প্রিয়দর্শী দত্ত
প্রিয়দর্শী দত্ত
লেখক / সংকলক : Web Admin
দিল্লি কবে থেকে হিন্দি সাহিত্যের কেন্দ্রবিন্দু হলো?
প্রিয়দর্শী দত্ত
মধ্য দিল্লির চার বাই উনিশ অসফ আলী রোডের উপর অবস্থিত হিন্দি জগতের বৃহত্তম প্রকাশনী সংস্থা ‘প্রভাত প্রকাশন’| তারা সাম্প্রতিক কালে ইংরেজি প্রকাশনা তেও হাত দিয়েছে| উল্লেখযোগ্য ভাবে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রয়াত শ্রী এ পি জে আব্দুল কলামের প্রায় সব কটি গ্রন্থ তারাই হিন্দি ও ইংরেজি তে প্রকাশ করেছে| গত ২৩ বছর ধরে প্রভাত প্রকাশন ‘সাহিত্য অমৃত’ নামে একটি মাসিক ও প্রকাশ করে| পত্রিকাটির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন সংস্কৃত ও হিন্দির প্রথিতযশা পণ্ডিত শ্রী বিদ্যানিবাস মিশ্র (১৯২৬-২০০৫)|বর্তমানে যাঁর উপর এই ভার ন্যস্ত, তিনি সম্ভবত ভূভারতে প্রবীনতম সম্পাদক| ত্রৈলোক্যনাথ চতুর্বেদী, বয়স নব্বুই, অবকাশ প্রাপ্ত IAS আধিকারিক, ভূতপূর্ব CAG, পদ্ম বিভূষণ প্রাপ্ত, কর্ণাটকের প্রাক্তন রাজ্যপাল| পত্রিকার প্রত্যেক সংখ্যাতে পাঁচ/ছয় পাতা জুড়ে থাকে তার ছয়/সাতটা বিষয়ের উপর সাক্ষরিত সম্পাদকীয় বা সাইনড এডিটরিয়াল|
প্রায় আশি পাতার মাসিকে ওই গুলোই হয়ত দিল্লির নিশ্চিত অবদান| বাকি কাহিনী, কবিতা, প্রবন্ধ ইত্যাদির মধ্যে দিল্লির থেকে একটা আধটা লেখা থাকতেও পারে আবার নাও পারে| বোঝা সহজ কারণ সব লেখার শেষেই লেখক/লেখিকার (হিন্দিতে পরিচয়টা এখনো লিঙ্গ-নিরপেক্ষ হয়ে যায় নি) নাম, ঠিকানা ও মোবাইল নম্বর দেওয়া থাকে| লেখা আসে কানপুর, এলাহাবাদ, লখনৌ, শিমলা, জয়পুর, ভোপাল, ইন্দোর, পাটনা, নাগপুর, পুনে, মুম্বাই, রায়পুর এমন কি বিশাখাপত্তনম থেকে|দিল্লি কি তাহলে সত্যিই এখনো হিন্দি সাহিত্যের উত্পাদক হয়ে উঠতে পারেনি?দেশ পত্রিকা, সাপ্তাহিক বর্তমান, আনন্দমেলা, নবকল্লোলের লেখকদের মধ্যে সিংহ ভাগ হবে কলকাতার বাইরের হবে এটা কল্পনা করা যায়না|
আমার কথা শুনে শম্ভুনাথ হয়ত হাসবেন|আসলে হিন্দি সাহিত্যের ভূগোল টা তো এমনিই| তার লেখকরাও সারা ভারতে ছাড়িয়ে আছেন| তিনি কলকাতা থেকে প্রকাশিত সাহিত্য মাসিক ‘বাগর্থ’ সম্পাদন করেন| কার্যালয় ভারতীয় ভাষা পরিষদ ৩৬ এ, শেক্সপিয়ার সারণী| দেখতে দেখতে বাগর্থের ও প্রায় ২৫ বছর হয়ে গেল, ইতিমধ্যে বেরিয়ে গেছে ২৭৫ টি সংখ্যা| কলকাতার থেকে হিন্দি পত্রিকা? অনেক বাঙালি বাবুই হয়ত হাসবেন| বাঙালিরা সাধারণত