ঠান্ডা চোখের ত্রিদেবী



তামিমৌ ত্রমি




বিস্ফোরণ।  দাউদাউ। ঝলসে যাওয়া টায়ার। ইউনিফর্ম শিশুদের আনন্দলাফ মিলিটারি বুটের নায়াগ্রা ঝাঁপে তলিয়ে যাওয়া। তবু তারই মধ্যে আদম ঈভের  চুড়ি টেনে ধরে।  ঈভ সে চুড়ি উন্নাসিক ব্ল্যাকহেডস কাঁপিয়ে ভেংগে দিয়ে চলে যায়। কিন্তু কোথায় যাবে সে? তার বাবা মাকে তো মিলিটারীরা তার সামনে মাংসপিন্ড করে দিয়েছে। তার দিদিকে যখন আর্মির লোকটা একান্ন খন্ডে শক্তিপীঠ করছিল আর হাত দিয়ে তাকে ইশারা করছিল পালিয়ে যাবার জন্যে সেইদিনই তার একশো বছর পেরিয়ে গেছে। তার কোন পরিবার নেই। একটি প্রাগৈতিহাসিক ঝুলি আছে। কোথায় যাবে সে? তাই সে ফিরে আসে সেই চুড়িতে টান দেওয়া ছেলেটির কাছে। শেষ অংকে  একজন মানববোমা ফিরে যায় একজন মানবের বুকে। আহ, কি প্রশান্ত প্রগাঢ় বিস্ফোরণ!

'দিল সে'। যে যুগে নায়িকাকে মরা বাপের বুকে মাথা রেখে কাঁদতে হলেও আইশ্যাডো মাসকারা আর ক্যাটক্যাটে লিপ্সটিক পরতে হোত, সেখানে 'দিল সে' র মণীষা' র যেন আড়াইশো বছর বয়স। চোখ কোটরাগত। একটা বিছানা পেলেই যেন ঘুমিয়ে পড়বে। জিয়ন কাঠি আসবে না। এই সিনেমা আমাকে অবাক, আহত ও অনশ্বর করে। বিশেষ করে মণীষার স্নানদৃশ্য। শাহরুখের চোখ  ধীরে ধীরে দরজা ঠেলে ঢুকল। নয়নচোরেরা যখন  লিংগ গুহ্য নাভি পেরিয়ে অনাহত বিশুদ্ধ ছুঁয়ে আজ্ঞায় গিয়ে বিস্মিত ও স্থানু হল- মণীষা মাথায়  একঘটি জল ঢালতে ঢালতে ঘাড় ঘুরিয়েচোখ ভাসিয়ে দিল শাহরুখের দিকে।  ঠান্ডা ইস্পাতের চোখ। শাহরুখ যেন ক্যাপ্টেন নেমো। নো ওয়ান।   যে মেয়ে নিজের গোটা পরিবারকে কসাইদের হাতে মাংস হয়ে যেতে দেখেছে, তাকে  আবার  ঘটিহাতা মেয়েমানুষ মাফিক মাংস আগলানোর ঢং করতে হবে!  ওই আদ্যারূপী ইস্পাত -ঔদাসীন্যকে অতিক্রম করা পুরুষের সাধ্য নয়। তাই সে চিরকাল দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে থাকে- দর্শক,  ভক্ত, শরণার্থী  হয়ে।



চন্দ্রচূড়ের সংগে দেখা করতে এসেছে টাব্বু। দুজনেই দেখছে দুজনকে। কসাইয়ের করাতে শানের শব্দ।  অন্তিম  রক্তমাংস ধুকপুকবিশিষ্ট। গলায় ঘন্টা বাঁধা দুটি অবলা জীব  পরস্পরকে দেখছে। চন্দ্রচূড় আর টাব্বু।

