অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়
লেখক / সংকলক : iPatrika Crawler
প্রহসন
ভদ্রলোকটির সাথে আমার প্রথম পরিচয় হয়েছিল মহাষ্টমীর দিন সন্ধ্যে বেলায় দক্ষিণ দিল্লীর কালীবাড়ি প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠান দেখতে গিয়ে । অরূপের মধ্যস্থতাতেই আমাদের দু’জনার পরিচয় । আমার সাথে ভদ্রলোকের প্রাথমিক পরিচয় করিয়ে দিতে গিয়ে অরূপের মুখেই প্রথম উচ্চারিত হয়েছিল – ওনার নাম শ্রীঅনিরুদ্ধ বোস । একাধারে নাট্যকার এবং দিল্লীর একজন অন্যতম নির্দেশক । পুঁজোর পরে ফি.কি অডিটোরিয়ামে আমরা যে নাটকটি মঞ্চস্থ করতে চলেছি সেটা এনারই লেখা এবং এনারই নির্দেশনায় ।
অরূপের মুখের কথা শেষ হতেই অনিরুদ্ধবাবু আমার সাথে ইংরেজি কায়দায় করমর্দন করার অবসরে আর একটু যোগ করে বলেছিলেন– অনেক দিন হলো লেখালিখি আর নাটকীয় বিষয় নিয়ে খেলা করছি । মাঝে তো বেশ কয়েক বছর যাবৎ এসব একেবারে ছেড়েই দিয়েছিলাম । হঠাৎ কি কারণে ভীষণ অরুচি ধরে গিয়েছিল । তবে নেশার জিনিষ বেশি দিন ছেড়ে থাকা যায় না । তাই আবার আকৃষ্ট হয়ে পড়েছি । দেখছেন তো দুনিয়া জুড়ে কত অন্যায়, অনাচার ও ব্যভিচার হয়ে চলেছে এসব মুখ বুজে সহ্য করে জড়ভরত হয়ে দিন কাটানো সৃষ্টিশীল মানুষের পক্ষে বড়ই কঠিন কাজ । চলমান পরিস্থিতির জীবন্ত প্রতিচ্ছবির আরেক নাম সাহিত্য । সাহিত্যে বর্ণিত উপাদান সংগ্রহ করেই রচিত হয় যুগের ইতিহাস । নিজের অজান্তে আবার এক সময় লিখতে শুরু করেছি । আর ক্ষিপ্র গতিতে কোন কিছু করা আমার ধাতে সয় না । একটা কথা আমি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করি যে, আমি লেখনী ধারণ না করলেও পৃথিবী নিজের কক্ষপথে কালের নিয়মে ঠিক এগিয়ে যাবে আমাকে তোয়াক্কা না করেই । সুতরাং আমার যখন কোন দায়বদ্ধতা নেই, আমি যখন নিজেকে খুশি করার জন্যে কেবল লিখি তাহলে সময় নিয়ে ভেবে-চিন্তে সমাজকে উৎকৃষ্টতম উপহার প্রদান না করার যুক্তিসংগত কোন কারণ দেখি না । অবশ্য এটা আমার একান্ত ব্যক্তিগত অভিমত । এই ব্যাপারে আমার মতের সাথে আপনার অমিল হতেই পারে । এতে আশ্চর্য হওয়ার মতো কিছু নেই । সংসারের নানা ঝামেলায় মাঝেমধ্যে অবশ্য পেরে উঠি না । তবু চেষ্টা করি যথাসম্ভব সংসারের গন্ডি থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে । বিশ্বাস করুন থিয়েটার আমার প্রাণ । আমার বেঁচে থাকার ‘ভাইটাল ফোর্স‘। বাংলায় একটি বহুল প্রচলিত কথা আছে না ‘না-পারি গিলতে না-পারি ফেলতে’ আমার হয়েছে সেই অবস্থা । বয়স হয়ে গেল পঞ্চাণ্ণ তবু ছেলেমানুষী গেল না এখনো । তাই সমানে লড়ে যাচ্ছি । জানি না আর কতদিন চালাতে পারবো এইভাবে ।
