প্রিয়দর্শী দত্ত
প্রিয়দর্শী দত্ত
লেখক / সংকলক : Web Admin
লোকো বাবু
প্রিয়দর্শী দত্ত
লোকেশ রঞ্জন তলাপাত্র ওরফে লোকো বাবুর চারণকবি হিসেবে কোনো পুর্বাখ্যাতি ছিল বলে মনে হয় না| থাকলেও আমার জানার কথা না| কারণ আমি তো রাঁচি গেলাম এই প্রথম, তাও দিন ছয়েকের জন্য| ঠিক মানসিক চিকিত্সার জন্য নয়, যদিও যে অফিসে আমি কাজ করি, সেখানে আধপাগলা হয়ে গেল ও কিছু আশ্চর্যের বিষয় নয়| আমার সহকর্মী অংশুমান আমাকে প্রায় বগলদাবা করেই রাঁচি নিয়ে গেল| বলল চলুন এই ঘোলাটে আবহাওয়া থেকে সপ্তাহখানেক দুরে থাকলেও অনেকটা চাঙ্গা বোধ করবেন| সামনে তার ছোট ভাইঝির বিয়ে| অংশুমানের দাদা রাঁচি তে UCO না এলাহাবাদ কোন ব্যাঙ্ক-এর সিনিয়র ম্যানেজার| তিন বছর পর রিটায়র করে হয়ত কলকাতার দিকে চলে যাবেন|
আমার ‘পশ্চিম’ সম্পর্কে একটি দুর্বলতা আছে সেটা অংশুমান ভালো করেই জানে| সে যেদিন চাকরি তে যোগ দিল সে রাঁচির বাঙালি জানতে পেরে সেই দিনই তাকে জানিয়ে দিয়েছিলাম যে আমার স্বর্গত: ঠাকুরদা সরকারি কার্যসুত্রে দক্ষিন বিহার ও উড়িস্যার অনেক জায়গা চষে বেড়িয়ে ছিলেন| আরে আমার বাবার ছোটবেলাও তো কেটেছে দেওঘর এ|তাই তিনি হিন্দি তে এত পারদর্শী ছিলেন| এ ছাড়া বাংলা কথাসাহিত্যে ও তত্কালীন ইতিহাসে হওয়াবদল বা চেঞ্জএর উল্লেখ পাওয়া যেত তাতে তো জসিদিহ, গিরিদিহ, মধুপুর, হাজারিবাগ এ সব জায়গা আখছার| তাই সে সব জায়গা, বাঙালি হিসেবে, আমার খুবই পরিচিত মনে হয়| কেবল কোনো দিন যাওয়া হয়ে ওঠেনি|
‘এবার হবে’ অংশুমান বলল| ‘সেকি তোমাদের বাড়িতে নেমত্তনো করেনি, আর আমি অনাহুত রবাহুতদের মত পৌঁছে যাব’ আমি প্রতিবাদ করি| আরে বাবা, আমি মেয়ের কাকা, সে বলল আচ্ছা এক্ষুনি কার্ড আসছে| সে রুম থেকে বেরিয়ে গিয়ে মোবাইলে কাকে কি একটা জানালো| একটু পরেই দেখি আমার মোবাইল ফোন একটা ইমেইল এসে হাজির| ‘Dear Mr. Sen Sharma, I shall feel gratified if you can attend our younger daughter Sriparna Bhadra’s wedding at Ranchi as per the invite attached. Kindly allow us the privilege to host you. Let me assure you will not have the slightest inconvenience. My younger brother Anshuman will coordinate”. এটাচমেন্ট এ রয়েছে সোনালী রঙের একটা কার্ড, ইংরেজি ও বাংলাতে| সেটা খুলে দেখলাম তখন দেড় মাস সময় রয়েছে| অফিসে অন্য কাউকে আর নিমন্ত্রণ করা হলো না| এ সেকশন এ আমরা দুজন ই বাঙালি, বাকিরা জানলেও রাঁচি যাবার উত্সাহ কারুর নেই| আবার যদি জানতে পারে যে বাঙালিদের বিয়েতে মদ্যপানের ব্যবস্থা নেই, যাদের একটু আধটু উত্সাহ থাকতে পারে, সেটাও স্থিমিত হয়ে যাবে|