ফরাসী, জার্মান ও ল্যাটিন মার্কিন সাহিত্যে কি ঘটছে তা নিয়ে ওয়াকিবহাল হলেও হিন্দি, তামিল, মালায়ালম, অসমীয়া, উড়িয়া তে কি হচ্ছে তা নিয়ে নয়| এ সব ভাষার সাহিত্য বাংলায় বিশেষ অনুদিত হয় না, যদিও বিদেশী সাহিত্যের সম্ভার বেশ সমৃদ্ধ| কিন্তু কলকাতাই ছিল আধুনিক হিন্দির পীঠস্থান| এখানে থেকেই প্রায় দুশো বছর আগে হিন্দির প্রথম সংবাদ পত্র ‘উদন্ত মার্ত্য্ন্ড’ প্রকাশিত হয়| প্রকাশক/সম্পাদক যুগল কিশোর শুক্ল আদপে ছিলেন কানপুরে, কিন্তু কোম্পানি বাহাদুরের চাকরি সূত্রে থাকতে হত কলকাতায়| আধুনিক হিন্দির প্রথম লেখক লাল্লু লালের (১৭৬৩-১৮৩৫) জন্ম আগ্রায়ে একটি গুজরাতি ব্রাহ্মণ পরিবারে হলেও তিনি কর্ম জীবন কাটিয়েছেন কলকাতাতেই| তত্কালীন ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে প্রশিক্ষক ছিলেন| তার বিখ্যাত ‘প্রেম সাগর’ তিনি কলকাতাতে বসে লিখেছিলেন|
আমাদের সময় অলকা সরায়োগী (জন্ম ১৯৬০, কলকাতা) আনন্দনগরী তে বসেই তার ছোট গল্প ও উপন্যাস লিখেছেন| কিন্তু কলকাতায় হিন্দি পত্রিকা বা সংবাদ পত্রের প্রকাশক থাকেল গ্রন্থ প্রকাশক কই? তাই প্রথম দুটি বই – কাহানি কী তলাশ মে (গল্প সংকলন) এবং কলি-কথা ভায়া বাইপাস (উপন্যাস) প্রকাশ করে পঞ্চকুলা-র (হরিয়ানা) এক অল্প শ্রুত প্রকাশক| কিন্তু যেই কলি-কথা ভায়া বাইপাস, ২০০১ সালে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার পেল, অমনি দিল্লির এক প্রকাশনী সংস্থা রাজকমল প্রকাশন তাকে ধরে ফেলল| আর পঞ্চকুলার প্রকাশকের কাছে ফিরে যেতে হয় নি| দিল্লির প্রকাশকের হাত ধরেই এসেছে একের পর এক লেখা| তিন বছর আগে ২০১৫ ‘জানকীদাস তেজপাল ম্যানশন’ ও রাজকমল প্রকাশ করেছে|
দুই সহোদর ভাই অশোক মাহেশ্বরী এবং অরুণ মাহেশ্বরী স্বতন্ত্র ভাবে রাজকমল প্রকাশন (স্থা.১৯৪৭) ও বাণী প্রকাশন পরিচালনা করেন| এখন মাহেশ্বরী পরিবারের তৃতীয় প্রজন্ম প্রকাশন ব্যবসায়ে নিযুক্ত| এ ছাড়াও আছে রাজপাল এন্ড সন্স, হিন্দি সাহিত্য সদন ইত্যাদি| ডায়মন্ড পাবলিকেশন (স্থা.১৯৪৮) হিন্দি ছাড়া ইংরেজি, বাংলা, উর্দু, মারাঠি, গুজরাটি, অসমীয়া তে ও বই প্রকাশ করে|
