা উঠে শান্ত গোবেচারা মুখে কুমুদি একটু বইটই নিয়ে বসে,নটা নাগাদ ছোটকাকা আপিসে বেরিয়ে যান,মা বুথ সায়েবের বাচ্চার চেয়েও কাঁদুনে ও ঘ্যানঘেনে ভাইকে নিয়ে মহা ব্যস্ত হয়ে পড়েন।আর কুমুদি লাফিয়ে উঠে বেরিয়ে পড়ে সাইকেল নিয়ে।
মোহন অর্থাৎ মালী-কাম ছাগলকুকুরদের দেখাশোনাকরার লোক-কাম পাহারাদার-কাম বাজার সরকার অবশ্য ভয় দেখায়," দিদিমুনি,সঅব বলে দোব বাবুদের-"
কুমুদি তাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে গেটের ধাপি থেকে লাফিয়ে সাইকেলে ওঠে ।
প্রথম প্রথম একটু অসুবিধে হলেও এখন চমৎকার চলছে বাহনটি,ভুটকির গায়ের পদ্মগন্ধ অবশ্য এখনো ভুরভুর করে, পরোয়া না করে মহানন্দে কুমুদি গ্রামের রাস্তায় রাস্তায় চালিয়ে বেড়ায় ,বাঁদিকে ঘুরতেও শিখে গেছে। কেবল নামার কায়দাটা এখনো ঠিক আয়ত্বে আসেনি একটু ধরতাই লাগে। কুমুদি কোন গাছের গুঁড়ি বা ঐজাতীয় কিছুতে ভর দিয়ে নামে,অভাবে কোন পথচারীকে ডাকে,ও কাকু,একটু নামিয়ে দিন না।সেই মাছওলা,চুড়িওলা বা অন্যকিছুওলারা নামিয়ে দিত বটে,কিন্তু গ্রামে কুমুদি মোটামুটি ফেমাস ফিগার হয়ে গেছিল-দাশগুপ্তবাড়ির সবুজ সাইকেলঅলা মাইয়্যাটা নামে।
কিন্তু এত সুখ কি আর কপালে সহ্য হয়? ভাগ্যাকাশে যথারীতি কালো মেঘ ঘনিয়ে
এল ।সেদিন কাকা একটু তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেছেন আর মোহনকে বক দেখিয়ে কুমুদি বেরিয়ে পড়েছে। প্রাণ খুলে "রামভজনের গিন্নিটা,বাপরে যেন সিংহীটা"এই গানটা নানারকম সুরে তালে গাইতে গাইতে হু হা হু হা চালাচ্ছে,হঠাৎ খ্যাল হল,একটু দূরে এসে পড়েছে,প্রায় হিন্দিঠাকুমার বাড়ির কাছে।
হিন্দিঠাকুমা গ্রামের প্রায় সকলেরি ঠাকুমা ছিলেন,এতখানি লম্বাচওড়া,টকটকে ফর্সা রং ফেটে পড়ছে ,একমাথা ধপধপে সাদা চুল,জ্বলজ্বল করছে, সর্বাঙ্গে গয়না ;এমন কী কোমরেও একটি মোটা চন্দ্রহার । ব্যক্তিত্বে,উপস্থিতবুদ্ধিতে কারো চেয়ে কম ছিলেন না,রোজ একদিনের বাসী খবরের কাগজ পড়তেন,রেডিও শুনতেন,সর্বদা কুঁচি দিয়ে শাড়ি পরে থাকতেন। হিন্দিদাদু জাহাজের এঞ্জিনীয়র ছিলেন,বছরের বেশির ভাগ সময় সমুদ্রে থাকতেন আর ঠাকুমা কোন্নগরের বাড়িতে প্রবল প্রতাপে তাঁর সাম্রাজ্য পরিচালনা করতেন। ছোটবেলায় লাহোর,আগ্রা ইত্যাদি জায়গায় ছিলেন বলে তাঁর মুখের ভাষায় অনেক হিন্দি বা উর্দু শব্দের মিশেল থাকত,যেমন তসরিফ রাখিয়ে,ফরমাইয়ে, মলকা মসুর,খিড়কী(জানলা অর্থে)।সাধারণ নিরামিষ তরকারিতে গরম মশলার মত ছিল তাঁর মুখের ভাষা যা ছোটদের কাছে ভারী রহস্যময় ও আকর্ষক ছিল ।
