কাঁচি



শবরী রায়







সন্ধেবেলায় কেউ এমন চুল খুলে রাখে নাকি?  চুলটা বাঁধ।' শাঁখ বাজানোর ফাঁকে বলে নতুনদিদা। বেজার মুখে জোরে জোরে চুলে চিরুনি চালায় রিনি। ' ও কিরে, সব চুল ছিঁড়ে ফেলবি নাকি? আস্তে...  আস্তে ' বলে হাত থেকে চিরুনিটা নিয়ে কাছে টানে মঞ্জুপিসি। নীলডুংরি গ্রামে হুজুর পীরের মেলায় যান ভক্তিমতি দিদা। সঙ্গে রিনি। ফেরার পথে দিদার বান্ধবী জুলেখা দাদির বাড়ি। দাদির নাতনী জাহানারা রিনির খেলার সঙ্গিনী। দাদি নিজের হাতে বছরে একবার রিনি, জাহানারাকে সুন্দর ফ্রক বানিয়ে উপহার দেন। লাল রেশমের কাপড় মাপ করে কাটছিলেন একটা বড় ধারালো চকচকে কাঁচিতে। সন্ধ্যেবেলা বিশাল বাড়িটার এঘরে ওঘরে ওরা লুকোচুরি খেলে। আরজুআপা, মকবুলভাই তার বন্ধু অলক সবাই লুকোচুরির শিল্পী। খেলার শেষে সিমুই খায় সবাই মিলে। দাদি চিবুক তুলে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে মুখ দেখেন শ্যামাঙ্গী রিনির। বলেন, তাকা.. আমার চোখে তাকিয়ে থাক। পলক ফেলবিনা। এই দ্যাখো পলক ফেলে। এই মাইয়া মানুষ মারবে। দাদি হাসেন হা হা করে। দ্যাখ, অর চোখ দ্যাখ।  মকবুলের চাচা আকরামুজ্জামান এসে দাঁড়ায়। কই দেখি, দেখি। বিরক্ত রিনি মুখ নীচু করে সিমুই খায়। চুলগুলো ঘামে পুরো ভিজে গেছে বলে আরজুআপা রিনির চুল খুলে দেয়। দাদি বলেন হায় আল্লা,  এ যে দেখি কালি চুল। নিজেকে কালিঠাকুরের সঙ্গে তুলনায় রাগ হয় রিনির, একটু দুঃখও। ওরা অন্ধকারে লুকোচুরি খেলে আবার, ওদের প্রিয় খেলা। ভুলে যায় সব। "চুল বাঁধ, চুল বাঁধ। রূপ দেখো মেয়ের"... দিদা-দাদির মিলিত হাসি। রাতে ওই বাড়িতে থেকে যায় ওরা। দেশি মুরগির ঝোল দিয়ে ভাত মেখে খাইয়ে দেন দাদি সবাইকে।


              ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখে রিনি। সারা শরীরে কিলবিল করছে কালো কালো সাপ। ভয়ে চেঁচাতে চায় সে, মুখ দিয়ে আওয়াজ ফোটে না। ঘুমের মধ্যে ছটফট করে, ঘুমের মধ্যে দৌড়ে পালাতে চায়। নিজের গোছা গোছা চুলগুলোই যেন সাপ হয়ে পেঁচিয়ে ধরছে রিনিকে।


             পরদিন সকালে দাদি দেখেন মেঝেয় ঢেউখেলানো গোছা গোছা চুলের মধ্যে নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে রিনি। হাতের মুঠোয় ধরা তাঁর কাঁচি। কাঁচির গায়ে ওকি? সেই লাল-রেশম?  চশমা নিতে অন্য দরজা দিয়ে পাশের ঘরে বেরোতে গিয়ে দাদি দেখেন দরজার কাছে জানু সন্ধিতে হাত রেখে কুঁকড়ে শুয়ে আছে আকরামুজ্জামান। দেখেন, জ্বরে বেহুঁশ সে।