হিন্দি ভাষার ভূগোল টা সারা উত্তর ভারত জুড়ে বিস্তৃত| স্বাভাবিক ভাবে হিন্দি সাহিত্যের বলয়ও তেমনি| হিন্দি ভাষী রাজ্য যেমন ঝাড়খণ্ড, বিহার, উত্তর প্রদেশ, ছত্তিসগড়, মধ্য প্রদেশ, রাজস্থান, হরিয়ানা, হিমাচল প্রদেশ ও উত্তরাখণ্ড তো রয়েছেই| এছাড়া ও আছে পাঞ্জাব, যে প্রান্ত থেকে অনেক হিন্দি লেখক-লেখিকা এসেছেন| উনিশ শতকে আধুনিক হিন্দি ভাষা ও সাহিত্যের যে সব কেন্দ্র ছিল তার মধ্যে এলাহাবাদ, কানপুর, বারানসী, পাটনা ইত্যাদি প্রমুখ| তার মধ্যে কলকাতা ছিল, কিন্তু দিল্লি নয়| দিল্লির উপর মোগল প্রভাব থাকার জন্য উর্দু/ফার্সি ই প্রাধান্য পেয়েছে| দিল্লি মির্জা গালিব, ইব্রাহিম জউখের শহর হিসেবেই পরিচিত ছিল| মোগল যুগ শেষ হওয়ার পর এর রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব অনেক কমে যায়| বাংলা, মহারাষ্ট্র, পাঞ্জাব ও সংযুক্ত প্রদেশ (অধুনা উত্তর প্রদেশ) ইত্যাদি তে যে নব চেতনার সঞ্চার হয়, দিল্লি তার থেকে অনেকটা দুরে থাকে|
উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে আধুনিক হিন্দির কথা সাহিত্য অনেকটা বেনারস-এলাহাবাদ-কানপুর অক্ষের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে|ভারেতেন্দু হরিশচন্দ্র ছিলেন বেনারসের, প্রতাপ নারায়ণ মিশ্র কানপুরের|বেনারাসেই তৈরি হয় ‘কাশী নাগরী প্রাচারিনি সভা’| ১৯০০ ক্রী এলাহাবাদের থেকে প্রকাশিত হয় হিন্দির প্রথম সাহিত্য পত্রিকা ‘সরস্বতী’| এর মূলে ছিলেন এক প্রবাসী বাঙালি বাবু চিন্তামনি ঘোষ যিনি ইন্ডিয়ান প্রেস এর প্রতিষ্ঠাতা| প্রসঙ্গত: গীতাঞ্জলী সহ রবীন্দ্রনাথের বহু গ্রন্থের মূল সংস্করণ এলাহাবাদের ইন্ডিয়ান প্রেস থেকেই প্রকাশিত হয়| আধুনিক হিন্দি সাহিত্যের নির্মাণে ‘সরস্বতী’ পত্রিকার ভূমিকা অতুলনীয়| মেদিনীপুরে বড় হয়ে ওঠা হিন্দির মহীরুহ কবি সূর্য কান্ত ত্রিপাঠি ‘নিরালা’ (১৮৯৬-১৯৬১) বলেছিলেন যে তিনি হিন্দি ভাষা সরস্বতী পত্রিকা পড়েই শিখেছিলেন|
কাশী নাগরী প্রচারিনি সভার আনুকূল্যে বেনারস থেকে হিন্দি সাহিত্যের অনেক গুলি সংকলন বেরয়| সে যুগে ছিল হিন্দি সাহিত্য প্রেস(এলাহাবাদ), ভারতী ভাণ্ডার/লিডার প্রেস (এলাহাবাদ), গঙ্গা গ্রন্থাগার (লক্ষ্ণৌ), মুন্সী প্রেমচাঁদ নির্মিত সরস্বতী প্রেস (বেনারস) ইত্যাদি| হিন্দিতে রহস্য রোমাঞ্চ উপন্যাসের প্রথম স্রষ্টা ‘চন্দ্রকান্তা সন্ততি’ খ্যাত বাবু দেবকী নন্দন ক্ষত্রি (১৮৬১-১৯১৩)বেনারসে ‘লহরী প্রেস’ প্রতিষ্ঠা করেন| মূলত: বিহারের সমস্তিপুরের হলেও তিনি কর্মসূত্রে বেনারসে থাকতেন| লহরী প্রেস থেকে প্রকাশিত গ্রন্থে প্রকাশকের জায়গায় ইংরেজি তে জনৈক পান্না লাল রায়, ম্যানেজার, লহরী প্রেস লেখা থাকত| Roy লিখতেন বলে অনুমান করি তিনি বাঙালি হতে পারেন|
