নন্দিতা সাহা
লেখক / সংকলক : iPatrika Crawler
নকশী কাঁথা
বেশ কদিন ধরেই হাঁসফাঁশ করছিলো প্রীতিকণা । বড় কষ্ট হয় যখন হাপড়ে টান ধরে। আগে আগে বাড়িসুদ্ধ সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়তো। কি হলো !কি হলো! এখন আর কেউ তেমন ব্যস্ত হয় না । বলে, এ ছোট বেলার বেরাম ,যাবার নয় । আর এখনতো তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকেছে । ভেবে আর কি হবে ! এখন বরং ভালয় ভালোয় -----! অনেক তো দেখল দুনিয়া, জীবনটা । এখন নাতির ঘরে পুতি! সে ও যথেষ্ট বড় । আর কিছু বাকি নেই প্রীতি কণার।
আজ বড় শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। উফ! মাগো! বেদম কাশি !!সময় আর নেই ! ছুটির ঘন্টা বাজল বলে! নাতি সুবল মাঝেমাঝেই এসে দেখে যাচ্ছে । সুবলের ছেলে শুভজিৎ। তার অবশ্য তেমন একটা সময় নেই । ও অনলাইনে সবসময় ব্যস্ত থাকে। শুভ্রজিৎ একেবারে আসবে । বারে বারে উঁকি দিয়ে কি আর হবে !
দেখতে দেখতে সেই শুভক্ষণ এলো। চোখ বন্ধ করলো প্রীতিকণা । যে যেখানে ছিল হুড়মুড় করে ছুটে এল। ডাক পড়ল পাড়ার জগু ডাক্তারের । নাড়ি টিপে ডেথ সার্টিফিকেট লিখে দিলো । তবে রাত এখন গভীর !এই বৃষ্টির মধ্যে কে আর বাইরে যাবে ! বরং সাদা কাপড়ে প্রীতিকণা কে ঢেকে রেখে দিল সুবল। পরম যত্নে সাদা কাপড় টা একবার মাথা অব্দি টেনে দিল । সুবল কেঁদে উঠল , কত ভালোবাসতো ঠাকুমা । সকাল হলেই বুড়ি কে কাঁধে নিতে হবে ! তার আগে একটু ঘুমিয়ে নেওয়া যাক ।
সবাই যার যার ঘরে গিয়ে ঘুম দিল।
** **** *** **** *** ****
কাক ভোরে ই ঘুম ভেঙে গেল সুবলের। ছেলে শুভ কে ডেকে তুলল। আর দেরী কেন! শুভস্য শীঘ্রম। আরেক বার ডুকরে উঠলো সুবল। সুবলের স্ত্রী কাজলা র ঘোমটার আড়ালে হাসি আর ধরে না। বলে ই বসল, ঢেঁকুর নাকি?
সুবল ঠাকুমার ঘরে গেল। সেকি! চক্ষু চড়কগাছ! ঠাকুমার মুখের ওপর থেকে সাদা কাপড় সরানো!ঠাকুমা কুতকুতে দুই চোখে জুল জুল করে তাকিয়ে আছে।
প্রীতিলতার চোখেও অবাক বিস্ময় ! দুইজনেই কি ভূত দেখছে !
নাতি সুবল তো ভূত ভূত বলে গোঁ গোঁ করতে করতে প্রায় দাঁতকপাটি লাগে আরকি। হাই স্মার্ট গাই শুভ্রজিৎ তারস্বরে চিৎকার করে উঠল ভু---ত ভু---ত । জীবনে এই প্রথম জ্যান্ত ভূত দেখলো! ভয় তো পাবেই।
নকশী কাঁথা 2
এইবার প্রীতিকণা কাঁপা কাঁপা গলায় বললো ,
––-––নারে !আমি ভূত না।আমি তগো ঠাকমা।
–-_-------কিন্তু তুমি তো কাল মরে গেছো ------------না মরি নাই
------------সে তো দেখতেই পারছি।
––-------- তাইলে। মরছি কউ ক্যান! এত্ তাড়াতাড়ি মরুম ক্যান!
–---------তবে? ডাক্তার কি ভুল !
ডাকো ডাক্তার। ভজু এলো। দেখল ঠাকুমা কে। ঠিকই তো! দিব্যি বেঁচে আছে। ভজু ডাক্তার অবাক ।
কাল নাড়ি ছিল না। শরীর ঠাণ্ডা ছিল। এখন তো শরীর গরম । কি ভেলকিবাজি রে বাবা !
ভজু ডাক্তার ই আবার সার্টিফিকেট দিল যে প্রীতিকণা বিনদাস বেঁচে আছে।
সুবলের তখন মাথায় খুন চেপে গেছে। রাগে চোখে কখনো সর্ষেফুল দেখছে, কখনো জবাফুল দেখছে ।ডাক্তার ওদের মিথ্যে আশ্বাস দিয়েছে। ওদের ঠকিয়েছে।ওদের আশা র আলো দেখিয়ে ছে। সুবল, ভজুকে এই মারে কি সেই মারে!
