গৌতম দাশ
লেখক / সংকলক : iPatrika Crawler
গৌতম দাশের কবিতা
১
কিছু লিখব বলে কতদিন বসে আছি...
ছিল এক বিশাল কাঠের দরজা, দু'দিকে তার বুক সমান পাঁচিল, দরজা পেরিয়ে পায়ে চলার সুরকিবাঁধা পথ, পথের দু'ধারে নাম না জানা কত গুল্মলতা, তারপর ছিল আরো একটা দরজা, দরজা পার করে বিশাল ড্রয়িংরুম আর ড্রয়িংরুমের কোনে অপেক্ষারত জটিল কিছু সিঁড়ি, শনি রবিবার বাদে প্রতিদিন ঐ সিঁড়ি বেয়ে বিকেলবেলায় উঠে যেতাম তোমার ঘরে, অঙ্ক কষাতে চাইলে তুমি বলতে অঙ্ক নয় আজ ইতিহাস পড়ান আর ইতিহাসের দিন হঠাৎ করেই আমায় প্রশ্ন করতে
আচ্ছা, আপনি স্বপ্ন দেখেন, আমি না রোজ রাতে একটা নতুন স্বপ্ন...
তারপর থেকে প্রতিরাতে আমিও স্বপ্ন দেখব বলে ভাবি, এঁদোগলির দশ বাই আটের ভাঙা তক্তপোশে চিৎ হয়ে শুয়ে বড় করে শ্বাস নেই, ভাবতে থাকি বিকেলে তোমার গা থেকে ভেসে আসা চন্দনের সুবাস ..
ঠিক সেই মুহূর্তে জানলা দিয়ে পোড়া বিড়ির বা খোলা নর্দমার একটা তীব্র কটু গন্ধ ভেসে আসে, তক্তপোশের ও প্রান্তে শুয়ে থাকা আমার বুড়ো বাবা তখনই খকখকিয়ে কেশে ওঠে, বিড়ি নর্দমা আর পুরনো শ্লেষ্মার পাঁকাটে একটা গন্ধ দশ বাই আটে ঘুরতে থাকে, মেঝেতে মা পাশ ফেরে, আধোঘুমের মধ্যেই বলে ওঠে, মাগো, এবার আমায়... , ছোট বোন রিঙ্কির বিরক্তি-মাখা ঘুম ঘুম স্বর, উঃ চুপ করো না, এমনিতেই এত গরম, ঘুম আসছে না...
স্বপ্নের কথা ভেবে ভেবে একসময় ঘুমিয়ে পড়ি
সকাল হয়, ঘড়ির কাঁটা-দুটো বারবার দেখি, দুটো দরজা, নাম না জানা গুল্মছাওয়া পথ আর সবশেষে জটিল সিঁড়ির ধাপ বেয়ে ...
লিখব বলে কতদিন ধরে বসে আছি, এক সময় ক্লান্তিতে পড়েছি নুয়ে
শব্দ আর আমি, দু'জনাই আজ ছাপোষা যে
২
লোকটিকে অনুসরণ করে করে ঢুকে পড়লাম কবরস্থানে আর অমনি সমস্ত কবরের ঢাকনা খুলে ফিসফিস করে উঠলো কথাবার্তারা
বুকের ভেতরে কিছু পাথর থাকা ভালো, এসো, দু'জনা কবরের অন্ধকারে কিছুক্ষণ পাশাপাশি শুয়ে থাকি, দু'দণ্ড নিজেদের কথা বলি
আলখাল্লা পরা স্মৃতিমেঘের খাঁজে খাঁজে থাকে আলো অথবা আঁধার তাই যেতে যেতে সবাইকেই একবার না একবার পিছু ফিরতে হয়, সময়েরও তো থাকে কিছু খুচরো প্রত্যাশা যেমন পড়ে থাকে কুড়িয়ে নেওয়ার জন্য কতকালের পুরনো অথবা নতুন চিঠি, ফিরে তাই আসতেই হয়, পলেস্তারা মুঠো করা বটচারার মতন কেউ না কেউ তোমার জন্য যে প্রতীক্ষায় অথবা যাকে অসমাপ্ত ভুল ভেবেছিলে সে আজও হয়তো দাঁড়িয়ে পাতার আড়ালে শক্ত কুঁড়ির মতন
সহজ ভাবে তুমি এসবের নাম দিতে পারো
আলুথালু স্বপ্ন অথবা ভালবাসা
আর আমি একে বলি মধ্যবর্তী বিষণ্ণতা
৩
অল্প ভাঙা গল্পগুলো প্রতিরাতে বারবার ফিরে ফিরে আসে আর সেই গল্প শোনাতে শব্দের কাছে আমি হাত পাতি, আগেও বলেছি আমার বাড়ির উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে থাকা সেই মাথানিচু ল্যাম্পপোস্ট, বলেছি তার হলদে আলো অথবা সে আলোয় দূরের পাঁচিলে মাখামাখি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছায়াদের কথা যাদের সাথে প্রতিরাতে কথা হয় আমার, আমাদের কথোপকথনে ওদের মুখ থেকে বার হওয়া প্রতিটি শব্দ যেন এক এক জাদুমন্ত্র যা এক এককরে খুলে দেয় আমার বুকের মাঝে লুকিয়ে রাখা সব স্মৃতিসিন্দুক
সতত স্মৃতিরা সেখানে কখনো হাসায় আমায় কখনো বা আমি হাত রাখি চোখের কোনে ...
ছায়ারা অমনি দেওয়ালে তিরতির করে কেঁপে ওঠে, আমার দিকে চেয়ে বলে
আমরা, মৃতদেহরা, সব শুনছি
তুমি বলো
আকাশের থেকে একটু অন্ধকার চেয়ে নেই তখন আমি, তারাদের আলো এক্ষুনি যে বন্ধ হওয়া দরকার
সহ্য করতে পারি না ছায়াদের ঐ ফিসফিসানি
আমরা, মৃতদেহরা, সব শুনছি
ভোর হওয়ার আগে তাই হাতড়াতে হাতড়াতে অল্পভাঙা আমার গল্পগুলো আবার ভরে নেই স্মৃতিসিন্দুকে...