দিল্লিতে ১৮৫৭ এর পর মোগল শাসন শেষ হলেও প্রায় অর্ধশতাব্দী হিন্দি সাহিত্যের কোনো উন্মেষ দেখা যায় নি| ওদিকে উত্তর প্রদেশে তখন আধুনিক হিন্দি সাহিত্যের (গদ্য, প্রবন্ধ সাহিত্য, কাহিনী) দ্রুত বিকাশ হচ্ছে| তৈরি হচ্ছে মুদ্রণশালা|ভারতের রাজধানী ১৯১১ সালে দিল্লীতে স্থানান্তরিত হলো| বাস্তবে এই প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হতে অনেক সময় লাগে| আর সমাজের স্বামী শ্রদ্ধানন্দ (মহাত্মা মুন্সী রাম)১৯১২ সালে দিল্লীর প্রথম হিন্দি দৈনিক ‘বিজয়’ এর সূচনা করেন, পরবর্তী কালে ১৯২৩ এ তিনি ‘অর্জুন’ এর প্রতিষ্ঠা করেন| এই দুই পত্রিকার মাধ্যমে দিল্লির প্রথম হিন্দি সাংবাদিক পণ্ডিত ইন্দ্র বাচস্পতি খবরের শিরোনামে চলে আসেন| ইনি পরে সাহিত্যিক রূপেও খ্যাতি অর্জন করেন| কিছুদিনের মধ্যে রামচন্দ্র শর্মা ‘মহারথী’ নামে এক সাপ্তাহিকের সম্পাদনা শুরু করেন| এবং কালান্তরে এই সাপ্তাহিক ই দিল্লির হিন্দি সাহিত্যের কেন্দ্র বিন্দু হয়ে দাঁড়ায়ে|
দিল্লির বহুসংখ্যক মানুষের কথ্য ভাষা চিরকাল হিন্দি ই ছিল| এবার যখন মনে হচ্ছিল সাহিত্যের কেন্দ্র বিন্দু তেও অচিরে হিন্দি উঠে আসবে, ঠিক সেই সময়ই একটা ঘটনা ঘটল যা হিন্দি কে সরিয়ে আবার উর্দু কে চাঙ্গা করে দিল| ঠিক ১৯৩৫ সালে গুলাম আলী বুখারী (১৯০৪-১৯৭০) দিল্লি রেডিও স্টেশনের ডিরেক্টর হয়ে আসেন| তিনি মূলত: পেশোয়ার এর ছিলেন এবং দেশ ভাগের পর পাকিস্তান রেডিওর প্রথম ডিরেক্টর-জেনারেল হন|১৯৩৫ থেকে ১৯৩৯ এই চার বছরে তিনি দিল্লির রেডিও স্টেশন কে উর্দু সাহিত্যকার দের আখড়া তৈরি হয়ে যায়| সরকারি কাজ কর্মে তো এমনি উর্দু চলে আসছিল| তাই হিন্দি সাহিত্যিকরা নিজের জায়গা তৈরি করতে পারছিল না|
কিন্তু ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরু হতেই রাজধানীর জীবন যাত্রায় যে বহুমুখী পরিবর্তন হলো হিন্দি সাহিত্য তার দ্বারা লাভবান হলো| যুদ্ধের জন্য নতুন কর্মসংস্থান হলো| ব্রজভাষার কবি বিয়োগী হরি (১৮৯৫-১৯৮৮) মূলত: মধ্য ভারতের হলেও ১৯৩৪ থেকে দিল্লি তে থাকছিলেন| তিনি আরো কয়েকজন উদীয়মান লেখকদের নিয়ে একটি আন্দোলন গড়ার চেষ্টা করলেন| এই দলটির মধ্যে ‘ঈশ’-অন্তক নামের ছড়াছড়ি ছিল – যেমন ছবেশ, দীনেশ, করুনেশ, কমলেশ ইত্যাদি| এই সময় দিল্লির প্রথম হিন্দি উপন্যাসকার রামচন্দ্র তেওয়ারীর উদয় হলো| এ ছাড়া ও ব্রজ ভাষার হাস্য রসের কবি গোপাল প্রসাদ ব্যাস (১৯১৫-২০০৫) দিল্লীতে ঘাঁটি গাড়েন| প্রসঙ্গত সুভাষ চন্দ্র বসুর প্রশংসায়ে লিখিত তার একটি কবিতা বিখ্যাত হয়|