এমন সময় প্রীতিকণা কুঁইকুঁই করে বলে উঠলো ,ওরে মারিস না । আমি তো মইরাই গেছিলাম ।
--------- তো আবার বাঁচলে কিভাবে ?ইয়ার্কি !
খেঁকিয়ে উঠলো সুবল । প্রীতি কণা বলল, -------শোন শোন রাতের অন্ধকারে কত কি য্যান হইল আমিও ঠিক বুঝতে পারলাম না ।আসলে আমি মরছিলাম। । যমরাজের কাঁধে চইড়্যা স্বর্গেও গেছলাম। অবশ্য যমরাজের মুখটা দ্যাখতে পাই নাই । কি যে অন্ধকার ছিল চাইরদিকে।
---------তারপর ! পাগলের গল্প বল, আমরা শুনি।
---------তারপর স্বর্গের দরজার কাছে গিয়া আমারে কাঁধ থিকা নামাইল। সঙ্গে সঙ্গে গ্যাটের কাছে যে পাহারাদার ছিল সে চিল্লায় উঠলো ,নো এন্ট্রি ,নো এন্ট্রি। আমিতো শুনতাছি , যমরাজ কইলো,কেন নো এন্ট্রি? পাহারা দার কইল, আরে এখন তো গেট্ সিল হয়ে গেছে । এখন লকডাউন চলছে ।
আমি ভাবলাম হেইডা আবার কি! যমরাজ বলল, কিন্তু একে তো নিয়ে চলে এসেছি মর্তলোক থেকে।!
পাহারাদার বলল, ঠিক আছে আমি ভেতরে গিয়ে শুনে আসছি। সাথে সাথেই জিজ্ঞেস করল , এই বুড়ি কিভাবে মরেছে।
যম বলল, কাশতে কাশতে। বেদম কাশি।
শুনেই তো পাহারাদার দশ হাত পেছনে ছিটকা চইলে গেল," কি সর্বনাশ ! তবে তো একেবারেই ঢুকতে দেওয়া হবে না। কোন জায়গায় এর বাড়ি "।
-----কুসুমপুর।
-----ওরে বাবা সেখানে তো পাঁচজনের----- সেটা তো হটস্পট ! কি সর্বনাশ! যাও যাও এর থেকে দূরে থাকতে হবে । ফেরত দিয়ে এসো । এখানে মহামারী ছড়ালে, স্বর্গ মর্ত্য এক হয়ে যাবে যে।
--------তাহলে কবে আবার একে নিয়ে আসব
---------সে অনির্দিষ্ট কালের জন্য রেখে এসো ।
---------কিন্তু কিভাবে মরবে পরে !
-------- কেন! একসিডেন্ট করিয়ে দেব! ----------আরে এ যে সারাদিন বিছানায় থাকে অ্যাক্সিডেন্ট সম্ভব নয় ।
--------তাহলে হার্ট অ্যাটাক ।
--------হার্ট তো একেবারেই ইয়াং। এখনো দৌড়াতে পারবে।
পাহারাদার মাথা চুলকে কি ভাবল ।বলল, একে নিয়ে পরে ভাবা যাবে । খুব কমপ্লিকেটেড সিচুয়েশন। আমার পরে যার পোস্টিং হবে সে ভাববে। আমি এখন কেবল নো এন্ট্রি দেখছি।
------ কিন্তু সেদিন কি আর আসবে ! অনেক দেরি হয়ে যাবে না!!
---------মন্দ কি! ইতিহাসে র সাক্ষী হবে।
ভালইতো।
গল্প শুনিয়ে প্রীতিকণা থামল । সবাই যে যার জায়গায় চলে গেল। এইবার সত্যি সত্যি গলা ছেড়ে কাঁদতে শুরু করল সুবল, একেবারে অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে। নিজের স্বামীকে কি বলে সান্ত্বনা দেবে কাজলা! সে ও স্বামীর সাথে গলা ছেড়ে কাঁদতে শুরু করল। তাদের কান্নায় আকাশ-বাতাস ভরে গেল ।
প্রীতিকণা ধীরে ধীরে উঠে বসল।এই অগ্ৰহায়ন এ শুভর বিয়ে।বিয়ে হলে ই ছেলে হবে। ছেলের জন্য কাঁথা সিলতে হবে যে।
বিছানার পাশে রাখা বাক্স থেকে সূঁচ সূতো নিয়ে বসলো প্রীতি কণা। ফস্ ফস্ করে নকশী কাঁথায় নকশা কেটে প্রীতি কণার কাঁপা কাঁপা দুটো হাত তীব্র গতিতে এগিয়ে চলল।।