নিরুপম চক্রবর্তী
লেখক / সংকলক : iPatrika Crawler
পাঠকামি
নিরুপম চক্রবর্তী
বহুদিন পরে আজ শীতের দুপুর । দিল্লির দূর দূরান্ত থেকে বিক্রিত হয়ে আসা মরলার সঙ্গে মটর শাকের অনবদ্য ব্যঞ্জন সহকারে কিছুটা অবসর কাটিয়ে বসা গেলো একগুচ্ছ কবিতার সঙ্গে । এই তো বকোদর, জীবনের এই তো আনন্দ, সপ্তাহান্তে একটুকরো রোদের জন্য এতোগুলো উইকডেজ রাতকালি করা । ঈষৎ রঙিন করে তোলা মুহূর্তগুলির অভিপ্রায়ে প্রবাসে বাংলা যাপন । কবিবন্ধুদের এই সামান্য আলাপ, কবিতার পাঠকামি । নিজস্ব পাঠ ও অনুচ্চারিত কিছু আনন্দের ছন্দলিপি ।
আজ, পাঠ হবে, কবি নিরুপম চক্রবর্তীর 'ইষৎ রঙিন' । গ্রন্থটি, সাময়িক কালে প্রকাশিত, ডাকযোগে সংগ্রহ করা । প্রকাশক সৃষ্টিসুখ ।
"বিচ্ছিন্ন বলতে চেয়ে ক৯প্ত বলে বিলুপ্ত শব্দটি
ছিন্নমস্তা ভাষা আজ ওষ্ঠে তাঁর ধরে রেখে দিল ।
হে ভাষা, জীবন্ত হও, এ শ্মশানে শব সাধনার প্রমত্ত ধবনিটি জালো
তোমার বিচ্ছিন্ন অঙ্গ প্রতিটি নরকে দ্যাখো দোকান খুলে কীরকম বেঁচেবর্তে আছে । "
এই বলে ।। ক৯প্ত ।। কবিতাটি শুরু হয় । ডবল দাঁড়ি দিয়ে নামকরণ । রেনেসাঁস পর্বের কবিতা । বলা যায়, এর আগে এই কবিকে আমি তেমন পড়িনি ।ব্যক্তিগত পরিচয়ও নেই। ফেসবুকে, কিছু তার ভিলানেল পড়েছি । কবিতাটা আগাগোড়া যেখান থেকে খুশী পড়া যায় , কবিতার ভাষা এই কবিতার দেহ । অঙ্গে প্রত্যঙ্গে লেগে থাকে তার ছোঁয়া ।
ছটি পর্বে, গ্রন্থখানি সাজ্জিত, নামকরণ গুলি নিজেই একটা কবিতা । পিছন থেকে 'তমার গানগুলি', 'প্রার্থিত পুনর্জন্ম', 'ড্রাগন ব্রিজ', 'একগুচ্ছ ভিলানেল','ঈষৎ রঙিন' ও 'রেনেসাঁস' । বলতে কী , আমি ভিলানেলগুলি আগে পড়লাম, আশ্চার্য কবিতা । এর শিল্পদক্ষতা অন্যরকমের । কাঠামো গত কবিতা যেমন কঠিন , তেমন তার সঙ্গে সেটা কবিতার মর্ম দেওয়া, খুবই কঠিন । আজকের কবিরা তা হয়তো করে উঠতে পারেন না ।
রূপ( form) কবিতার সঙ্গে যদি আবার মিশিয়ে দেওয়া মূল ( core), একটা বৃক্ষ ফুটে ওঠে । সেখান থেকেই আমরা একটা কাঠামো ধরতে করতে পারি, রিপিটেটিভ, তবে তার মজাই আলাদা । ভিলানেল নিয়ে কবি নিজেই বলছেনঃ
"তবুও তো আলো হবো, কোন এক নিষিদ্ধ শহরে
সব জেনে সব জেনে এ রাতে কেন যে ভুল করি
ভীত ভিলানেলগুলি সারারাত আর্তনাদ করে
মৃত ভিলানেলগুলি জেগে থাকে রক্তের শহর । "
কবিতাগুলি, কাঠামোর বাইরেও কবিতা হিসাবে বৃক্ষের মতো দাঁড়িয়ে যায় ।