এই সময় দিল্লির বাইরে থেকে আসা অনেক কবি সাহিত্যিকরা এই শহর কে ঘাঁটি করে সাহিত্যচর্চা আরম্ভ করেন|তৈরি হয় ‘কবি সমাজ’ আর ‘নয়ী দিল্লি হিন্দি সাহিত্য সভা’| এত দিন উর্দুর মুশায়রা হত| এবার তারই অনুকরণে শুরু হলো হিন্দি কবি সম্মেলন, যা দিল্লির অবদান| এই কবি সমাজের মধ্যে এত বিভিন্ন পেশার মানুষরা ছিলেন যে শুনে আশ্চর্য হতে হয়- কেরানি, লোহার ব্যাপারী, পুস্তক বিক্রেতা, ধর্মীয় কথাবাচক, অধ্যাপক, ডাক্তার, কম্পউণ্ডার, দর্জি ইত্যাদি| তাদের মাসে একবার করে সাহিত্য বৈঠক হত| কোজাগরী লক্ষ্মী পূজার রাতে (শরদ পূর্ণিমা) যমুনায় হত নৌকা বিহার| তারাই দিল্লির জনগণ কে কবিতা মুখী করে তোলেন| রাজেন্দ্রলাল হাঁন্ডা তার স্মৃতিচারণ ‘দিল্লি মে দশ বর্ষ’-এ তার বর্ণনা দিয়েছেন|
উনিশশো সাতচল্লিশ সালের ১৫ই আগস্ট স্বাধীনতার সঙ্গে রক্তক্ষয়ী দেশ ভাগ ও হলো| অবিভক্ত পাঞ্জাব প্রদেশের অর্ধেকটা পশ্চিম পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হলো| এর সঙ্গে সঙ্গেই সেখানে থেকে বিতাড়িত হিন্দু ও শিখেরা, যারা জীবিত পৌঁছুতে পারল, এসে দিল্লীতে শরণ নিল| ওদিকে দেওয়াল ঘেরা দিল্লির (walled city) অংশ থেকে অনেক মুসলমানদের দিল্লি ছেড়ে চলে যেতে হলো| দিল্লির জনসংখ্যার ভাষাগত এবং ধর্মীয় বিন্যাস অনেকটাই বদলে গেল| এতে হিন্দি সাহিত্যের লাভ হলো ও উর্দু সাহিত্যের রমরমা অনেক কমে গেল| অন্য দিকে স্বাধীন ভারতে হিন্দি কে সরকারি (official language) ভাষা ঘোষণা করার বিতর্কিত সিদ্ধান্তে হিন্দির কদর বেশ বাড়লো|
সে সব হিন্দু ও শিখ শরণার্থী দিল্লি এসে পৌঁছেছিলেন তাদের কথ্য ভাষা পাঞ্জাবি ছিল| কিন্তু সে যুগে পাঞ্জাবে ইংরেজির পর লিখিত ও শিক্ষার ভাষা উর্দু ছিল (পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত পাঞ্জাবে এখনো তাই)| ভারতীয় পাঞ্জাবে গুরুমুখীর সরকারি ভাষা হয়ে ওঠার কাহিনী (যা নিয়ে অনত্র আলোচনা করব) স্বাধীনতার অনেক পরের কথা| অবিভক্ত পাঞ্জাবে গুরুমুখী মূলত: শিখেদের ধর্মীয় ভাষা ছিল, যা না স্কুলে পড়ানো হত, না তাতে বিশেষ সাহিত্য রচনা হত| গুরুমুখী তে লেখা পাঞ্জাবি সাহিত্য কুড়ি শতকের, এমন কি স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের সৃষ্টি| কিন্তু স্বাধীন ভারতে পাঞ্জাবিরা উর্দুর দিকে কেন গেলেন না?