উত্তরে বলেছিলাম– থিয়েটারের প্রতি এতটাই যখন দুর্বার আকর্ষণ তাহলে ত্যাজ্য করার কথা ভাবছেন কেন? চলতে দিন যেভাবে চলছে । নট সম্রাট গিরিশবাবুকেও শ্রীশ্রীঠাকুর স্বয়ং নিজ মুখে বলেছিলেন ‘থ্যাটার ছাড়বি ক্যানে এতে যে লোকশিক্ষে হচ্ছে’ । কথাটা অবশ্য বলেছিলাম একটু ব্যাঙ্গ করেই । তীর্যক ইঙ্গিত বহন করছিল । কারণ ওনার মুখে বলা কথার পরিপ্রেক্ষিতে আমার মনে হয়েছিল নিজের সম্পর্কে অতিকথনের অভ্যেস থাকে অনেকের বোধহয় উনিও তাদেরই একজন ।
আমার অন্তর্গভীরের ভাবখানা ভদ্রলোক হৃদয়ঙ্গম করতে না পেরে সহজ সরল ভাষায় তিনি নিজের মনের ভাব প্রকাশ করেছিলেন এই বলে– তা ঠিকই বলেছেন আপনি । তবে সর্বনাশা সেই নেশার অনেকটাই এখন নিম্নগামী । স্বমুখে নিজের কথা বললে কতটা বিশ্বাস করবেন জানি না, হয়তো ভাবতে পারেন অতিরঞ্জিত করে বলা । তা কিন্তু নয় । এককালে বিহারের পাটনা শহরটি ছিল বঙ্গ সংস্কৃতির অন্যনম পীঠস্থান । একবার পাটনা জংশনে আমার দাদা ও তাঁর পরিবারকে ট্রেনে তুলতে গিয়ে ভীড়ের চাপে আমার মা সময় মতো নামতে পারেননি ট্রেন ছেড়ে দিয়েছিল । টিটিকে এই কথা বলায় তিনি সব কথা শুনে বলেছিলেন– আপনি অনিরুদ্ধ বোসের মা ? সেই অর্থে আপনি আমারও মা । আপনি নিশ্চিন্ত মনে বসে থাকুন । মোকামায় পৌঁছোলে আমার ডিউটি শেষ হয়ে যাবে । আমি স্বয়ং আপনাকে নিয়ে গিয়ে আপনার বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আসবো । আমার এই কথায় আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পাচ্ছেন আমি এককালে কতটা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলাম । তখনকার কথা বলে শেষ করা যাবে না আমার তখন প্রচূর নাম-ডাক ছিল । এক একটা থিয়েটার মঞ্চস্থ হতো আর পত্রিকায় ছবি সহ খবর ছেপে বেরুত । একদিন সময় করে আসুন আমার বাড়ি । মেডেল, পেপার কাটিং সযত্নে রাখা আছে আপনাকে দেখাবো । ওগুলিই আমাকে প্রকৃত প্রেরণা জোগায় ।
উত্তরে বলেছিলাম – আসবো একদিন । দিল্লী শহরে আপনার মতো লোকের খুব অভাব । সৃষ্টি সুখের উল্লাসে আপনি যে সারা বছর মেতে থাকেন এটা সত্যি প্রশংসনীয় ।
তিনি আবার বলতে শুরু করেন – সে একটা দিন ছিল বটে । থিয়েটার পাগল লোক বলতে যা বোঝায় আমি ঠিক তেমনটিই ছিলাম । এতাবৎ বহু জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিত্বের সাণ্ণিধ্য লাভে ঋদ্ধ হওয়ার সুযোগ পেয়েছি । আমি নিজেকে ধন্য মনে করি এই ব্যাপারে ।
ভদ্রলোককে থামিয়ে দিয়ে বলেছিলাম– পুঁজোর পরে অডিটোরিয়ামে মঞ্চস্থ না করে তারচেয়ে বরং এই পুঁজো মন্ডপে মঞ্চস্থ করলেই পারতেন ।