এক একটি মুখবন্ধ থাকে, একটি কবিতা পর্বের আগে । এটা জানি না প্রকাশকের কারসাজি কিনা, কিন্তু একটু কাব্যছোঁয়া হিন্টস , আরো একটু সিস্টেমেটিক হয়ে ওঠা । আধুনিক কবিতা পড়তে এসে এই কবিতার ভিতর যখন আমি জীবনানন্দের ভাষা বারবার আবিষ্কার করছিলাম, আমার মনে হচ্ছিল কিছুটা নস্টালজিয়ার ভিতরে আছি । ড্রাগনব্রিজ পড়তে পড়তে আবার মনে হচ্ছিল দক্ষিন আমেরিকার কবিতার কথা । জীবনানন্দ থেকে আরামসে ব্ল্যাঙ্কোর কবিতায় ভ্রমণ করা যায় । ঘটনাময় শিল্পআঁচড ও স্মৃতিমেদুরতা , বাংলা ভাষার সামনে একটা বিষণ্ণঘেরা শব্দচয়নের হাতছানি। কবি, সেটাকে পূর্ণ ব্যাবহার করেছেন । অনেক কবিতা, তবে সমস্তই একবারে পড়ে ফেলা যায় । কারণ তার বৈচিত্রময়তা । শেষ দিকে এসে একটা অদ্ভুত সুন্দর সিরিজ কবিতা ।
।। তমার গানগুলি ।। কবিতাগুলো অচেনা শব্দকল্প দৃশ্যের অপার । বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে যায় । এই সেই থিম যার শিকড় এই গঙ্গা ভাগীরথী পদ্মা থেকে অনেক দূরে । একটা পরিশীলন ও দেখা একটি বিদেশী চোখে । সমুদ্র, বালি, চাঁদ, মৃত্যু, পশু, বন্যভূমি, স্প্রুস, ঝরনা, গুল্ম ইত্যাদি। এই ভাষা আমার অচেনা, খানিকটা চোখে দেখা টেক্সাসের তৃণভূমির কথা মনে পড়ে । আমি, বুঝি এই কবিতার ভিতরে ও বাহিরে এক অন্য জগত । সেই নিমগ্ন রাতটির কথা আমার মনে পড়ে, একা এক হেমন্তের রাত 'রাউন্ড রক, অস্টিন' থেকে হেঁটে ফিরছি ওরার্ণার র্যাঞ্চ , চারিদিকে জোতস্নার আলো । কি একটা সূর্যমুখীর গন্ধ ভেসে আসে । কি ফুল হবে ? খানিকটা ম্যাজেন্টা । কোথাও যেন আস্তাবল আছে । কিংবা ছিলও । একটা ঘোড়া যেন ডেকে উঠলো কোথাও । শেষ করা আগে, 'তমার গানগুলি' থেকে একটি কবিতা পড়া যাকঃ
"এক বিচিত্র রমণির সন্তান ঘুমিয়ে ছিলও তমার বাহুতে
স্তব্ধ বাতাস , স্তব্ধ বনবীথি, সবকিছু শুনশান স্তব্ধ
তখন হঠাত স্প্রুস গাছগুলোর পেছন থেকে জ্বলে উঠলো একটা তারা
পুড়তে লাগলো
তারাটি কথা বলেনি , শুধু তমার চুলে রেখে গেছে একটা সোনালি আভা । "
ধন্যবাদ কবি, নিরুপম চক্রবর্তী , আপনার এমন কিছু অনন্যসুন্দর কবিতা পড়ানোর জন্য , না পড়লে, অনেক কিছুই জানা হতো না, পড়া হতো না আপনাকেও । ধন্যবাদ প্রকাশক সৃষ্টিসুখ, কর্ণধার রোহন কুদ্দুস যিনি, আমাকে গ্রন্থটি প্রেরণ করার আগেও জানতে চেয়েছেন আমি 'দিল্লিতে' বাড়িতে থাকবো কিনা, কারন উনি খোঁজ করে জানতে পেরেছিলেন, আমি মাতৃবিয়োগে বহিরগাছি, নদীয়া আমার গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলাম । ধন্যবাদ, সমগ্র প্রচেষ্টাকে । গ্রন্থটি অধিক পঠিত হোক, কবি পাক তার প্রকৃত সম্মাননা, এই কামনা করি ।
পীযূষকান্তি বিশ্বাস
১২ ডিসেম্বর
মহাবীর এনক্লেভ
নতুন দিল্লি