২
রাঁচি তে ভদ্র পরিবার যেখানে থাকে জায়গাটার নাম বর্ধমান কম্পাউন্ড| এটা জৈনদের তীর্থঙ্কর মহাবীর বর্ধমান থেকে নয় মনে হয়| ইংরেজি তে Burdwan লেখা হয় যেমন ইংরেজ যুগে বর্ধমান শহরের নাম লেখা হত| বর্ধমান বাসী কোনো বাঙালি এটা স্থাপন করেছিলেন কিনা বলতে পারব না| বিয়েতে তখনো দু দিন বাকি ছিল| শ্রীপর্না মিষ্টি মেয়ে| ওর জন্য মজুমদার এন্ড সন্স থেকে নিয়ে গিয়েছিলাম ফিরোজী রঙের শাড়ি আর চিত্তরঞ্জন পার্কের আনন্দ পাবলিশার্সের দোকান থেকে সমরেশ বসুর ‘দেখি নাই ফিরের’ একটি কপি| কিন্তু জানতে পারলাম শ্রীপর্না নাকি ঠিক মত বাংলা পড়তেই পারে না| বিহার ঝাড়খন্ড ইত্যাদি রাজ্যে গত ২৫/৩০ বছরে বাংলা শিক্ষাপ্রতিষ্টান গুলির অবনতি ঘটেছে| আসলে অবনতি ঘটেছে বাঙালিদের সাবেকি প্রতিপত্তির| এর জন্যে সেখানের রাজনীতি যে দায়ী বলা বাহুল্য| জামেশেদপুরের বিষয় জানি না| কিন্তু অন্য জায়গায় নয় বাংলা স্কুল নেই, স্কুল থাকলেও বাঙালি শিক্ষক নেই, বই নেই| আবার বাঙালিদের মধ্যে সন্তানদের বাংলা শেখাবার ইচ্ছে যে ১৬আনা তাও বলা যায় না| কারিগরি বা রোজগারী শিক্ষার উপর ই জোর বেশি|
কিন্তু শুনে আশ্চর্য লাগলো শ্রীপর্না বললো সে রবীন্দ্রনাথের অনেক গুলি কবিতা জানে| কোথায় শিখলে, জানতে চাইলাম| কয়েকটা সে শিখেছিল রাঁচি তেই থর্পাকনার প্রাথমিক স্কুলে, আর এখন কয়েকটা শিখেছে লোকো কাকুর কাছে| লোকো কাকু কে? সেই প্রথম শুনলাম লোকেশ রঞ্জন তলাপাত্র’র কথা| ভদ্রলোক ছোট ছেলেমেয়ের থেকে বড়দের অবধি রবীন্দ্রনাথে কবিতা শিখিয়ে বেড়ান| ভদ্রলোক কি সাহিত্য সংস্কৃতির চর্চা করেন| ‘আরে না, না সাহিত্যিক, তাহিত্যিক নয়, ওই ছোট ছেলেমেয়েদের মাতিয়ে বেড়ায়ে’| শ্রীপর্নার সাথে কথা বলতে বলতে লক্ষ্য করিনি ধৃতিমান বাবু (অংশুমানের দাদা)-র বৈঠকখানাতে আমার পাশেই বসে এক প্রবীন ভদ্রলোক ফিস ফ্রাই মনের সুখে ফিস ফ্রাই চর্বণ করছিলেন| জানলাম উনি বিশ্বম্ভর চট্টোপাধ্যায়, তিন প্রজন্ম রাঁচি প্রবাসী হয়েও, বাংলায় সাহিত্য চর্চা করেন| কলকাতা, শিলং, বিলাসপুর ইত্যাদি থেকে প্রকাশিত কয়েকটি পত্রিকাতে উনি নিয়মিত লেখেন| ওনার নতুন একটি উপন্যাস যন্ত্রস্থ, কয়েকদিনের মধ্যেই ছেপে বেরুবে|