আমার কথার জবাবে তিনি বলেছিলেন– সেটা অবশ্যই করা যেত কিন্তু আমার মন তাতে সায় দেয় না । তাতে অসুবিধে এই যে, মুষ্ঠিমেয় কিছু লোক নাটক দেখার নামে হয়তো নিছক সময় কাটানোর একটা সুবর্ণ সুযোগ পেতেন কিন্তু তাতে আমাদের উদ্দেশ্য সফল হতো না । আসল কথা কি জানেন ? Everyone will ask you for criticism but they only want praise আমি এই মতবাদে বিশ্বাসী । এই খোলা চত্বরে শিল্প কলার প্রকৃত মূল্যায়ন করার লোক পেতাম কোথায় ? আমাদের উদ্বুদ্ধ করার জন্যে দর্শকদের কাছ থেকে ন্যূনতম সাড়াটুকু পর্যন্ত কপালে জুটতো না । জাত-কুল-মান সবই খোয়া যেত । কলা-কুশলীদের পারিশ্রমিকটাও মারা যেত । অর্থাৎ আর কিছু না হোক ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ তৈরী হতো । যাকে বলে বেগার খাটা । আমার তাতে ভীষণ অরুচি । আমি চাই মাছের তেলে মাছ ভাজতে । যারা মন-প্রাণ ঢেলে দর্শকদের আনন্দদান করবে পরিবর্তে শূন্য হাতে বাড়ি ফিরবে সেটা মোটেই ভালো দেখায় না । এই কারণে অডিটোরিয়াম ছাড়া মঞ্চস্থ করতে মন সায় দেয় না । কথায় আছে Art flourishes when it is half trade and half art । সাধারণ দর্শকদের মধ্যে আর্টের গুণগ্রাহী ক’জন থাকেন বলুন তো ? কিন্তু যারা ট্যাকের পয়সা খরচ করে সময় বাঁচিয়ে টিকিট করে প্রক্ষাগৃহে শুধুমাত্র থিয়েটার দেখতে আসেন তাঁরা সাধারণ দর্শকদের তুলনায় অনেক বেশি বোদ্ধা এটা মাথায় রাখবেন সর্বদা । তাঁদের একটা হাততালি এক টুকরো হিরের চেয়ে অনেক বেশি মূল্যবান । তাঁরাই হলেন প্রকৃত অর্থে থিয়েটার প্রেমী । তাঁরা দর্শক কাম গবেষক । তাঁরা রীতিমতো থিয়েটার নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করেন । আমি থিয়েটার করি কেবল মাত্র তাঁদেরই জন্যে । আমার Mass দরকার নেই আমার দরকার Class ।
তাঁর কথা শুনে মনে হয়েছিল লোকটির নাম, যশের প্রতি খুব লোভ । তাঁকে কৌতৃহলী হয়ে প্রশ্ন করেছিলাম – আপনি দিল্লীতে কত দিন যাবৎ আছেন ?
--বিগত দশ বছর যাবৎ । এখানকার কিছু মানুষের সাথে আমার আগে থেকেই যোগাযোগ ছিল । এখানে আসা মাত্র পুরনো নেশা আবার পেশায় পরিনত হয়ে গিয়েছে । জানেন আমার চাকরি, বিবাহ সবই এই থিয়েটারের দৌলতে পাওয়া । আমার জীবনে থিয়েটারের অসীম অবদান । তাঁকে আমি কোন ভাবেই অস্বীকার করতে পারি না । থিয়েটার জগতের সাথে যারা ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছেন তাঁরা অনেকেই আমাকে Constantin Stanislavsky-র সঙ্গে তুলনা করে থাকেন । আমি শুধু অভিনয়টুকু করি মাত্র । কারোকে অনুসরণ করে আমি কখনো মঞ্চে উঠি না । সুতরাং কার মতো অভিনয় করি তা আমি নিজেই জানি না, কারণ নিজের অভিনয় তো আমি স্বচোখে দেখতে পাই না ।