দেখছে।

দেখছে।

দেখেই যাচ্ছে।

চন্দ্রচূড়ের দৃষ্টি ক্লান্ত। পুলিসের প্রহারে ক্ষতবিক্ষত চোয়াল, এক চোখ বোজা  আর এক অপাংগ চুঁইয়ে পড়া রক্ত-দৃষ্টি যতদূর অস্তমিত মুহ্যমান হতে পারে, ততদূর। কিন্তু তাব্বুর দৃষ্টি ঠান্ডা।  ফ্রিজ থেকে বার করা দুধের দুটি শবাধারে একটি করে নিস্পন্দ মার্বেল।  দুটি চোখ। তাব্বুর। সে চোখ দুনিয়াদারি বুঝে গেছে। সে বুঝে গেছে কিভাবে একটা ছোট্ট 'মাচিস' থেকে আগুন লেগে যায় চরাচরে। আগুনের আচে  চোখ সয়ে যেতে যেতে গল্পের শেষ উলটে যায়। প্রেমিকরা সন্ত্রস্ত হতে হতে সন্ত্রাসবাদী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে গরাদের ওপারে। শুধু ঠান্ডা চোখ আর দী- ঈ-ঈ-র্ঘ সায়ানাইড চুম্বন ছাড়া কিছুই দেওয়ার থাকে না। এ  বড় বিচিত্র অভিযাত্রা।আচ্ছা, এলার মুখে বিষের পাত্র তুলে দেওয়ার সময়  অতীনের চোখদুটোও কি টাব্বুর মতো ঠান্ডা ছিল?



সায়ানাইড। ধোঁয়া ধোঁয়া নীল। নীল গলা দেহ। নীলঅঞ্জনঘন মেঘের হারেম। বিন্দু বিন্দু বৃষ্টি রক্ষিতা। তার নীচে একটা ছাদ। সেই ছাদে 'যারা বৃষ্টিতে ভিজেছিল' তাদের একজন - ইন্দ্রাণী হালদার। ছাদ থেকে জামাকাপড় তুলছিল সে তড়িঘড়ি। বৃষ্টি আসছে। তার মধ্যে হঠাত বজ্র হাঁকলেন শাশুড়ি- বাঁজা মেয়েছেলে। ইন্দ্রাণী চোখ তুলেছিল। অপলক। ঠান্ডা। স্ফটিক। শাশুড়ি ঐ চোখের দিকে তাকাতে পারেন নি।  তার সোয়া মন যে জানে, সন্তানহীনতার জন্য আসলে তার ছেলেই দায়ী। তবু পৌনে মনকে তিনি পুরুষতান্ত্রিক টিক টিকোচিত করে রেখেছেন। কিন্তু শেষমেশ ধরা পড়ে গেলেন। বৌমা'র শান্ত শীতল আগুন চোখের কাছে। পালিয়ে গেলেন। তলিয়ে গেলেন।

ফিটিং বোতল। হাস - ফুল চেনস্টীচ সাদা টেপজামা, ভূত, কৃমি, ক্যান্সারফোবিয়া, অংক ক্লাস,  কোলাইটিস,  অংক খাতার পেছনে কবিতা লিখে গালাগাল দিনের পর দিন পেন্সিল হারিয়ে দুপুরের পর দুপুর লাঠির বাড়ি, পথের বাঁকে চৌরাস্তার মোড়ে রবিনজরুলি নয়নে চোখ পড়ে গেলে মন- জিহবায় রসার্ত চেটেপুটে ওড়নায় মুখ মুছে ঘরের মেয়ে ঘরে ফিরে আসা- গভীর রাত্রে কুন্তীমন্ত্রে সেই নয়নধরকে  পাশবালিশে আমন্ত্রণ- দুধের সাধ পাশবালিশে না মেটা জনিত কষ্টে পাশবালিশকেই 'মা' করে জড়িয়ে অশ্রুসিক্ত ঘুমিয়ে পড়া-



প্রতিটি কষ্ট প্রতিটি পরাজয় প্রতিটি মৃত্যুর মাঝখানে আমার এই ঠান্ডা চোখের তিন নারী দাঁড়িয়ে থাকে ব্রহ্মাণী বৈষ্ণবী মাহেশ্বরীর মতো। 'দিল সে' র মণীষা নিজের নষ্ট জীবন  ধ্বংস করে অনাবিল জগত সৃজনের পথ দেখিয়ে যায়। 'যারা বৃষ্টির..' ইন্দ্রাণী ছাদের দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়েও তার  মানহুঁশধর্ম পালন করে চলে আর  'মাচিস' এর টাব্বু নীলকন্ঠে সায়ানাইড ধারণ করে ট্রাকের খড়ে চিতা এলিয়ে  এগিয়ে চলে কল্পান্তের পথে।