বরযাত্রী ও অনান্য অতিথিদের থাকার জন্য কাছেই হোটেল ল্যান্ডমার্কে ব্যবস্থা হয়েছিল| এ ছাড়াও কম্পাউন্ড এ কিছু খালি বাড়ি ভাড়া নেওয়া হয়েছিল| একটা বাড়তি বেড লাগিয়েও কমপক্ষে ২৭৫০/- টাকা এক দিনের| খরচার সবটাই অবশ্য ধৃতিমান বাবুর| তবুও আমি বললাম না এখানে অন্য কারুকে থাকতে দাও, আমার একটা কাম্বিশের খাট হলেও চলে যাবে| রাঁচি তে এসে হোটেল বন্দী হওয়ার চেয়ে বাক্স বন্দী হওয়া ভালো| আপত্তি অংশুমান সত্যেও বর্ধমান কম্পাউন্ড এর একটা খালি বাড়িতে রইলাম| কিন্তু খাত কোথায়| দুন টেন্ট হাউসএর লোকেরা গদি, বালিশ, পাস বালিশ, চাদর ইত্যাদি দিয়ে গেল| ফাল্গুন মাসে তখনো ঠান্ডা রয়েছে|
ভাবতে পারিনি ঠিক তার পর দিন সকালেই লোকো বাবুর সাথে দেখা হবে| ভাড়া করা বাড়িটাতে বুঝতে পারিনি আরো কিছু অথিতি এসে রাত্তিরে ছিল| হোটেলের প্রাইভেসী ছিল না| সকালে স্নান করে বেরিয়েছিলাম সংবাদ পত্রের খোঁজে| একটা পাড়ার ভিতরেই একটা ভেন্ডর কে পেলাম, সে বললো একটাই ‘প্রভাত খবর’ (হিন্দি দৈনিক) বেঁচেছে| বললাম তাই সই, কিনে নিলাম পাঁচ টাকা দিয়ে| এই সময় দেখি সামনে একটা বাড়ি তাতে লেখা ‘মায়ের আশির্বাদ’ সন্দীপ মালাকার সেখান থেকে কয়েকজন দামাল ছেলে পরিবৃত হয়ে এক ভদ্রলোক বেরুচ্ছেন| লম্বায়ে প্রায় ৬ ফুট, চেহারা ভালো, কাঁচাপাকা দাড়ি| একটি ছেলে হঠাত জীভ কেটে বলল লোককাকু শেষ চারটে লাইন ভুলে গেলাম|ভদ্রলোক বললেন দাঁড়া দেখি| বলে পকেট থেকে একটা লাভার স্মার্ট ফোন বার করে কি একটা খুঁজে পড়লেন- “
“রাত্রি হইবে শেষ/ উষা আসি ধীরে/ দ্বার খুলি দিবে তব/ ধ্যানমন্দিরে।
জাগিবে শক্তি তব/ নব উৎসবে,/রিক্ত করিল যাহা/ পূর্ণ তা হবে।
ডুবায়ে তিমিরতলে/ পুরাতন দিন/হে রবি, করিবে তারে/ নিত্য নবীন”।
সেই ছেলেটি নিজের মোবাইল এ জিনিষটা রেকর্ড করে নিল| এবার ভদ্রলোক বললেন কাল পুরোটা মুখস্থ করে, রেকর্ড করে, আমাকে whatsapp করে পাঠিয়ে দিবি| শুরুতে কবিতার নাম, বইয়ের নাম, তপস্যা, চিত্রবিচিত্র| খুব সুন্দর আবৃত্তি করলেন ভদ্রলোক, যাঁকে আমি চিনে গেছি, লোকো দা বা লোকো কাকু| আমার অজান্তেই আমি ওনার কাছে এসে দাঁড়িয়েছি|
আমাকে দেখে উনি চোস্ত হিন্দি তে বললেন বাতাইয়ে, মুঝ সে কাম হ্যায়| নমস্কার করে বললাম আমি বাঙালি, আসছি দিল্লি থেকে, নাম অর্চন সেন শর্মা| একটা বিয়ে বাড়িতে এসেছি| ‘কার বিয়ে, শ্রীপর্নার তো?’ আমি বললাম হ্যা| এই সামনেই উঠেছি, সময় থাকলে চলুন না কিছুক্ষণ| উনি বললেন আপনি বরং চলুন আমার সঙ্গে এই সামনেই|