উনিশ শতকের শেষ দিকে আর্য সমাজ পাঞ্জাবের হিন্দু সমাজের উপর প্রভাব বিস্তর করতে শুরু করে| শিক্ষার ক্ষেত্রে আর্য সমাজের বিশেষ ভূমিকা ছিল| আর্য সমাজ প্রচণ্ড ভাবে হিন্দির প্রচার শুরু করেছিল|আর্য সমাজ তৈরির আগের থেকেই (১৮৭২) ব্রহ্মানন্দ কেশব চন্দ্র সেনের পরামর্শে জন্মসূত্রে গুজরাতি ব্রাহ্মণ স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী সর্জাবানিক ব্যবহারের জন্য সংস্কৃত ছেড়ে হিন্দির শুরু করেছিলেন| জনগণনায়ে পাঞ্জাবের হিন্দু দের জিজ্ঞেস করলে তারা বলত তাদের ভাষা হিন্দি| এর জন্য স্বাধীনতার পরে ভারতীয় পাঞ্জাবে একটি বিতর্কও সৃষ্টি হয়| কিন্তু লক্ষ্য করবেন এই পাঞ্জাবী হিন্দুদের মধ্যে থেকেই হিন্দি সিনেমা জগতের বহু গান লেখক এসেছেন- গুলজার, আনন্দ বকশী, গুলশন বাবরা (গুলশান কুমার মেহতা), রাজেন্দ্র কৃষ্ণ ইত্যাদি|
স্বাধীনতার পরে দিল্লির হিন্দি সাহিত্য কে সমৃদ্ধ করলেন এক পাঞ্জাবি কাহিনীকার ও নাট্যকার| তাঁর নাম মদন মোহন গুগ্লানি (১৯২৫-১৯৭২) যিনি মোহন রাকেশ নামে খ্যাত হন| তাঁর হিন্দি নাটক আষাঢ কা এক দিন, লেহরো কে রাজহন্স এবং আধে আধুরে ইত্যাদি কেবল দিল্লীতে কেবল মাত্র হিন্দি নাটক কে চাঙ্গা করে না, তাঁকেও হিন্দির প্রথম আধুনিক নাট্যকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে| তার ছোট গল্প গুলি ও মর্মস্পর্শী| মাত্র ৪৭ বছর বয়েস যখন দিল্লীতে তাঁর মৃত্যু হয়, তিনি প্রথম সারির হিন্দি লেখকদের মধ্যে পরিগণিত হতেন|
দেশ ভাগের কারণেই দিল্লীতে এলেন অমৃতা প্রীতম, কৃষ্ণা সোবতি, ভীস্ম সাহানি| অমৃতা পাঞ্জাবি সাহিত্যের একজন পথিকৃৎ ছাড়াও হিন্দির লেখিকা| কৃষ্ণা সোবতি হিন্দির বিশিষ্ট উপন্যাসকার, প্রাবন্ধিক| জীবিকার জন্য এসেছিলেন হরিবংশ রাই বচ্চন, শ্রীকান্ত ভার্মা, নির্মল ভার্মা, মনোহর শ্যাম যোশী, কেদার নাথ সিংহ, রাজেন্দ্র যাদভ, মৃদুলা গর্গ, প্রয়াগ শুক্ল ইত্যাদি| দিল্লিতে অনেক সরকারি চাকরি| এ ছাড়া দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়, জহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়, সাহিত্য একাডেমী, হিন্দি একাডেমী ইত্যাদি থাকায়ে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা বিদ্যমান| দিল্লির থেকে বহু সংবাদ পত্র, পত্রিকাও বেরুতে থাকে|