কুমুদি সবে দেখছে হিন্দিঠাকুমার বাড়ি আর কতটা দূর,এমন সময় কোথায় ছিল,এক ব্যাটা নেড়ি কুকুর ,সে হঠাৎ সাইকেলের একেবারে সামনে এসে ক্ষেউউ ক্ষেউ করে বেজায় বকাবকি শুরু করে দিল।কুমুদি কোনমতে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গিয়ে ভাবল,আপদ গেল।
ওমা , কুড়িগজ মত গেছে কি যায়নি,সে ব্যাটা আবার সাঙ্গোপাঙ্গ জুটিয়ে আরও জোরে ক্ষেউউ ক্ষেউউ ক্ষেউ ক্ষেউ করে সকলে মিলে তেড়েমেড়ে এল আর এতগুলো নেড়ি দেখে কুমুদি একটু ভ্যাবাচ্যাকা হয়ে গেল ।
"ডরাইলেই ডর,ফাইল দিয়া পড়লে আর কিয়ের ডর"
উপায়ান্তর না দেখে কুমুদি চালিয়ে দিল নেড়িদের মধ্যে,ভয়ংকর কাঁউকাঁউ আওয়াজ,দুটো ল্যাজ চাপা দেওয়া ,কয়েকটা বুদ্ধিমান নেড়ির ছুটে পালানো,এইসব পেরিয়ে এসে কুমুদি দেখল যে সাইকেল তাকে হিন্দিঠাকুমার বাড়ির উঠোনে এনে ফেলেছে,আর কিছুতেই ব্রেক লাগছে না। এবাড়ির মোহন বা অন্য কারো সভয় চিৎকার "গেল গেল ধর ধর" শুনতে শুনতে উঠোন,কুয়োতলা ইত্যাদি পার হয়ে সাইকেলসহ কুমুদি সোজা ঢুকে গেল ঠাকুমার মস্তবড় রান্নাঘরে,কচিকাঁচারা তখন ভাত খেতে বসেছে।
কুমুদি দেখল কিছুটা উনুনের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে কিছুটা ঠাকুমার দাঁড়িয়ে উঠে এক হাতে হ্যান্ডেল চেপে ধরার ফলে সাইকেল অবশেষে থেমেছে,আর সে বিশাল মুগডালের গামলার মধ্যে নেমে দাঁড়িয়ে আছে।
হিন্দিঠাকুমার রান্নার খ্যাতি সুদূরবিস্তৃত ছিল। অন্তত চল্লিশজন সেযুগের খাইয়ের উপযুক্ত ঘন কুসুমগরম সোনামুগের ডাল,প্রাণকাড়া গন্ধে বাড়ি ভরে গেছে, ঘি,গোটা জিরে,শুকনো ও কাঁচা লংকা আরও কী কী সব ডালে ভাসছে,আর তার মধ্যে শোভা পাচ্ছে হতভম্ব কুমুদি। মোহন ,এবাড়ির বাঘাকুকুর ও বাচ্চাদের চিৎকারে ( ও মা গো,বাঁচাও,বাঁচাও,মেরে ফেল্ল,চাপা পড়লাম,ঠাম্মা আ আ,বা বা আ,শীগগীরই এসো)যে যেখানে ছিল দৌড়ে এসেছে ,আগুন লেগেছে ভেবে বালতি বা ঘটিতে জলও এসেছে।
তবে এই সব আকস্মিক বিপদপাতে বেজায় হকচকিয়ে গেলেও অবাক বিস্ময়ে কুমুদি আবিষ্কার করল, সাইকেল সমেত সে কিন্তু পড়ে যায় নি, হতে পারে রান্নাঘরে, হতে পারে ডালের গামলার মধ্যে ,কিন্তু দাঁড়িয়েই আছে। যার মানে, কুমুদি সাইকেলকে একদিকে অল্প কাত করে মাটিতে পা ঠেকানোর কায়দাটা এই বিপর্যয়ের মধ্যেই শিখে নিতে পেরেছে।
কিন্তু রামভজনের গিন্নির গানটি গেয়ে এই সাফল্যে আনন্দ করার তখন সময় নাই,ঘরভর্ত্তি বাচ্চারা বেজায় হট্টগোল লাগিয়েছে-
“ও কুমুদি,রান্নাঘরে ঢুকে পড়লে কেন?”
“তুমি তো রাস্তায় চালাও,বাড়ির মধ্যে কেন?”
“ডালের গামলায় নামলে কেন,ভাত খাব কী দিয়ে?”
“খেতে দেরি হলে খেলতে যাব কখন?”
ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট বলে একটা কথা শোনা যায় আজকাল,যার সার্থক চেহারাটি হিন্দিঠাকুমা সেদিন দেখিয়ে গেছেন।
লহমার মধ্যে ঠাকুমা কুমুদিকে ডালের পুকুর থেকে বের করে একজন বৌমানুষকে ডেকে তার জিম্মা করে দিলেন,এবাড়ির মোহন হাতপা না ধুয়ে কেন রান্নাঘরে ঢুকেছে তার কাছে সেটা জানতে চাইলেন আর এসেই পড়েছে যখন,তখন সাইকেলটা নিয়ে গিয়ে পরিষ্কার করতে বললেন।
সেই বৌটি কুমুদিকে ধুইয়েমুছিয়ে একটা ডোরাকাটা শাড়ি পরিয়ে রান্নাঘরে খেতে বসিয়ে দিল। কুমুদি দেখল এইটুকু সময়ের মধ্যে মেঝেটেঝে পরিষ্কার হয়ে গেছে, চল্লিশজনের মত ডাল ও পুঁইশাকচচ্চড়ি(চাকার ছোঁয়া লাগসিল) রিজেক্টেড,একটি উনুনে মলকা মসুর ডাল ফুটছে,অন্যটিতে আধকড়াই তেলে সরু সরু করে কাটা আলু বুড়বুড় করে ভাজা হচ্ছে।
এক ব্যাচ আলুভাজা নেমে গেছে,সবে খাওয়া শুরু হয়েছে,এমন সময় উঠোনে কুমুদির ভয়ংকর রাগী ছোটকাকার আবির্ভাব হল,ট্রেন বন্ধ থাকায় বাড়ি ফিরে এসেছেন। বলা বাহুল্য দাশগুপ্তবাড়ির মাইয়ার কীর্ত্তিকাহিনী ততক্ষণে পাড়ায় পাড়ায় রটে গেছে।
কাকা সাইকেলের গল্প কিছুই জানতেন না,এইমাত্র মোহনের কাছে একটু শুনেছেন,কিন্তু ঠিক বুঝে উঠতে পারেন নি। ঘন্টা দুয়েক আগে বাড়িতে যে মেয়েকে ভালমানুষটি হয়ে অংক করতে দেখে গেছেন,এখন তাকে হলুদ শাড়ি পরে এতদূরের এক বাড়িতে বসে ঘাড় হেঁট করে ভাত খেতে দেখে,এবং নিজের প্রায় ভুলে যাওয়া বহু বছরের পুরনো সাইকেলটিকে ক্যাটকেটে সবুজ কিন্তু চালু চেহারায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নিজেকে সামলে নিয়ে দাঁত কিড়মিড় শুরু করতেই তাঁর তিরিশ সেকেন্ড লেগে গেল।
তার মধ্যেই শোনা গেল ঠাকুমার হাড়হিমকরা ভীষণ গর্জন -
"খবরদার পঞ্চু, খেতে বসেচে,ওকে কিচ্ছু বলবে না।
এতে ওর গলতি কোথায়?জানবে,গলতি সমস্ত তোমার তাউজীর,অউর কিসিকা নেহী,বিলকুল নেহী ।"
কাকুর মিউমিউ শোনা গেল," কী যে বল জেঠি! তিনি কতদূরে কোন সমুদ্রে জাহাজ চালাচ্চেন কে জানে,তাঁর কী দোষ?এই বাঁদর মেয়ের জন্য মানসম্মান সব ডকে উঠল।"
ঠাকুমার হুংকার আবার শোনা গেল,"গলতি নাই?এতবড় আলিশান মহল বানিয়েচে ,রসুইঘরের দরোয়াজায় একটা উঁচু দেহলিজ ঐ যাকে তোমরা বল চৌকাঠ-সেই জিনিস বানাতে পারে নি?দেহলিজ থাকলে কি আজ বিটিয়া সাইকেল নিয়ে দালের পাতিলায় এসে পড়ত? দাল গরম থাকলে আজ কত ভয়ানক খতরা হত,তা জান? হুঁঃ,বলে কিনা তাউজির গলতি নাই !"
দেহলিজ নয়,কথাটা হয়তো দেহলী হবে,নাকি হবে না-তাতে কী? সেই সত্য যা রচিবে তুমি।
তবে কোন্নগরে অনেক বাড়িতেই নাকি এই ঘটনার পর দেহলিজ বা দেহলী বা চৌকাঠ বানিয়ে নিয়েছিল।লোকজন কী ভীতুই না হয়!
ডরাইলেই ডর।
Review Comments
সোসাল মিডিয়া কামেন্টস