দশ মিনিট হেঁটে আর একটা বাঙালি বাড়িতে পৌঁছে গেলাম| বাড়ির মালিক অরুন কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়|তাঁর দুই ছেলে এক জন ক্লাস ফাইভে পড়ে আর একজন আট ক্লাসে| অলোক আর আনন্দ| তাদের তিনি রবিবারে কবিতা শেখান| এবার দেখলাম ওনার পদ্ধতি| কোনো খাতা নেই কোনো বই নেই, কবিতা কে তার মুখস্থ তাও নয়| কিন্তু প্রযুক্তি কে ব্যবহার করছেন ১৬ আনা| স্মার্ট ফোনে tagoreweb.in বলে একটি ওয়েবসাইট বার করলেন| আমাকে বললেন এ ছাড়া আর একটা সাইট আছে www.rabindra-rachanabali.nltr.org তাতে ও রবীন্দ্রনাথের সব লেখা আছে|’অর্থাত হাতের মুঠোয় বিশ্বকবির সব কৃতি’| সে সব ছেলারা স্কুলে বাংলা পড়ে না, এবং বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে কিছু জানবে না, আমি তাদের কাছে রবীন্দ্রনাথ কে এনে দিয়েছি| তাদের রবীন্দ্রনাথ কে জিজ্ঞেস করলে আর বলতে হবে না-‘He won the Nobel Prize in 1913 for Gitanjali. He wrote our national anthem. He returned knighthood in protest against Jalianwala Massacre in 1919’|
প্রযুক্তি আপনার সহায়ক হয়েছে বলতে হবে| ‘নিশ্চই’ আমি প্রযুক্তির মানুষ| দিসেল ইঞ্জিন চালাতাম| আমাকে সবাই লোকো বাবু, লোকো কাকু, লোক তলাপাত্র বলে| আমি হঠাত বেফাঁস বলে বসলাম বিশ্বম্ভর চট্টোপাধ্যায় কে চেনেন| লোকো বাবু একটু বিরক্ত হয়ে বললেন, দেখুন আমি সাহিত্যিক নই| কিন্তু নতুন প্রজন্ম কে তৈরী না করলে আপনার ভালো ভালো লেখার পাঠক তো থাকবে না| ওঁর নাতি বাংলার ধার ধরেনা, উনি সাহিত্যিক হয়ে বিশ্ব পৃথিবীতে খ্যাতি চান| উনি ওপর থেকে জল ঢালছেন, কিন্তু তলা ফুটো হলে কি করে চলবে, এই তলাপাত্র সেই তলা মেরামতের কাজ করছে|
জিজ্ঞেস করি রাঁচি তে বাংলা সাহিতয় চর্চা হয়| উনি বললেন হয় বটে, আমাকে তারা পাত্তা দেয় না| আমি মশায় নকশাল উপদ্রুত এলাকা দিয়ে প্রতি সকালে পাইলট লোক নিয়ে গেছি, এ সব মানুষদের পরোয়া করি না| তবে আমার কাজে ভবিষ্যতে এদের ই উপকার হবে| ৮০ জন ছাত্র আমার, সব ফ্রি তেই, বিশ্বম্ভর বাবু বলবেন ঘরের খেয়ে, বনের মোষ তাড়াই, তাই সই| ঝাড়খন্ডে বাংলা কে বাঁচাতে হবে, আমি যত টুকু পারি করছি|
লোকো বাবুর সাথে কথা বলে ভিতরে ইঞ্জিনের শক্তি অনুভব করলাম| ওদিকে অলোক বলতে শুরু করেছে- দুন্ধুভি বেজে ওঠে ডিম ডিম রবে/সাঁওতাল পল্লীতে উৎসব হবে'।
Review Comments
সোসাল মিডিয়া কামেন্টস