রাজধানী হওয়ার দৌলতে দিল্লির ভাগ্যে অনেক কিছু জুটেছে| কিন্তু হিন্দি সাহিত্য কে যদি আমরা শুধু দিল্লির দৃষ্টি দিয়েই দেখি তাহলে বুঝতে হবে মস্তিষ্কে রক্ত জমে গেছে| দিল্লি একটা কৃত্রিম জিনিষ| দিল্লিতে কোনো প্রেমচাঁদ, জয়শংকর প্রসাদ, নিরালা তৈরি হতে পারেন না| দিল্লির থেকে দুরে বসেও মহাদেবী বর্মা, অমৃতলাল নাগর, হরিশংকর পরসাই, শ্রী লাল শুক্লা, শিব মঙ্গল সুমন, সুমিত্রা নন্দন পন্থ ইত্যাদি সাহিত্যকার প্রসিদ্ধ হয়েছেন| হিন্দি গজলের সৃষ্টিকর্তা দুষ্মন্ত কুমার (১৯৩৩-১৯৭৫) যার কাব্য গ্রন্থ ‘সায়ে মে ধূপ’ কে ইন্দিরা গান্ধীর জরুরী অবস্থার বিরুদ্ধে এক সুতীক্ষ্ণ সমালোচনা বলা হয় উত্তর প্রদেশ ও মধ্য প্রদেশে কাজ করেছেন| নাট্যকার শঙ্কর শেষ (১৯৩৩-১৯৮১) ছত্তিসগড় থেকে স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ায় হিন্দি অফিসারের কাজ নিয়ে মুম্বাই চলে যান| কমলেশ্বর, শরদ যোশী ও মনোহর শ্যাম যোশী ও সিনেমা – টেলিভিশন সিরিয়াল এর লেখনর সুবাদে মুম্বাই তে ছিলেন|
ইতিহাসের দিক থেকে দেখতে গেলে হয়তো ‘সস্তা সাহিত্য মণ্ডল’ যা ১৯২৫ এ গান্ধীজীর ইচ্ছাতে এবং ঘনশ্যাম দাস ও যমুনালাল বাজাজের আনুকূল্যে তৈরি হয় দিল্লির প্রথম হিন্দি প্রকাশন| কনৌট সার্কাসে তাদের অফিস আজ ও চলে আসছে| কিন্তু দিল্লিতে হিন্দির প্রথম সারির প্রকাশনী সংস্থান গুলি বেশির ভাগ ই স্বাধীনতার পরের| এর মধ্যে প্রভাত প্রকাশন, রাজকমল প্রকাশন, বাণী প্রকাশন, রাজপাল এন্ড সন্স কিতাব ঘর ইত্যাদি| এটা কি পুঁজিবাদের প্রভাব? দিল্লিতে মুদ্রণ সস্তা, পেশাদার ও কর্মচারী পাওয়া যায় এবং একটি পাঠকবর্গ আছে যাদের হাতে টাকা আছে| এ ছাড়া রাজনৈতিক দিক ও আছে| প্রভাত প্রকাশন কে যেমন ভারতীয় জনতা পার্টির কাছা কাছি মনে করা হয়| কিন্তু আমার ব্যক্তিগত ধারণা হিন্দির সাহিত্যের আসল কাজ দিল্লির বাইরেই হচ্ছে| প্রকাশকরাও তার খবর রাখেন| তাদের প্রকাশিত বইয়ের লেখকরা বহুলাংশে দিল্লির বাইরের|
Review Comments
সোসাল মিডিয়া কামেন্টস