দিল্লিলিখন



পীযূষকান্তি বিশ্বাস 




আমাকে লিখতে হবে আর এক পৃথিবী

বীজ থেকে শুরু করে তরুরাজির পর্ণমোচী হওয়া

রৌদ্র থেকে চুষে নিয়ে

রসে রসে আপন গোপন অক্ষরে

লিখতে হবে আমায় এক সঞ্জীবনী বানী

পাতায় পাতায় সাংকেতিক বাক্যবন্ধনে

লিখে যেতে হবে আমায় দিল্লির এক বিনির্মাণ কাহিনী ।



এখনো আছে সেই জারণের অদ্ভুত রসায়ন

গলে যাওয়া মুখের ভিতর জিহ্বা কশিকায়

পিচ্ছিল হয়ে এলে বাল্কল সকল

এই চৈত্রে খিল খিলিয়ে


সবুজে সবুজে ঋতুমতী হয়ে ওঠে বুদ্ধজয়ন্তী পার্ক

স্তূপ থেকে জেগে ওঠে পাথুরি খনিজ

আমাকে লিখতে হবে অন্য পৃথিবীর আরাবল্লি রিজ



এক পৃথিবী মানে অনেক রচনা,

অক্ষর বিন্যাস

ধোলাকুঁয়ার উপর দিয়ে মুড়ে যায় যে মেট্রো ট্রেনলাইন

অপলক তাকিয়ে থাকি

ওড়না উড়িয়ে

এই গরমে কলেজ ফেরত কোনো ললনার দ্রুত চলে যাওয়া



কোথাও থেকে তার চুলের খুশবু হাওয়ায় উড়ে আসে

চলন্ত ট্রাফিক থমকে দাঁড়ায় এই তপ্ত শহরে

ঝান্ডেবালান হয়ে ঘূর্ণিপাকে যে ধুলো ঘিরেছে রাজপথ

যে ধুলো কোনোদিন উড়িয়েছিল তীব্র বেগে ধেয়ে আসা

শেরশাহের অশ্ববাহিনী

এতটা সহজ করে লিখতে পারিনি কখনো সুলতানি ইতিহাস

জলের মতো করে বুঝিনি কখনো মুঘলের সাম্রাজ্যবাদী ভাষা

এই যমুনার কৃষ্ণকালো স্রোতে

যখন আমি লিখতে চেয়েছি

কোন এক গুর্জর বালিকাবধুর হারানো কানপাশা ।



এক পৃথিবী লিখতে গিয়ে দেখি উদাসীন পাঠকের মুখ

সান্ধ্যকাল উপনীত হয় সফদরজঙ্গের চুড়ায়

দেখি জ্যোৎস্নার বিবর্ণযাপন

এক পৃথিবী লিখতে গিয়ে দেখি অন্ধকারে ঘনীভূত

পুরানো দিল্লির পণ্যবিপনন

চাঁদনি চক জেগে আছে হারেমের কন্যাদের গোঙানী সমেত

কপাল থেকে খসে পড়ে উপমা সংকেত

কোথাও পৌঁছাতে চায় রাত,

কোথায় চুপ হয়ে যায় ভাষা

কোথাও বাক্যেরা ফুরিয়ে যায় ঠোটে

রিংরোড বরাবর তবু সারি সারি লাইন বাই লাইন

মির্জা গালিবের পঙক্তি জ্বলে ওঠে ।






দেহ্‌লিজ




পা-খানি ওঠাতেই হয়,

পার করতে হলে দ্বার ,

পা'কে হয়ে উঠতে পারদক্ষী

আর যেখানে দরজা আর তার অনতিক্রম্য রেখা

পাকে সুরক্ষিত রাখতে এই তার এতটুকুই অঙ্গীকার

নিজেকে বন্ধ্যা রেখে অংকুর-সম্ভাব্য সেই বীজ

ঘরের সাথে ঘর করে যাচ্ছে সে

                             একান্তে দেহ্‌লিজ ।



হায় দরজা,

এ কিসের অহংকার

নাকি অহরহ গ্রীবার উপরে আটকে থাকা ভয়

                  অলক্ষ্যে চৌকাঠ বেড়ে যাওয়ার ?

একবার পিছন ফিরে যদি দেখো , সংসার

নিজেকে টপকে যাওয়া আর

                        হয়না দরজার ।



এভাবেও কি গণ্ডী এঁকে দেওয়া যায় ?

দৈর্ঘ্যে প্রস্থে বা যে কোন মাত্রায়

             মাইল থেকে মাইল

ভিতরে ভিতরে তবু গোপনে হেঁটে যাওয়া যাত্রায়

আমাদের এইতো বিচরণের সংজ্ঞা ,

এই তো আমাদের জমি, এই তো আমাদের আল

শৈশব থেকে হেঁটে আসা ধ্বনি তরঙ্গের সাথে

ভেঙ্গে যাওয়া        বয়ঃসন্ধি কাল ।



এটাই তো চেয়েছিলে পিতামহ, প্রপিতামহ,

                               সমস্ত পরিবার

দেহের প্রতিটা অঙ্গ কোষকে সুরক্ষা দিতে

বল্কলে ঘিরেছিল পরিধান

ঘরের নিরাপত্তাকে তাই ভেবেছিলো অগ্রাধিকার



নাকি আরও কিছু ছিল গোপন বক্তব্য

অলিখিত কোন সীমানা, কোন মাপজোক

যার জন্য চৌকাঠের হয়েছিল এক বোধ

নিজেই সে উঠিয়েছিল পা

নিজের কর্তব্যকেই সে

                   ভেবেছিলো দরজা



পা,

যে কোন দায়িত্ব বিশেষ

ঘরকে ডিঙ্গিয়ে যেতে চেয়ে

পার করে যেতে চেয়েছিল যে সীমানা

যাকে অধিবাসীরা ভেবেছিলো দেহ্‌লিজ

যাকে অতিক্রম করতে চেয়েছিল ঠিকানা



পার

তো করে যেতে হয় সমস্তকিছু একদিন

কারণ দেওয়ালেরও আছে এক জীবনচক্র

             মৃত্যুরও আছে এক অতীত

জঙ্ঘার ও আছে এক আয়ু,

             সীমানারও আছে এক মিথ



অপার বিশ্বাস,

অপার সীমানা নিয়ে এই বোধ

উদ্যত পা নিয়ে সমস্ত লড়াই

অন্তত: একবার তাই চৌকাঠ ভেঙ্গে

দেহ্‌লিজ পার করে যেতে চাই ।