আমি তাঁর কথায় বিশেষ আমল না দিয়ে খোলা স্টেজের দিকে তাকিয়ে ছিলাম । অনুষ্ঠান শেষ হয়ে গিয়েছিল । তিনি হঠাৎ বলে উঠলেন– দাদা, আমাকে ক্ষমা করবেন । ছেলে দুটো আমায় ডাকছে । ওরা দু’জনেই ডিসএবেল্ড । তাঁর বেদনা বিঁধুর মন্তব্যে আমি রীতিমতো ভূত দেখার মতো চমকে উঠেছিলাম সেদিন । তাঁর পিঁছু নিলাম ছেলে দুটোকে দেখার উদ্দেশ্যে । বড়টি বছর সতেরো-আঠেরো আর ছোটটি প্রায় এগারো-বারো । বড়টি পলিও রোগে আক্রান্ত । কারো সাহায্য ব্যতীত সে উঠে দাঁড়াতে পারে না । দেখলাম কোমড় থেকে পা পর্যন্ত স্টিলের ফ্রেমে তৈরী প্রযুক্তি বিদ্যার আধুনিক নিদর্শন । ভদ্রলোক ঝুকে বসে কি সব করলেন তারপর পরম স্নেহে দু’হাতে বুকে জড়িয়ে ধরে ছেলেটিকে টেনে তুলে দাঁড় করালেন । ছেলেটি অসহায় ভাবে শক্ত হাতে ভদ্রলোকের কাঁধে ভর করে দাঁড়িয়ে রইল । ছোট ছেলেটি বোবা । বোকা বোকা চেহারা । অবাক বিস্ময় ভরা নিস্পাপ দুটো চোখ মেলে পুঁজো মন্ডপের আলোকমালা দেখতে ব্যস্ত ছিল ।
ভদ্রলোক আমার সাথে শেষবারের মতো করমর্দন করে বলেছিলেন– জানেন, মানুষ হলো এক দ্বিপদ ভাড়বাহী গৃহপালিত জন্তু । কিন্তু এখন আর আগের মতো ভাড় বইতে পারি না । কষ্ট হয় । ভিড় ঠেলে এগিয়ে যেতে যেতে তিনি আরো বলেছিলেন – মানুষের সম্পূর্ণ জীবনটাই একটা নাটক ।
এতক্ষণ যাবৎ তাঁর কথা শুনে তাঁর সম্পর্কে মনে মনে কত কি ধারণা করেছিলাম ! কিন্তু অসহায় ছেলে দুটোর দিকে তাকিয়ে ভদ্রলোকের প্রতি আমার মনটা নিমেষে সহানুভূতি ও অনুকম্পায় ভরে গিয়েছিল । সেই মূহুর্তে নিজেকে আমার ভীষণ অপরাধী বলে মনে হচ্ছিল । এবার ব্যঙ্গ নয় নিজেকে ধিক্কা র দিতে ইচ্ছে করছিল । তাঁর মুখে বলা শেষ উক্তিটি আমার শ্রবণ ইন্দ্রিয়ে বারম্বার অনুরণিত হচ্ছিল ।
# # #
মানুষের মনের দুঃখ-কষ্ট, ব্যথা-বেদনাগুলি খুবই ক্ষণস্থায়ী । সময়ের ব্যবধানে যথারীতি তাঁর স্মৃতি যে কখন কোন মূহুর্তে আমার মনের অতলে ডুবে গিয়েছিল তা হলপ্ করে বলতে পারবো না । নির্দিষ্ট দিনে ফি.কি অডিটোরিয়ামে গিয়ে স্বচোখে দেখে তাঁর নাটকের মূল্যায়ন করার ইচ্ছে থাকলেও কোন বিশেষ কারণ বশতঃ যাওয়া হয়ে ওঠেনি ।
যদিও পরের দিন বাসে চেপে অফিস যাওয়ার পথে নেহাত সময় কাটানোর অছিলায় স্থানীয় একটি ইংরেজি খবরের কাগজে চোখ বোলাতে গিয়ে মনের আড়াল হয়ে যাওয়া সেই ভদ্রলোকের কথা পুনরায় মনে পড়ে গিয়েছিল । তাঁর লেখা ও নির্দেশনায় মঞ্চস্থ নাটক সম্পর্কে বহু প্রশংসায় ভূষিত ছিল সেদিনের প্রতিবেদনটি । যাকে বলে পঞ্চমুখে গুণগান । খবরের শিরোনামটি ছিল এই রকম- One more feather in Aniruddha Bose’s cap ।
খবরটা এক সময় পড়া শেষ হলে পরে মনে মনে ভাবছিলাম থিয়েটার সম্পর্কে ভদ্রলোক সেদিন যা কিছু বলেছিলেন তার একটুও অতিরঞ্জিত ছিল না । তাঁর কথার মধ্যে অহঙ্কারের লেশ মাত্র ছিল না । ভাবছিলাম বিধাতার অমোঘ অভিশাপে ক্লিষ্ট তাঁর মতো সহজ সরল মানুষটির পক্ষে থিয়েটারকে এত নিবিড় করে ভালোবাসার কি অর্থ ? যদিও তা পুরোটা না হোক কিছুটা অন্ততঃ আন্দাজ করতে পেরেছিলাম । কারণ তাঁর মতো অভিশপ্ত মানুষের বেঁচে থাকার পক্ষে ওটাই ছিল ইহজীবনের একমাত্র অবলম্বন! নিঃসন্দেহে সেই মূহুর্তে তাঁর কথা ভাবতে আমি বাধ্য হচ্ছিলাম ।